সেই ঈদ, এই ঈদ
বীরেন্দর শেওয়াগের মিডল-স্ট্যাম্প লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে, আর তিনি আঙ্গুল নির্দেশ করছেন কারও দিকে, মুখে দিগ্বিজয়ীর হাসি! নাকি সংবাদকর্মীদের সামনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা! অথবা শুয়ে পড়া, আবেগ লুকাতে, কিংবা আবেগের আতিশয্যে। অ্যাডিলেড ওভালে। মাশরাফি বিন মুর্তজা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘পাগলা’র কোন বিশ্বকাপ স্মৃতিটা মনে আছে আপনার? স্মৃতির কোলাজে কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে আনন্দ দেয়, কোনটাই বা ভরে তোলে বিষাদে? মাশরাফিরই বা কী মনে হয়! মনের দুয়ারে যে স্মৃতিই আসুক, কানাডার সঙ্গে সেই ম্যাচটা কি মনে পড়ে মাশরাফির? তাঁর ভুলে যাওয়ার কথা নয়, হয়তো উপরে উপরে কাউকে বলবেন না, তবে ভেতরে পুষিয়ে রাখবেন। এলোমেলো, ‘রহস্যময়’ ব্যর্থতার টানা রথের সেই ম্যাচটারও যে আলাদা করে তাৎপর্য আছে! হয়তো আছে মাশরাফির ক্যারিয়ারেও। কিংবা নেই। হয়তো ক্রিকেটপ্রেমীরা এখনও মনে রেখেছেন সেই ম্যাচ, অথবা সাফল্যের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন।
১৩ বছর আগে।
টেস্ট স্ট্যাটাস আছে, আগের বিশ্বকাপেই পাকিস্তানকে হারানোর সুখস্মৃতি আছে। আর আছে ‘মিনোজ’ তকমা। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ তো তখনও ‘ছোট দল’ই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুখস্মৃতি হয়ে আছে ওই নর্দাম্পটনই। এরপর ৪৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, পরাজয় প্রত্যেকটিতেই। তবুও, ডারবানের সে ম্যাচে বাংলাদেশই ছিল ‘ফেবারিট’। প্রতিপক্ষ কানাডা। ‘প্রায়’ অপেশাদার, অনভিজ্ঞ আর ‘বহুজাতিক’ কানাডা। প্রায় ২৩ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নেমেছিল কানাডা, বাংলাদেশের সঙ্গে তাই অভিষেক হয়ে গেল ১১ জনেরই। সেই খেলোয়াড়দের কেউ আবার পানির কলের মিস্ত্রী, কেউবা অন্যকিছু। অপেক্ষাকৃত ‘ছোট’ দলের কাছে বাংলাদেশের সেই প্রথম হার নয়, নয় শেষও। কিন্তু ২০০৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির কিংসমিডকে ভুলতে পারে ক'জন! রাত পোহালেই ঈদ, বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর একটি। রাতজেগে যারা টিভিস্ক্রিনে চোখ রেখেছিলেন, ঈদটা তাঁদের কেমন কেটেছিল, অনুমান করে নিতে কষ্ট করতে হয় কি!
অথচ ম্যাচের শুরুটা বলছিল ভিন্ন কথা। মঞ্জুরুল ইসলাম আর মাশরাফি বিন মুর্তজার আঁটসাঁট বোলিং, কানাডার নিয়মিত উইকেট। মাশরাফির সেটি প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ। ৮ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ২ উইকেট, মাশরাফির মনে থাকারই কথা। সানোয়ার হোসেনের স্পিনে দুই উইকেট, মিডল অর্ডারের ভিতটা নাড়িয়ে দেয়া। কানাডার সর্বোচ্চ রান ইয়ান বিলক্লিফের, ৪২, যাঁর জন্ম নিউজিল্যান্ডে। পরের সর্বোচ্চ ডেসমন্ড চামনির ২৮, তিনি জন্মেছিলেন সেন্ট কিটসে। সব মিলিয়ে ১৮০, ‘ডিফেন্ড’ করার মতো স্কোর, কিন্তু খুব ভরসা করার মতো কি!
কিন্তু জ্যামাইকার এক কলের মিস্ত্রী যে ভেবেছিলেন অন্যকিছু। অস্টিন কডরিংটন, তাঁর মিডিয়াম পেসেই গড়বড় হয়ে গেল সব। তবে কডরিংটনের ‘খেল’ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ঠিক পথেই ছিল বাংলাদেশ। ২১তম ওভারে ৪ উইকেটে ১০৬ রান, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আসন্ন ঈদের উৎসবে তখনও বাড়তি রঙ এর অপেক্ষা! এরপর?
