• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডঃ গেম অফ থ্রন্স

    লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডঃ গেম অফ থ্রন্স    

    ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের শহর দু'টোর শুরুর গল্পটা বন্ধুত্বেরই! দুই শহরের দূরত্বটা ৩৫ মাইল। ১৮৩০ সালে ইতিহাসের প্রথম আন্তঃশহর রেললাইনটা সংযোগ করেছিল লিভারপুল আর ম্যানচেস্টারকে। দুই শহরের বন্ধুত্বের গল্পটা অবশ্য শেষ ওখানেই। এরপরের গল্পটাকে শাব্দিক অর্থের দায় এড়াতে কেবল ‘রক্তক্ষয়ী’ বলে বিশেষায়িত করা যায় না।

    ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী তারা। এই দুই দলের খেলার সময় হাজার মাইল দূরের এই বাংলাদেশের সমর্থকেরাও একে অন্যের মুখ দেখা দেখি বন্ধ রাখেন। লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তো শুধু ইংল্যান্ডের নয়, বিশ্ব ফুটবলেরই অন্যতম সেরা প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক ম্যাচ।   

    ইংলিশ লিগের মোট ৩৮ বারের চ্যাম্পিয়ন দুই দল। লিভারপুল- আর ম্যান ইউনাইটেড মিলে ৮টি ইউরোপিয়ান কাপ, ১৯ এফএ কাপের সাথে লিগ কাপের শিরোপা জিতেছে ১২ বার। দু’দলের ট্রফিকেসের বর্ণনা দিতে কমিউনিটিউ শিল্ড আর উয়েফা সুপার কাপের পরিসংখ্যানটা টেনে না আনাই শ্রেয়! ইংল্যান্ডের সফলতম দু’দলের লড়াইটা তো ‘রক্তক্ষয়ীই’ হবে! এতে অবাক হবার কি আছে?


    আজকের দিনের এই দুই শহরের রেশারেশির শুরুটা কিন্তু ফুটবল মাঠে নয়। এই দ্বৈরথের সাথে জড়িয়ে আছে দুই শহরের খেটে খাওয়া মানুষের পরিশ্রমের গল্প। যাদের হাত ধরে দুই শহরের গোড়াপত্তন। আছে শহর থেকে শিল্পনগরীতে রুপান্তরের গল্পও। আর ফুটবল মাঠের দ্বন্দ্বের সূচনাটা তারও পরের ঘটনা।
       
    পোর্টসিটি নামে সুখ্যাতি ছিল লিভারপুলের। আর আঠার শতকের ম্যানচেস্টার ছিল শ্রমশিল্পের শহর। টেক্সটাইল আর বিভিন্নরকম ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করত ওই শহরের বেশিরভাগ মানুষ। অন্যদিকে বন্দর নগর হওয়ায় লিভারপুলের বাসিন্দাদের আয়টা ছিল তুলনামূলক একটু বেশিই। শহর হিসেবেও লিভারপুলের পরিচিতিটাই সবখানে ভালো ছিল তখনও। বন্দরের আলাদা আন্তর্জাতিক কদর থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থনীতিও ছিল চাঙ্গা। ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় অর্থনীতিতে অবদান বেশি রাখতে পারায় উন্নতির ছোঁয়াটা যেন লিভারপুলেই লাগত বেশি।

    এরপরের গল্পটা ম্যানচেস্টারের! ইংলিশ ফুটবলে ১৯৭২-১৯৯২ পর্যন্ত একচেটিয়া লিভারপুলের শাসনের পরের গল্পটা যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডময়, উনিশ শতকের দুই শহরের গল্পটাও যেন তারই প্রিকুয়েল! লিভারপুলের রাজত্ব শেষ করেছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন একাই। আর উনিশ শতকের কিছু আগে ম্যানচেস্টারকে লিভারপুলের কাতারে নিয়ে যেতে শহরের মানুষেরা তৈরি করেছিল এক খাল! আইরিশ সাগরের সাথে সংযুক্ত করে কৃত্রিমভাবে কাটা খাল কুমির নয়, সৌভাগ্য ডেকে এনেছিল ম্যানচেস্টারবাসীর জন্য।  

    ১৮৯৪ সালের পর থেকেই তাই লিভারপুলের চেয়ে বরং ম্যানচেস্টার ক্যানেল দিয়েই জাহাজ যাওয়া আসা শুরু করল। শিল্প বিপ্লবের সূচনা করা দুই শহরের মাঝে বৈরিতার শুরু আসলে তখন থেকেই। এরপর থেকে অর্থনৈতিক উন্নতির গ্রাফটা লিভারপুলের চেয়ে ম্যানচেস্টারেরই বেশি ছিল। যা আজকের দিন পর্যন্তও আছে বহাল তবিয়তে!

    ফুটবলের টাকার ছড়াছড়ির শুরু ১৯৭০ এর পর থেকে। তার আগে ফুটবল ছিল শুধু মধ্যবিত্ত খেটেখাওয়া মানুষের খেলা। নিজ শহরের প্রতি ভালোবাসার সাথে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক জ্ঞানটাও তখনকার ফুটবলারদের বৈশিষ্টই ছিল। দুই শহরের এই অর্থনৈতিক লড়াইটাই ফুটবলে মাঠে লিভারপুল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে দিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর তকমা।

    গ্যারি নেভিল-স্টিভেন জেরার্ডদের খোঁচাখুঁচির হাতেখড়িটা তাই তাদের পূর্বপুরুষের হাত ধরেই। সময়ের সাথে সাথে দুই দল আর সমর্থকদের মাঝের দ্বন্দ্বটা পেয়েছে নতুন রূপ। ফুটবল মাঠে বৈরিতাই দু’দলকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা দলে পরিণত করেছে। যে দ্বন্দ্বের সূচনাটা হয়েছিল মাঠের বাইরেই!

