বাংলাদেশের যত গ্লানি
আজ ভুটান থেকে উড়ে আসা বিমানটা যখন ঢাকার রানওয়ে স্পর্শ করবে, সেখান থেকে কারা নামবে জানেন? বিধ্বস্ত, পাণ্ডুর, হার মেনে নেওয়া একদল ফুটবলার নয়, বাংলাদেশের ফুটবলের শবদেহ। বার্ধক্যে জীর্ণ যে শরীরটা অনেক দিন ধরেই টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছিল বাংলাদেশ, কাল থিম্পুতে সেটিই কি ধুঁকতে ধুঁকতে চিরতরে নিঃসাড় হয়ে পড়ল না? এই ফুটবলের মৃতদেহ আবার কেউ সঞ্জীবনী শক্তিতে জাগিয়ে তুলবে, আপাতত ওই আশা দুরাশাই থাক।
ভুটানে যা হলো, সেটা বছর দুয়েক আগেও তো একরকম অবিশ্বাস্যই মনে হতো। সাফ ফুটবলের সবচেয়ে নবিশ দলটিকে বাংলাদেশ তো সারাজীবনই হেসেখেলে হারিয়েছে। এই তো, গত বছরেই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গিয়ে ভুটানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে এসেছে। যে ভুটানের কাছে কখনোই হারেনি বাংলাদেশ, তাদের কাছে এশিয়া কাপ বাছাইতে ৩-১ গোলে অসহায় আত্মসমর্পণের মতো লজ্জা তো বাংলাদেশের ফুটবলেই কখনো হয়নি। সামনের তিন বছর আর কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলতে পারবে না, এই ভগ্ন মনোরথ দলটির জন্য সেটিই এখন শাপেবর বলে মনে হচ্ছে। যাক, নতুন করে তো আর কোনো লজ্জা পেতে হবে না!
আত্মসমর্পণ শব্দটা একটু বাড়াবাড়ি শোনাতে পারে। কিন্তু কাল বাংলাদেশের ম্যাচ যারা দেখেছেন, তারা খুব একটা দ্বিমত করবেন না। নিজেদের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে ভুটান অন্তত পাঁচ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে। তার মধ্যে আবার একটা পেনাল্টি মিসও আছে। এই কিছু দিন আগেই মালদ্বীপে গিয়ে প্রীতি ম্যাচে পাঁচ গোলে হেরে ফিরে এসেছিল বাংলাদেশ। লজ্জা শব্দটাও আসলে ফুটবলের দুরবস্থা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
কিন্তু এই অপমানের দায় কে নেবে? চাইলে আপনি খেলোয়াড়দের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন। শেষ পর্যন্ত মাঠে গিয়ে তাদেরই তো খেলতে হয়। অবসরের নাটক করে আবার দলে ফেরা অধিনায়ক মামুনুলের ওপর দোষ চাপাতে পারেন। তা না হলে রনি, এমিলিদের নখদন্তহীন আক্রমণের ওপর দোষ চাপাতে পারেন। বাংলাদেশ স্ট্রাইকাররা শেষ কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল পেয়েছেন, সেটা বোধ হয় তারা নিজেরাও বলতে পারবেন না। চাইলে রায়হান, তপুদের রক্ষণের ওপরও দোষ চাপাতে পারেন। তিন গোল যে তো তাঁদের ব্যর্থতাতেই হয়েছে। আর গোলরক্ষক আশরাফুল তো আছেনই, কিছুটা দায়ভার তো তাঁকেও নিতে হবে।
আরও বলির পাঠা খুঁজতে চান? বেলজিয়াম কোচ টম সেইন্টফিট তো আছেনই। ভুটানে কেন তিনি এতজন স্ট্রাইকার নিয়ে গেলেন, যেখানে তারা সবাই গোল করাটা একরকম ভুলে গেছেন? আগের ম্যাচে মামুনুলকে বাদ দিয়েছিলেন, তাঁকেই বা আবার কী মনে করে ফিরিয়ে আনলেন? জামাল ভুঁইয়াকে ফিট নন বলে বাদ দেওয়াটাই বা কতটা যুক্তিযুক্ত ? সমাধান তো সহজ, সেইন্টফিটকে বিদায় করে দিন। নতুন কোচ তো বাংলাদেশের জন্য ছেলের হাতের মোয়ার মতো। এর আগে লোডভিগ ডি ক্রুইফ, গঞ্জালো লোপেজ, মারুফুল হক, ফাবিও লোপেজদের যেমন কয়েক মাস পরে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে, সেইন্টফিটকেও সেটা করলেই হয়। ব্যস, ল্যাটা চুকে গেল! বিদেশী কোচের তো কখনো অভাব হয়নি, এবারেও হবে না।
চাইলে আরও অনেক কিছুই করতে পারেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করতে পারেন, ফেসবুক ইভেন্ট খুলে ঠুনকো প্রতিবাদও করতে পারেন। কিন্তু যাদের দেখার কথা, তাদের এসব চোখে পড়বে না। সবাই যে চোখে ঢুলি পরে বসে আছেন। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন পরশু বলেছিলেন, ভুটানের ম্যাচের আগে দুশ্চিন্তায় তাঁর রাতে ঘুম হবে না। কাল ম্যাচ শেষে নিশ্চয় নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছেন। যাক আগামী তিন বছর আর কোনো ম্যাচের আগে এরকম উৎকন্ঠায় থাকতে হবে না। বাফুফের অন্যান্য হর্তাকর্তারাও এই সুযোগে তিন বছরের ছুটিতে যেতে পারেন। জাতীয় দল খেলছে না, তাদেরও তো কিছু করার নেই। মাস শেষে বেতনটা গুণে নিলেই হলো। আর মাঝে মাঝে কিশোরী ফুটবলাররা ঠিকমতো বাড়ি যেতে পারছে কি না, সেটার খোঁজ রাখলেই হবে। জাতীয় দলই যখন বেকার, ফেডারেশন থেকে আর কী হবে? ফিফা থেকে মাসকাবারি টাকাও নিশ্চয় বন্ধ হবে না। সেটার কিছু লোকদেখানো প্রকল্পে দিয়ে বাকিটা পকেটে ভরে নিলেই হলো।
এভাবেই চলতে পারত সবকিছু, কারও হয়তো কিছু এসে যেত না। কিন্তু কারও কারও হয়তো কিছু আসবে যাবে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে পড়ে থাকা ওই ছেলেটার, এক দিন যে লাল সবুজ জার্সি গায়ে আমার সোনার বাংলা গাইবার স্বপ্ন দেখে। কিছু হয়তো আসবে যাবে কারখানায় কাজ করা ওই কিশোরের, সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সবুজ মাঠেই খোঁজে দুদন্ড শান্তি। জাতীয় দলের “তারকা” ফুটবলার, "করিৎকর্মা" ফেডারেশনের এসব নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। বাংলাদেশের ফুটবলের এপিটাফ লেখা দিনে তাদের কি আদৌ কিছু আসে যায়?