পরের গল্পটা হয়তো ভুলেই যেতে চান সবাই। দায়িত্বজ্ঞানহীন শটের পসরা সাজিয়ে বসলেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা। যাওয়ার আগে শুধু দুইটা চার মেরে গেলেন মোহাম্মদ রফিক, ওই পর্যন্তই! থাকলেন না। থাকলেন না কোনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানই। ৪৪ বলের মধ্যে ১৪ রান তুলতেই বাংলাদেশের শেষ ছয় উইকেট নেই! উল্লাসে মাতোয়ারা কানাডা, ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তাঁরাও! আর বাংলাদেশ?
হতবাক? নাকি নির্লিপ্ত? কানাডার সঙ্গে সে ম্যাচ দিয়েই শুরু বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ‘বাজে’ বিশ্বকাপ। একমাত্র জয়হীন বিশ্বকাপ!
সেই ঈদটা কেমন কেটেছিল মাশরাফির? হয়তো বলবেন, ভালই। হয়তো কিছুই বলবেন না। আগের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উল্লাস দেখেছিলেন নিতান্ত দর্শকের চোখে, নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচটাও নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন স্মরণে রাখার মতো কিছু করতে! তবে মাশরাফি হয়তো ভুলে যেতে চাইবেন সে ‘অভিষেক’, ভুলে যেতে চাইবেন পুরো বিশ্বকাপটাই। এরপর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচ, প্রথম ওভারেই চামিন্দা ভাসের হ্যাটট্রিক। কানাডার সঙ্গে হার বাংলাদেশকে খাদের কিনারে নিয়ে গেল, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচ দিল ধাক্কা। এরপর শুধুই হাবুডুবু খাওয়া, হতাশার অতল তলে!
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচের পর আর খেলা হয়নি মাশরাফির। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ম্যাচের আগে পায়ের নীচে বল পড়ে চোট পেলেন, ছিটকে গেলেন বিশ্বকাপ থেকেই। আগেভাগেই দেশে চলে এসেছিলেন মাশরাফি।
গ্রুপ পর্ব থেকে ফিরেছিল বাংলাদেশও। জয়হীন, ছিন্নবিন্ন একটা দল। কানাডার সঙ্গে হারের কারণেই কিনা, কেনিয়ার সঙ্গে হারটা ছিল খুব স্বাভাবিক! আর বাকীগুলো যেন অপরিহার্য। বাংলাদেশকে অবশ্য দুইটি পয়েন্ট দিয়েছিল প্রকৃতি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ম্যাচটা যে শুরু হওয়ার পর ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে।
আরেকটা ঈদ। সামনে আসছে ইংল্যান্ড, রোমাঞ্চিত বাংলাদেশের ক্রিকেট। তার আগে আসবে আফগানিস্তান। মাশরাফিরা ব্যস্ত প্রস্তুতিতে। ১৩ বছর আগের একটা ঈদের সঙ্গে এই ঈদের কতো পার্থক্য! বাংলাদেশ এখন পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সিরিজ জেতে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে। সামনে খেলবে ‘অভিজাত’ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি! বাংলাদেশের কোনো এক তরুণ পেসারে বিশ্ব মজে যায়। সমসাময়িক বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার খেলেন এই দেশে। কারও বাঁহাতি ব্যাটিংয়ে দেখে নতুন রোমাঞ্চ। আর থাকেন একজন নেতা। চোটের সঙ্গে নিত্য লড়াই চলে যার, ক্রিকেট দর্শনে মুগ্ধ করে চলেন যিনি। এমন দিনে কিংসমিডের সেই স্মৃতিটা কি মনে রাখার দরকার আছে?
হয়তো আছে, হয়তো নেই। তবে থাকলেই বা ক্ষতি কি! আঘাতের রেশ কেটে গেলেও যে স্মৃতিটা থাকে, সেটাও তো প্রেরণা দেয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার! দুর্দশা কাটিয়ে যখন নতুন সাফল্যে মত্ত হওয়া যায়, সেটাই তো বেশী তৃপ্তির। কিংবা কিংসমিডকে মনে রাখা যায় শিক্ষা হিসেবে। অদূরদর্শী কোচ, দুর্বল ম্যানেজমেন্ট, অধিনায়কত্বের দুর্বলতা, কিংবা ‘জানা যায় না এমন অনেক কারণ’ যখন ক্রিকেটে ছোবল মারে, কিংসমিড আর কানাডার সঙ্গে ম্যাচ ফিরে ফিরে আসে।
সাফল্যের দিনে যে দুর্দশার কথা মনে রাখতে পারে, তাঁর চেয়ে কঠিন আর কে আছে বলুন!