    এই দুই দলের ফুটবলের বৈরিতাটা কিন্তু ষাটের দশকের আগে তেমনভাবে ছিলই না! তখনও লিভারপুলকেই ধরা হত ইংল্যান্ডের সেরা ক্লাব। স্যার ম্যাট বাসবির অধীনেই বদলে যাওয়া শুরু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। বদলের সাথে এবার শুরু ফুটবলমাঠে লিভারপুলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতাটাও। ম্যানচেস্টারবাসীর কাছে তো এ পুরনো দ্বৈরথ!

    মজার ব্যাপার হল ম্যাট বাসবি নিজেও ছিলেন লিভারপুলের খেলোয়াড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ছিলেন অধিনায়কও! আর সেই ম্যাট বাসবির হাত ধরেই শুরু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন দিনের।

    তবে লিভারপুল সমর্থকেরা কিন্তু কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন এই ক্ষেত্রে! তখনকার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলে সর্বকালের অন্যতম সেরা জর্জ বেস্ট, ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা স্যার ববি চার্লটন, ডেনিস ল’দের মতো খেলোয়াড়রা ছিলেন বলে মিডিয়ার আকর্ষণটা একটু বেশিই পেত রেড ডেভিলরা। সে কারনেই নাকি তখনকার লিভারপুল-ম্যান ইউনাইটেড দ্বৈরথটা অনেকটা ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে প্রায়ই ইউনাইটেড সমর্থকদের টিপ্পনি কাটেন লিভারপুলের সমর্থকেরা। এর পাল্টা জবাব অবশ্য তৈরিই থাকে রেড ডেভিল সমর্থকদের! ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফিটা তো জিতেছিল তারাই, আর সময়কালটাও ষাটের দশকেই!

    দু’দলের সমর্থকদের মাঝে এই নিয়ে যতোই কথা কাটাকাটি হোক, ইতিহাস বলছে ষাটের দশকেই শুরু লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল দ্বৈরথের।

    স্যার ম্যাট বাসবির হাত ধরে একটু একটু করে লিভারপুলের কাতারে যাবার চেষ্টায় তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এগিয়েছেও বহুদূর! এরপরের সময়টাই একেবারে অন্ধকার! ঠিক এখনকার লিভারপুলের মতোই! ২৩ বছর ধরে লিগ শিরোপা অধরাই রয়ে গেছে কপদের। এর মাঝে ১৩টি লিগ জেতা হয়ে গেছে রেড ডেভিলদের। প্রায় একইরকম অবস্থা পার করতে হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকেও। ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এক অর্থে উর্বর জমিতে ট্রফির চাষই করেছিল লিভারপুল। ১১ লিগ শিরোপার সাথে জিতে নিয়েছিল সাত ইউরোপিয়ান ট্রফিও। আর ১৯৬৯ এর পর একটি শিরোপা জিততে ইউনাইটেডকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২৬ বছর! এরপরের গল্পটা অবশ্য সবারই জানা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য এক দেবদূত আসলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। শুধুমাত্র জয়ই করলেন না, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন লিভারপুলকে হটিয়ে সবচেয়ে বেশি লিগ জেতা দলের ম্যানেজারও বনে গেলেন তাঁর সময়কালে।  

    ১৮৯৪ তে হয়েছিল লড়াইয়ের শুরু। এখনকার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তখনকার নাম ছিল নিউটন হিথ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ১৯৭ ম্যাচ খেলে ৮০ টিতে জয় ইউনাইটেডের; ৬৯ জয় লিভাপুলের। পরিসংখ্যানের হিসেবে নিজের দলকে সেরা বলে সহজেই দাবি করতে পারেন আপনি। চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা দু’বার বেশি ঘরে তুলে- আপনার প্রতিপক্ষ যদি নিজেদের সেরা দাবি করে বসে- সে যুক্তিই বা আপনি খন্ডাবেন কি করে? ইংলিশ ফুটবলে ছকের মতো পালা করে শাসন করে যাওয়া দু’দলকে আলাদা করার কাজটি আপনার সমর্থনের ওপরই বর্তাবে দিনশেষে। ইংলিশ ফুটবলের সিংহাসনের লড়াইটা তো গেম অফ থ্রন্সের চাইতে কিছুতে কম না!

    আজ যখন ক্লপ-মরিনহো মাঠে নামবেন একে অপরের বিপক্ষে তখন হয়ত এসব ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাবেননা তারা। শুধু জানবেন এই ম্যাচের ফল জয়ভিন্ন অন্যকিছু হলেই চাপে পড়ে যাবেন তাঁরা। এমনকি পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকলেও। পেছনের কারনটা এখন আর অজানা নয় আপনারও! দু’দলের ইতিহাসটাই তাই প্রচ্ছন্ন নায়ক হয়ে থাকবে আরও একটি নর্থ-ওয়েস্ট  ডার্বিতে।