• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    এবার কোন কাণ্ডারি ?

    এবার কোন কাণ্ডারি ?    

    বিশ্বকাপ কি শুধু একটা দল জেতে? অধিনায়কও কি জেতে না?  ৯৯ এর বিশ্বকাপ বললে যেমন স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার কথা মনে পড়বে, ২০০৩  বিশ্বকাপ বললে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে রিকি পন্টিংকে এক ব্র্যাকেটে রাখতেই হবে।  আবার ১৯৯২ বিশ্বকাপ যেমন ইমরানময়। অধিনায়কের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকাপের এই ব্যবচ্ছেদ করেছেন শেখ মিনহাজ হোসেন

     

     

    বিশ্বকাপ কে জিতবে? কারা জিতবে না জিজ্ঞেস করে কে জিতবে প্রশ্নটাই মনে হয় বেশি যৌক্তিক। কারণ ইতিহাস বলে বিশ্বকাপ হাতে নিতে হলে নেতা হতে হয়!

     

     

    ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিভার অভাব কোনদিনই ছিল না; অবশ্য এখনো নেই। ওদের একটাই সমস্যা। ওরা কখনোই এক দেশ নয়। এজন্যে দেশের জন্যে খেলার প্রেরণাটা এরা পায় না। আজকের টি-টুয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজ লীগগুলো আসার পরে পুরো ব্যাপারটা প্রকাশ হয়েছে খুব নগ্নভাবে। সুনীল নারাইনের মতো মতো খেলোয়াড়েরা টাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু খেলোয়ারদের মধ্যে এই জিনিসটা অনেক আগে থেকেই ছিল। ড্যারেন গঙ্গা তো একবার বলেই ফেলেছিলো যে, সে ত্রিনিদাদের হয়ে টেস্ট খেলতে চায়! খোদ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা লারাকে এই বলে দোষ দেয় যে, সে কখনো দলটাকে এক সূত্রে গাঁথতে পারেনি।

     

     

    ক্লাইভ লয়েডের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল এই জায়গাটায়। ফ্র্যাংক ওরেলের হাত ধরে শুরু, তারপর লয়েডই পেরেছিলেন তারকায় ঠাসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেতা হতে। ভিভ রিচার্ডস একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, লয়েড না থাকলে তিনি কখনো তার নির্ভার খেলা খেলতে পারতেন না। খুনে বোলারদের হাতে বল দিয়ে লয়েড বলতেন, “শেষ করে এসো!” '৭৫ আর '৭৯ বিশ্বকাপ তো তাঁর হাতেই গেলো। '৭৫ বিশ্বকাপ ফাইনালে তো সেঞ্চুরি করে পথ দেখিয়েছিলেন দলকে। আদর্শ নেতা একেই বলে! 

     

     

    '৮৩ বিশ্বকাপের কথা ধরি। আমার ধারণা কপিল দেবের বিশ্বকাপটা প্রাপ্য ছিল বলেই ওই সময়ের পুঁচকে ভারত বিশ্বকাপটা জিতেছিলো। ক্রিকেট বিধাতারও হয়তো তা-ই ইচ্ছে ছিলো। জিম্বাবুয়ের সাথে ম্যাচে ভারতের মাত্র ১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিলো! কপিল একাই খেললেন ১৭৫ রানের রূপকথা। দলের সামনে এভাবে উদাহরণ সৃষ্টি করে বললেন, "এবার তোমরা করে দেখাও!" ভারত জিতলো বিশ্বকাপ।

     

     

    আজকের সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিলো অ্যালেন বোর্ডারের হাত ধরে। ওদের অ্যাওয়ার্ড নাইটে বছরের সেরা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারের পুরষ্কারের নাম "অ্যালেন বোর্ডার পদক"! যে মানুষটার হাত ধরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সাম্রাজ্যের সূচনা সে মানুষটার হাতে বিশ্বকাপটা না গেলে খুব খারাপ হতো।

     

     

