গোলাবারুদ ছাড়াই বাংলাদেশের "যুদ্ধ"?
অসম এক লড়াইয়ে বাংলাদেশ! ১৮৭৭ সালে যখন মেলবোর্নে প্রথম টেস্ট খেলতে নামে ইংল্যান্ড তখন এদেশে ক্রিকেট তো দূরের কথা, জাতি-রাষ্ট্র ধারণাই আসেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশে উড়ল স্বাধীনতার পতাকা, ততদিনে ইংল্যান্ড খেলে ফেলেছে ৪৭২টি টেস্ট। যার ১৮১টিতেই পেয়েছে জয়। আর, টেস্ট ম্যাচে জয়ের জন্য প্রয়োজন যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো প্রতিপক্ষের দশ উইকেট নেয়ার মতো বোলার। দুই দেশের ক্রিকেট ঐতিহ্যের মতো এখানেও রয়েছে আলোকবর্ষের দূরত্ব।
৪২ টেস্টে ১৪৭ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ উইকেটশিকারী সাকিব আল হাসান। ঠিক ১০০ উইকেট নিয়ে তাঁর পেছনে আট বছর আগে টেস্ট থেকে অবসর নেয়া মোহাম্মদ রফিক। তালিকায় এরপরে আছে যে চারজনের নাম আপাতত বাংলদেশের হয়ে তাঁদের খেলার সম্ভাবনা কম। এঁরা হলেন ৩৬ টেস্টে ৭৮ উইকেট নেয়া মাশরাফি বিন মুর্তজা, ৩৮ টেস্টে ৭২ উইকেট নেয়া শাহাদাত হোসেন, ১৫ টেস্টে ৪৪ উইকেট নেয়া এনামুল হক জুনিয়র এবং ১০ টেস্টে ৩৮ উইকেট নেয়া সোহাগ গাজী। ২৭ টেস্টে ৩৭ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সপ্তম সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েছেন একজন ব্যাটিং অলরাউন্ডার, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে যিনি বল করেছেন মাত্র তিন ওভার। বোঝাই যাচ্ছে কাল কেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, “‘গোলাবারুদ না থাকলে পরিকল্পনা করা যায় না। হাতে যা আছে তা দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে। আমরা সে চেষ্টাই করছি।”
গত পাঁচ বছরে মাত্র ২৪টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। এসময় বাংলাদেশের হয়ে বল করেছেন ৩৮ জন খেলোয়াড়। প্রতিপক্ষের উইকেট নেয়া হয়েছে মোট ২৯১টি। ম্যাচে দশ উইকেট নিতে পেরেছেন মাত্র একজনই, তিনি সাকিব আল হাসান। ২০১৪ সালে খুলনায় দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২৪ রানে ১০ উইকেট নিয়ে একাই জিম্বাবুয়েকে ধসিয়ে দিয়েছিলেন এই অলরাউন্ডার। টেস্ট বোলিংয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘বাংলাদেশের প্রাণ’ সাকিব। একজন যোগ্য সঙ্গী পেলে হয়তো লাল বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অনেক গৌরবগাঁথা লিখতে পারতেন ২৯ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার। কিন্তু ক্রিজের অন্য প্রান্ত থেকে তাঁকে সঙ্গ দিতে যে পারেননি কেউই!
