মাশরাফিদের সামনে 'নতুন' ইংল্যান্ড?
‘গোউজ ফর হিরো। বোল্ড’ইম। ফুল অ্যান্ড স্ট্রেইট। দ্য বাংলাদেশ টাইগারস হ্যাভ নকড দ্য ইংলিশ লায়নস, আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ। ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ডেইজ ইন দ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট হিস্টোরি, ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট পয়েন্টস ইন ইংলিশ ক্রিকেট।’
ধারাভাষ্যে নাসের হুসেইন বলে যাচ্ছেন, টিভি ক্যামেরা তাঁর কথা ধরে দেখাচ্ছে ছবি। কখনও শুয়ে পড়া মাশরাফির উপর জড়ো হওয়া বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের, কখনোবা ইংলিশ ডাগআউট। এপাশে আনন্দের রোশনাই, ওপাশে গুমোট পরিবেশ! কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে টিকে থাকতে সে ম্যাচটা জিততেই হতো ইংলিশদের, রুবেল হোসেনের রিভার্স সুইংয়ে জিমি অ্যান্ডারসনের বোল্ড নিশ্চিত করলো গ্রুপ পর্ব থেকেই তাঁদের বিদায়। শুধু অ্যাডিলেড ওভাল নয়, হাজার মাইল দূরে গোটা বাংলাদেশ যখন উল্লাসে মাতোয়ারা, ইংলিশ ক্রিকেটে চলছে ভাঙ্গনের সুর। তবে কি সীমিত ওভারের ক্রিকেটটা ইংল্যান্ডের জন্য নয়? যে বাংলাদেশের সঙ্গে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছিল ইংল্যান্ড, সেই বাংলাদেশের সঙ্গেই এবার খেলতে আসছে এউইন মরগানের দল। বাংলাদেশের সামনে আসবে নতুন এক ইংল্যান্ড, ওয়ানডেতে যে ইংল্যান্ড খেলে নতুন ধরণের ‘ইংলিশ’ ক্রিকেট। গল্পটা বিশ্বকাপের পর বদলে যাওয়া সে ইংল্যান্ড দলেরই....
নতুন ইংল্যান্ড, নতুন ‘স্বাদ’!
দল বদলালো, বিশ্বকাপের আগের সিরিজেই অধিনায়ক বদলানো দল শুরু করলো নতুন মিশন। অ্যান্ডারসন-ব্রড বাদ গেলেন, বাদ গেলেন ইয়ান বেলদের মতো সিনিয়ররাও। অ্যালেক্স হেলস ওপেনিংয়ে এলেন, সঙ্গী পেলেন জ্যাসন রয়কে। এলেন স্টোকস; পেস বোলিংয়ে একে একে এলেন মার্ক উড, ডেভিড উইলিরা। স্পিনে আদিল রশিদ। ‘নতুন’ ইংল্যান্ডের প্রথম পরীক্ষা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে, বার্মিংহামের এজবাস্টনে।
আদতেই এজবাস্টন দেখলো নতুন এক ইংল্যান্ডকে। প্রথমবারের মতো চারশ' রান পেরিয়ে গেল ইংলিশরা; এর আগে সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩৯১, সেই ২০০৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে। ‘নতুন’ ইংল্যান্ড তাদের সর্বশেষ সিরিজে আরেকবার ছুঁয়েছে ৪০০ রানের চূড়া। শুধু ছোঁয়নি, ওয়ানডেতে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও এখন ইংল্যান্ডেরই! পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রেন্টব্রিজে অ্যালেক্স হেলসরা করেছেন ৪৪৪ রান, ভেঙ্গে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ১০ বছরের পুরোনো রেকর্ড। মোট ১৮ বার ওয়ানডে ক্রিকেট ৪০০ বা এর অধিক স্কোর দেখেছে, সবচেয়ে বেশীবার এ কীর্তি আছে দক্ষিণ আফ্রিকার। প্রোটিয়ারা প্রথম চারশ' করেছিল ২০০৬ সালে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাঁরা মোট ছয়বার করেছে এমন স্কোর। আর ইংল্যান্ড বছরখানেকের মাঝেই করেছে দুইবার!
‘বিগ-ইংল্যান্ড’
এ শতাব্দীর শুরু থেকে গত বছরের বিশ্বকাপ পর্যন্ত সময়ে ইংল্যান্ড ওয়ানডেতে ৩৫০ রানের কোটা পেরিয়েছিল মাত্র একবার। ভারত এ সময়ের ভেতরে ৩৫০ বা এর উপর স্কোর করেছিল ১৯ বার, দক্ষিণ আফ্রিকা ১৮ বার, অস্ট্রেলিয়া ১৪ বার, নিউজিল্যান্ড ১১ বার!
সেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের পর থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ ওয়ানডে পর্যন্ত ৩৫০ বা এর উপরে রান করেছে ৬ বার! শ্রীলঙ্কা ২ বার করেছে, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তান করেছে একবার করে।
‘আউট দেম অল!’