    '৮৩ বিশ্বকাপ আর '৯২ বিশ্বকাপের কাহিনী একই। কপিল দেব জিতেছেন আর ইমরান খান জিতবেন না? সেটা কি হয়? '৯২ বিশ্বকাপে ইমরানের কাণ্ডটা তো ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে গেছে আজীবনের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার সাথে জীবন মরণ ম্যাচে টস করতে নামলেন ইমরান। পরনে পাকিস্তানের জার্সি ছেড়ে একটা বাঘের ছবিওয়ালা টি শার্ট পড়া। চ্যাপেল জিজ্ঞেস করলেন, "ইমরান এইটা কী?" ইমরান বললেন, "আমি আমার ছেলেদের বলেছি যে এখন আমরা কোণঠাসা বাঘ। এখন শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়!" জন্ম হলো "কর্ণারড টাইগারস" এর! ওয়াসিম আকরামকে ইমরান বলেছিলেন, "নো বল নিয়ে ভাবার দরকার নেই। তুমি শুধু জোরে বল করো!" ওয়াসিম হলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। ভুলটা করেছিলেন শুধু বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে ক্যান্সার হাসপাতাল নিয়ে কথা বলে। তবে সেই বিশ্বকাপটা ইমরান বাদে আর কারও হাতে মানাতো না।

     

     

    '৯৬ এ আসি। শ্রীলংকার জন্য রানাতুঙ্গা কি সেটা নতুন করে বলার দরকার নেই। '৯২ এ মুরালিকে যখন অস্ট্রেলিয়ায় নো বল ডাকা হয়েছিলো তখনই অস্ট্রেলীয়দের সামনে পুঁচকে শ্রীলংকাকে নিয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজের ডাকাবুকো মানসিকতাটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। জয়াসুরিয়া নিচের দিকের ব্যাটসম্যান ছিলেন। তাকে ওপেনার বানিয়ে বলে দিলেন, "পরের দশ ম্যাচে শূন্য রানে আউট হলেও তুমি দল থেকে বাদ পড়বে না! তুমি শুধু ওদের বোলিংকে এলোমেলো করে দিয়ে এসো।" চিন্তা করে দেখেন, একজন খেলোয়াড় অধিনায়কের মুখে এই কথা শুনলে কতটা নির্ভার হয়ে খেলতে পারে! জন্ম নিলো ইতিহাস সৃষ্টিকারী জয়া-কালু জুটি! শ্রীলংকার সব স্বপ্নের সারথী ওই অর্জুনা আর অরবিন্দ। '৯৬ এর বিশ্বকাপ ফাইনালের জয়ের মুহূর্তে তাদের আলিঙ্গনই হয়তো ক্রিকেট বিধাতার চাওয়া ছিল। এর চেয়ে বেশি নিখুঁত ছবি দিয়ে তো বিশ্বকাপ শেষ হতে পারতো না।

     

     

    বোর্ডার-টেলর যুগে অস্ট্রেলিয়া ভালো হচ্ছিলো। কিন্তু স্টিভ ওয়াহর সময়েই ওরা অপরাজেয় বিশ্ব রেকর্ড গড়তে শুরু করেছিলো। নেতা হিসেবে আদর্শ। অসাধারণ টিম কম্বিনেশন পেয়েছিলেন সত্যি। কিন্তু টানা হেরে একেবারে জীবন-মরণের ম্যাচে সাউথ আফ্রিকার সাথে ম্যাচে সেঞ্চুরি করে দলকে সেমি ফাইনালে তুলেছিলেন তো স্টিভ একাই! পুরো দলকে উজ্জীবিত করতে ক্যাপ্টেনের এমন একটা ইনিংসের পরে আর কী লাগে? সাথে গিবসের ক্যাচ ধরার মুহূর্তে বলা ওই মিথ, "তুমি তো বিশ্বকাপটাই হাত থেকে ফেলে দিলে!" খাদের কিনারায় থাকা অস্ট্রেলিয়াকে তাতিয়ে দিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ একাই। '৯৯ বিশ্বকাপটা তিনি না জিতলে কে জিততো বলেন?