গত বছর টেস্টে পেসার হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম পছন্দ ছিলেন মোহাম্মদ শহীদ। ৫ টেস্ট খেলে ৫ উইকেট পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের এই পেসার। তবে নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেংন্থে শহীদের টেস্ট উইকেটের সবক'টিই পাওয়া ক্যারিয়ারের প্রথম দুটি টেস্টে। শেষ দুই টেস্টে কোনো উইকেটই পাননি ২৭ বছর বয়সী শহীদ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টটি ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। ৬ টেস্ট খেলে ৬ উইকেট আল আমিন হোসেনের। আজকের ঘোষিত প্রথম টেস্টের দলে অবশ্য সুযোগ হয়নি এঁদের কারও।
প্রথম টেস্টের দলে জায়গা পেয়েছেন মাত্র দু'জন পেসার : শফিউল ইসলাম ও অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা কামরুল ইসলাম রাব্বি। এঁদের মধ্যে ৮ টেস্টে ১৫ উইকেট শফিউলের। দু'বছর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন শফিউল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ৪টি উইকেট নিয়েছেন। হয়েছেন সিরিজের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।
অবয়বে শফিউলের ঠিক বিপরীত কামরুল ইসলাম রাব্বি। দীর্ঘদেহী এই পেসারকে খুব মনে ধরেছে বাংলাদেশের বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের। ২০০৭ সালে পেসার হান্ট দিয়ে উঠে আসা রাব্বির। সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ১৬ ম্যাচে ২৭ উইকেট নেন বরিশালের এই পেসার। বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ। ওয়ানডে সিরিজের আগে ফতুল্লায় প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন রাব্বি। সে ম্যাচে ১০ ওভার বল করে ৭২ রান দিয়ে ১ উইকেট নেন তিনি। প্রথম টেস্টে সুযোগ পেলে জাতীয় দলে জায়গাটা পাকা করার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবেন ২৪ বছর বয়সী এই পেসার।
অনুমিতভাবেই গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট সাকিবের। ২০ টেস্টে্র ৩২ ইনিংসে বল করে ৬৮ উইকেট নিয়েছেন এই বাঁহাতি স্পিনার। দশ টেস্টে ৩৮ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন সোহাগ গাজী। বোলিং অ্যাকশন শোধরানোর পর যিনি বন্দী রয়েছেন নিজের ছায়ার বৃত্তে। নয় টেস্টে ৩৬ উইকেট নিয়েছেন আরেক বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম। দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করলেও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি ২৪ বছর বয়সী এই স্পিনার। আফগানিস্তান সিরিজে সাদামাটা বোলিংয়ের পর বাদই পড়েছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দল থেকে।
অথচ গত পাঁচ বছরে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বোলারদের পারফরম্যান্স ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ৫৭ টেস্টে ২২৬ উইকেট নিয়েছেন স্টুয়ার্ট ব্রড। ৫৬ টেস্টে ২২৩ উইকেট নিয়ে তাঁর পেছনেই আছেন তাঁর পেস সঙ্গী জেমস অ্যান্ডারসন। ২৪ টেস্টে ১০২ উইকেট নিয়ে তিনে গ্রায়েম সোয়ান। এই পাঁচ বছরে প্রতিপক্ষের ৯৯৭টি উইকেট নিয়েছে ইংলিশ বোলাররা। যা সর্বশেষ পাঁচ বছরে টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলাফলটাও ভালোমতোই যোগ হয়েছে ইংল্যান্ডের ভাঁড়ারে। এই পাঁচ বছরে খেলা ৬১ টেস্টের ২৪টিতেই বিজয়ী দলের নাম ইংল্যান্ড।
র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ঠিক ওপরে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তাদের এখন পরিচিতি ক্ষয়িষ্ণু শক্তির দল হিসেবে। সত্তর আশির দশকের বিশ্বসেরা বোলিংয়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভেতরের মজ্জাটা শুকিয়ে গিয়ে এখন আছে শুধু খোলসটাই। সেই ক্যারিবীয়রাও গত পাঁচ বছরে ৪৫ টেস্টে প্রতিপক্ষের ৫৯২ উইকেট তুলে নিয়েছে। একই সময় নিউজিল্যান্ডের শিকার ৭৬৯ উইকেট, শ্রীলঙ্কার ৭১২ উইকেট, পাকিস্তানের ৬৭২ উইকেট, ভারতের ৭৪৩ উইকেট, দক্ষিণ আফ্রিকার ৭০৭ উইকেট এবং অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের অর্জন ৯৯৬ উইকেট।
টেস্ট বোলিংয়ে উন্নতির জন্য প্রয়োজন নিয়মিত খেলার। মাঠে লড়েই তো গড়ে ওঠে ম্যাচজয়ী বোলার। সেটাই জোটে না বাংলাদেশের। গত বছরের জুলাইয়ের পর আগামী বৃহস্পতিবার প্রথম শুভ্র পোশাকে শোভিত হয়ে মাঠে নামবে বাংলাদেশ দল। অথচ একই সময়ে ইংল্যান্ড খেলে ফেলেছে ১৬টি টেস্ট। পরিযায়ী পাখির মতো মাঝেমধ্যে সাদা পোশাক চাপিয়ে মাঠে নামা নয়, সত্যিকারের টেস্ট দল হয়ে উঠতে হলে বাংলাদেশকে খেলতে হবে নিয়মিত। আর তাহলেই বেরিয়ে আসবে ম্যাচজয়ী বোলার ও ব্যাটসম্যান। লাল বলের ক্রিকেটেও দাপট দেখাবে বাংলাদেশ।