ম্যাশময় এক ম্যাচ
মাশরাফি ব্যাটিংয়ে নামলেই মিরপুরে একটা গর্জন ওঠে। যেন প্রতিবারই মাশরাফি কিছু একটা করে দেখাবেন। ‘ফুল-ফ্লো’তে ছয় মারবেন, একটা ক্যামিও খেলবেন, স্কোর তড়াক করে বেড়ে যাবে! মাশরাফি আফগানিস্তানের সঙ্গে তেমন কিছু করতে পারলেন না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচেও না। প্রায় জেতা ম্যাচটা হেরে গেল বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে ভারতের সঙ্গে সেই ম্যাচের স্মৃতি ফিরে ফিরে এলো। মাশরাফির মতে, সে ম্যাচটার চেয়েও, এ ম্যাচটা সহজ ছিল বেশী! ৩৮ রান, ৫০ বল, হাতে চার উইকেট(মাশরাফি নামার আগে ছিল ৫২ বলে ৩৮ রান, হাতে ছয় উইকেট)!
মাশরাফিরও তো কিছু করার ছিল! আদিল রাশিদের শর্ট বলটা চাইলেই মারতে পারতেন। কিন্তু বেশী সতর্ক হতে গিয়েই কিনা থার্ডম্যানে খেলতে চাইলেন, গেলো বাটলারের কাছে ক্যাচ! খেলার ধরনটা যে ঠিক ছিল না, সেটা মেনে নিয়েছিলেন তখনোই। হয়তো আরেকটু দেখেশুনে খেললে, রানের জন্য এত তাড়াহুড়ো না করে সময় নিলে চিত্রটা ভিন্ন হতো!
মাশরাফি চিত্রটা বদলালেন দ্বিতীয় ম্যাচে এসে। ১৬৯ রানেই নেই ৭ উইকেট, বল বাকী ঠিক ঠিক ওই ৫০টাই, প্রথম ম্যাচের মতো। দেখেশুনে খেললে কতোই আর রান হবে, ২০০! তাতে তো ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুত করে ওঠা যাবে না। মাশরাফি তাই ফিরে গেলেন সেই পুরোনো চিন্তায়। ‘স্লগ করে যাও, হলে হবে, নাহলে নাই’!
হলো অনেককিছুই।
মাশরাফি স্লগ করা শুরু করলেন প্রথম থেকেই। বলের লাইনে গেলেন, মঈন আলিকে খেললেন লং-অফে। স্লগ করতে নামা এক ব্যাটসম্যান খেললেন পুরোদস্তুর এক ‘নিখুঁত’ শট! ওই ওভারের শেষ বলে আবার ছয়, আগেরটার মতো অতো নিয়ন্ত্রিত নয়। তাতে কী, রান তো আসছে! ক্রিস ওকসের একটা শর্ট বলে খেললেন টেনিসের মতো করে, বল গেল মিডউইকেটের দিকে। মাশরাফি খুঁজছিলেন ফাইন লেগে! যেখানেই খুঁজুন, বাউন্ডারি তো হলো! ডেভিড উইলিকে পরে একটা চার মারলেন, যে কোনো স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানও যেটা দেখে ঈর্ষা করবেন!
৮-৯-১০-১১ নম্বরে রান না পাওয়ার কথা মাশরাফি কদিন থেকেই বলে আসছিলেন। গত এক বছরে এ পজিশনগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল করুণ। টেইলএন্ডারদের রানসংখ্যায় বাংলাদেশের নীচে ছিল শুধু স্কটল্যান্ড আর ভারত! সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল ১৬ রানের, অথচ ইংল্যান্ডের একটা অপরাজিত ৯৫ রানের ইনিংসও আছে! এ বছর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আট নম্বরে নেমে ৯৫ রান করেছিলেন ক্রিস ওকস, শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ টাই করেছিলেন লিয়াম প্লাঙ্কেট। নীচের দিকে রান পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ সেটা তো জানাই, রান পেলে তার ফল কিরকম হাতেনাতে পাওয়া যায়, সেটা দেখালেন মাশরাফিই।
এ ম্যাচের আগেও বারবার বলছিলেন, শেষ করে আসার কথা। ৫০ ওভার ধরে খেলার কথা। সেট ব্যাটসম্যানকে সঙ্গ দেয়ার কথা। তিনি যখন নামলেন, তখন দুই ব্যাটসম্যানই নতুন প্রায়। নাসির খেলেছেন ৮টা বল, তবে তিনিই তো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান! কিসের কী, উল্টো নাসিরই সঙ্গ দিয়ে গেলেন মাশরাফিকে। ৬৯ রানের জুটিতে নাসিরের ভাগ তাই মাশরাফির ৪৪ রানের প্রায় অর্ধেক, ২৩।
‘ফাইট’ দেয়ার মতো তো একটা স্কোর না হয় হলো। কিন্তু রণকৌশলটা কী হবে বোলিংয়ে? মাশরাফির দ্রুত উইকেট দরকার ছিল। যতোই লো-স্কোরিং ম্যাচ হোক, শুরুর দিকের উইকেট মানেই তো প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার একটা সুযোগ। মাশরাফি তাই প্রথম ওভারেই আনলেন তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বোলারটাকে। সাকিব আল হাসান। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়বারের মতো বোলিংয়ে ইনিংস ওপেন করলেন সাকিব
তবে প্রথম আঘাতটা হানলেন মাশরাফি নিজেই। আঁটোসাঁটো লাইন-লেংথে জেমস ভিনসকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন আগেই, এবার সুইংয়ে ভড়কে দিলেন। ভিনস ড্রাইভ করতে গেলেন, কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ। মাশরাফির ‘আর্লি-উইকেট’!