     

    '০৩-'০৭ বিশ্বকাপ নিয়ে আসলে কিছু বলার নেই। ওই অস্ট্রেলিয়াকে কেউ হারাবে এই মানসিকতাও কোনো দলের ছিল না। অপরাজিত চ্যাম্পিয়নই হয়েছিলো দুইবারই। তবে অধিনায়ক পন্টিংয়ের কৃতিত্ব তো ছিল অবশ্যই। '০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্যাপ্টেন্স নকটা তো তার কাছ থেকেই এসেছিলো।

     

    '১১ বিশ্বকাপে আসি। টেস্টে যেমনই হোক না কেন, ভারতের ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে মাহেন্দ্র সিং ধোনির কোন বিকল্প একেবারেই নেই। '০৭ বিশ্বকাপের পরে বিপর্যস্ত ভারতকে প্রথমে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতালেন। দলকে একতাবদ্ধ রেখেছেন সবসময়। ঠান্ডা মাথার ধোনি সাফল্য পেয়েছেন সব বড় আসরে। স্টিভ ওয়াহ পর্যন্ত তার সেরা ওয়ানডে একাদশের অধিনায়ক ধোনিকেই রাখতে চান। '১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্যাটিং এ নিজেকে উপরে উঠিয়ে এনেই ৯১ রানের অধিনায়কের ইনিংস খেলেই বিশ্বসেরা হয়েছিলেন। ধোনির মতো নেতার বিকল্প ভারত এখনো পায়নি।

     

    এতক্ষণ শুধু সাফল্যের গল্প বলা হলো। উল্টোটাও কি নেই? আছে অবশ্যই। প্রথম যে অধিনায়ক প্রাপ্য বিশ্বকাপটা ধরতে পারেননি তিনি নিউ জিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো! তবে সেবার বিশ্বকাপে হাত ছুঁয়েছিলেন ইমরান খান। কাকে ফেলে কাকে রাখবেন? বিধাতাকে তো একজনের দিকে তাকাতেই হতো! '৯৬ এও মার্ক টেলরের প্রাপ্য ছিল বিশ্বকাপটা। অ্যালেন বোর্ডার যে পিলার বানিয়ে দিয়েছিলেন তাতে ইট গেঁথেছিলেন মার্ক টেলর। অনেকগুলো নতুনের জন্মও দিয়েছিলেন তিনি। কলংকটা শুধু বিশ্বকাপ জিততে না পারায়।

     

    '৯৯ এ হানসি ক্রনিয়েকে তো পড়তে হলো সাউথ আফ্রিকান চোকের ট্র্যাজেডিতে। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিলেন বোধহয় সৌরভ গাঙ্গুলী! বিদেশের মাটিতে ভারতকে জিততে শিখিয়েছিলেন সৌরভ। ২০০০ সালে সৌরভ যখন ভারতের দায়িত্ব নেন তখন দলটার পর্যদুস্ত অবস্থা। মাত্রই আজহারউদ্দীন আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন ম্যাচ পাতানোর দায়ে। তখন পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে ১৫৮ টেস্ট খেলে ভারতের জয় মাত্র ১৫টিতে। এই ভারতকে জিততে শেখালেন সৌরভ। '০২ এ ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে খালি গায়ে জার্সি ঘোরানোর দৃশ্য তো ক্রিকেটের চিরকালীন ফ্রেমের এক ছবি। হরভজন, যুবরাজ, জহির, নেহরাদের মতো তরুণদের দিনের পর দিন ব্যাক আপ দিয়ে ২০০৩ বিশ্বকাপে নিয়ে গেলেন। কেউই কল্পনা করেনি যে ওই ভারত ফাইনালে যেতে পারে। বিশ্বকাপটা ধোনির চেয়ে বোধহয় সৌরভের হাতেই বেশি শোভা পেতো। পারেননি ফাইনালে পন্টিং এর অতিমানবীয়তার কাছে। ব্যর্থদের মধ্যে আর মনে পড়ছে স্টিভেন ফ্লেমিং আর গ্রায়েম স্মিথের নাম।