শুধু ব্যাটিংয়ে বড় স্কোরের অভ্যাসই করেনি ইংল্যান্ড, বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে অল-আউট করার অভ্যাসটাও শানিয়ে নিয়েছে। বিশ্বকাপের আগের এক বছরে সর্বোচ্চ ১৯ বার প্রতিপক্ষকে অল-আউট করেছিল প্রোটিয়ারা, ইংলিশরা পেরেছিল নয়বার, তাঁদের অবস্থান ছিল এ তালিকায় ছয়ে। আর বিশ্বকাপের পর থেকে অল-আউট করার রেকর্ডে ইংল্যান্ড আছে তিন নম্বরে, অবশ্য এ সময়ে ইংলিশ বোলাররা সব উইকেট নিয়েছেন আটবার। তবে অল-আউট করার হারটাই কমে এসেছে, সর্বোচ্চ ১২ বার করেছে অস্ট্রেলিয়া।
যেখানে সবার উপরে!
সব মিলিয়েই বিশ্বকাপের পর থেকে ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্সের গ্রাফটা ঊর্ধ্বমূখী। বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ড ২৮ ম্যাচ খেলে জিতেছিল ১০টিতে, হেরেছিল ১৮টিতেই। বিশ্বকাপের পর থেকে সর্বশেষ সিরিজ, ইংল্যান্ড এ সময়ে খেলেছে ৩০টি ম্যাচ, জিতেছে ১৭টিতে, হেরেছে ১০টি, একটা টাই।
বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ড উইকেটপ্রতি রান তুলেছিল ২৭.৫৫ করে (সর্বোচ্চ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার, ৪৩.৭৭)। বিশ্বকাপের পর সেটা বেড়ে হয়েছে ৪১.১৭; এ সময়ে যা সর্বোচ্চ। ইংল্যান্ডের ওভারপ্রতি রান ছিল ৫.২৩, সেটা বেড়ে হয়েছে ৬.৩৩। প্রতি ওভারে এত বেশী রান তুলতে পারেনি আর কোনো দল।
ইংল্যান্ডের ‘গোল্ডেন-বয়’*
বিশ্বকাপের পর ২৪টি ম্যাচ খেলেছেন ইংল্যান্ডের ‘গোল্ডেন-বয়’ জো রুট। ৫৭.৮৫ গড়ে করেছেন ১২১৫ রান, চারটি সেঞ্চুরি, টানা ছয়টি ফিফটিসহ মোট ফিফটি ৯টি। রুট খেলেছেন, এমন ১৫টি ম্যাচে জিতেছে ইংল্যান্ড, রুটের গড় এ সময় বেড়ে হয়েছে ৬৭.০৭।
‘জস-ফ্যাক্টর’
২৩ ম্যাচে জস বাটলারের রান ৭৯২, গড় ৫৬.৫৭, স্ট্রাইক রেট ১৩৮.০৪। কিন্তু ইংল্যান্ড যখন জিতেছে, বাটলারের গড় হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশী, ১২৭.৮০! স্ট্রাইক রেটও বেড়ে হয়েছে ১৫৭.৯৫!
‘বিগ’ হেলস*
অভিষেক হয়েছিল ২০১৪ সালের আগস্টে। সব মিলিয়ে হেলসের সেঞ্চুরি চারটি, সব কটিই করেছেন বিশ্বকাপের পর থেকে সর্বশেষ সিরিজের মধ্যে। পাকিস্তানের সঙ্গে ১৭১ রান করে ভেঙ্গে দিয়েছেন রবিন স্মিথের ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও।
রশিদেই ভরসা?
২০০৯ সালে ওয়ানডে অভিষেক, সে বছর পাঁচটি ওয়ানডে খেলেছিলেন আদিল রশিদ। এরপর বাদ, ফিরেছেন গত বিশ্বকাপের পরই। এরপর খেলেছেন ২৯টি ম্যাচ, নিয়েছেন ৩৮.৩৬ গড়ে নিয়েছেন ৩৮ উইকেট। মঈন আলি নন, বাংলাদেশের মাটিতেও তাই ইংল্যান্ডের মূল ভরসা হবেন রশিদই। বাংলাদেশের স্পিন-সহায়ক উইকেট থেকে কতোটা সহায়তা পাবেন রশিদ?
উপমহাদেশ চ্যালেঞ্জ?
‘নতুন’ ইংল্যান্ড দেশের বাইরে সিরিজ খেলেছে একটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তানের সঙ্গে চার ম্যাচের সিরিজটি তারা জিতেছিল ৩-১ ব্যবধানে। এশিয়ার মাটিতে খেলা হলেও তাই উপমহাদেশ বাকি রয়ে গেছে। ধীরগতির নীচু উইকেটে ইংলিশ ব্যাটসম্যান আর বোলারদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের মাটিতে ফাইনাল খেলেছে ইংল্যান্ড, সেই অভিজ্ঞতা কতখানি কাজে দেবে, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা!
*ইংল্যান্ডের ওয়ানডে স্কোয়াড থেকে বিশ্রাম দেয়া হয়েছে জো রুটকে।
*'নিরাপত্তাজনিত ব্যক্তিগত' কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ সফর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন অ্যালেক্স হেলস।