সাকিব হয়তো মাশরাফির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন! পরের ওভারেই বেন ডাকেটকে বাধ্য করলেন ‘ডাক’ মারতে, ডাকেট রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন! জ্যাসন রয় হাত খুলে খেলতে পারছিলেন না, মাশরাফির বলে খেলতে গেলেন সেভাবেই। মিস করে গেলেন পুরোটা, এলবিডাব্লিউ।
তবে স্টোকসের উইকেটটা ছাড়িয়ে গেল বোধহয় সবকিছুতেই। গত এক বছরে মুস্তাফিজ ছিলেন, মাশরাফি তাই নতুন বল হাতে নেননি খুব একটা। এসেছেন ১০-১৫ ওভার পর বোলিং করতে। মুস্তাফিজের কাটার নিয়ে সবাই ব্যস্ত, কিন্তু মাশরাফি নিজেও একের পর এক উইকেট নিয়ে গেছেন কাটারে। স্টোকসের উইকেটের ডেলিভারিটা কাটার ছিল না, ছিল চিরায়ত ‘সিম-আপ’ ডেলিভারি। ‘সিম-পজিশন’ একদম ঠিক, হালকা সুইং। বিভ্রান্ত স্টোকস, বিভ্রান্ত স্ট্যাম্প!
সাকিবকে দিয়ে করালেন ৭ ওভার, নিজে করলেন ৬। শফিউলকে আনলেন প্রথমে, ওদিক থেকে তাসকিনকে। তাসকিন একের পর এক শর্ট বল করে গেলেন, বাটলারও খেললেন শান্তিমতো। এক ওভারেই তিনটা চার! তাসকিনকে বসালেন। আনলেন নাসিরকে। বাটলার-বেইরস্টোর জুটি জমে উঠেছে, ৭৯ রান। আবার হাত ফসকে বেড়িয়ে যাচ্ছে ম্যাচ। মাশরাফি ঘুরলেন তাসকিনের দিকেই! দলের একমাত্র ‘ফাস্ট’ বোলার যে তিনিই!
দিক পরিবর্তন করে আনলেন অন্য প্রান্ত থেকে। জনি বেইরস্টো হার মানলেন পেসে। তাসকিনের ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়া স্পেলের শুরু তখন! এক ওভার বাদে আউট বাটলার। নাটক হলো, রিভিউ নিলেন মাশরাফি। সফল রিভিউ, শুধু বাটলার-বেইরস্টোর জুটি ভাঙ্গল না, দুজনকেই ফেরালেন তাসকিন! প্রথম দুই ওভারে ১৯ রান দেয়া তাসকিন। অধিনায়ক মাশরাফি যে ভরসা রেখেছিলেন তাঁর উপরই! তাসকিনের পরের শিকার ওকস। জয়টা ‘সময়ের ব্যাপার’। মাশরাফি বোলিংয়ে আনলেন মোসাদ্দেককে। সাকিবের তিনটা ওভার বাকী, তাঁকে আনলেই তো হয়! মোসাদ্দেক উইকেট নিলেন, সাকিব বোলিংয়ে আসলেন এরপর। দুই ওভারে দিলেন ২২ রান!
মাশরাফি নিজেই আসলেন এরপর। শেষ জুটি, ৪৫ রানও হয়ে গেল। আক্রমণ করা হবে, নাকি বল ডট দেয়া হবে, এ মুহুর্তগুলোতে ধন্দে পড়ে যেতে হয়। হয়তো মাশরাফিও পড়ে গেলেন। তবে আত্মবিশ্বাস ছিল। শেষ উইকেট, আউট হলেই তো শেষ!
জেক বল আউট হলেন। ওই মাশরাফির বলেই।
মাশরাফি এদিন স্লগ করতে চেয়েছিলেন। মাশরাফি এদিন দ্রুত উইকেট চেয়েছিলেন। নতুন বলে মাশরাফি এদিন সুইং করাতে চেয়েছিলেন। মাশরাফি আগের ম্যাচের পর মানসিকভাবে একটু পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে চাঙ্গা করতে চেয়েছিলেন এদিন।
প্রায় সময়ই বোধহয় এসবই চান।
যেদিন চাওয়াটা পূর্ণ হয়, সেদিন ম্যাচটা হয়ে ওঠে মাশরাফিময়!