     

     

    সব খেলার মধ্যে ক্রিকেট ক্যাপ্টেনদের কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। ফুটবল, হকিতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটা সম্মানের জায়গা। কিন্তু ক্রিকেট এই জায়গায় অনন্য। পিচ দেখে টস জয় করে ব্যাটিং/বোলিং নেয়া থেকে শুরু করে, ফিল্ডিং সাজানো, ক্ষণে ক্ষণে বোলিং পরিবর্তন, ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা মাঠের মধ্যেই এতো কাজ ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ছাড়া আর কারও থাকে না। সাথে পুরো দলকে উজ্জীবিত করবার ব্যাপারটা তো আছেই। ক্রিকেটের অধিনায়কের মতো এতো ঝক্কি-ঝামেলা কাউকে পোহাতে হয় না।

     

    এবারের বিশ্বকাপটা কে জিতবে বলে লেখাটা শুরু হয়েছিলো। যেহেতু এবার '০৩, '০৭ এর মতো সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া নেই সেহেতু এবারের অধিনায়কগুলোর দিকে তাকানোই যায়।

     

    টেস্ট দলের মধ্যে ক্লার্ক, মরগান, হোল্ডার, ম্যাককালাম, ডি ভিলিয়ার্স, ধোনি, মিসবাহ, ম্যাথুজ, মাশরাফি, চিগাম্বুরা। নামগুলো দেখেই ক্লার্ক, ম্যাককালাম, ভিলিয়ার্স, ধোনি, মিসবাহ, মাশরাফিকে আলাদা করা যায়। এর মধ্যে ভারতের বর্তমান অবস্থা আর ধোনির হাতে একবার কাপ গিয়েছে এইসব সমীকরণে ভারতকে বাদ দেয়া যায়।

     

    তালিকায় মাশরাফির আগমন সত্যিকার অর্থেই এই দলের নেতা হবার কারণে। "পাগলা" অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ দলের নেতা। ড্রেসিংরুমে ও থাকলে পরিবেশটাই অন্যরকম হয়ে যায় এই কথা খেলোয়াড়েরাই স্বীকার করে। দলকে উজ্জীবিত করতে তার কোন বিকল্প নেই। বাস্তবতার মধ্যে অনেক ফারাক থাকলেও মাশরাফির কথা বলতে গিয়ে নিজের আবেগ আর স্বপ্নও কাজ করেছে!

     

    এবারে বাকি চারটা নাম দেখেন। ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তানকে অনেকদিন ধরেই এক করে রেখেছে মিসবাহ একা। ম্যাচ পাতানো থেকে শুরু করে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বসহ নানা ঝড়-ঝাপটায় মিসবাহের ঠান্ডা মাথা আর ব্যক্তিত্ত্ব অনেক বড় ব্যাপার। এমনকি পাকি ট্র্যাডিশন ছেড়ে ইউনিস, আফ্রিদি বিনা দ্বিধায় মিসবাহকে নেতা মানে। অস্ট্রেলিয়ান সাম্রাজ্যের একমাত্র প্রতিনিধি মাইকেল ক্লার্ক। নেতা হিসেবে হয়তো তাকেই বেশি মানায়। সাউথ আফ্রিকা দল হিসেবে ভালো হলেও ডি ভিলিয়ার্স সে অর্থে এখনো নেতা হননি। নেতাদের মধ্যে সেই হয়তো দুর্বল। নিউ জিল্যান্ড দল হিসেবেও ভালো আবার ফিলিপ হিউজের মৃত্যুর পরে ম্যাককালামের নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটীয় স্পিরিট যেভাবে প্রকাশ করেছিলো তাতে ব্রেন্ডন যে অনেক উচ্চ পর্যায়ের নেতা সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে!

     

    নেতার হিসেবে আমার শেষ তিন বাজি ক্লার্ক, মিসবাহ আর ব্রেন্ডন। আর মাশরাফি তো আছেই।

     

    আমার কথা আমি বললাম। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে।