তবে শুরু হোক...
হয়তো ফুটবল বিশ্বকাপের মতো উত্তাপ নেই, চৌদ্দ জাতির টুর্নামেন্টে তেমন কিছু আশা করাও বোধহয় বাহুল্য। কিন্তু সীমিত গণ্ডির সে বিশ্ব লড়াইয়ে যখন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার সাথে বাংলাদেশও অংশগ্রহণকারীর তালিকায় তখন গোটা দুনিয়ার বিচারে উপমহাদেশের চিত্র অঙ্কনের সুযোগ নেই। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মাস দেড়েকের জন্য বাইশ গজের উইকেট হবে সেরা নির্ধারণের মঞ্চ। সে মঞ্চ চমকাবে তারাদের আলোয়, দোলা দেবে নতুনের কেতন... হাসি-কান্নায়, উল্লাস-হাহাকারে, আনন্দ-বেদনায়, হরিষে বিষাদে আবেগের রকমারি রূপ বদলাবে প্রতি বলে, প্রতি রানে। আসর শেষে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির হিসেব কারও মিলবে, কারও জন্য আরও চার বছরের অপেক্ষা হয়ে থাকবে। বসন্তের মাতাল সমীরণ আর ভালোবাসা দিবসের গোলাপ সঙ্গী করে ব্যাটবলের দ্বৈরথ দুয়ারে হাজির। ক্রীড়াপ্রেমী, ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের জন্য ফাগুনের শুরুতে এরচেয়ে ভালো উপহার আর কিইবা হতে পারে?
স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলংকা ম্যাচ দিয়েই মাঠে গড়াচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের একাদশতম আসর। ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলে ওভালে ম্যাককালাম, ম্যাথিউসরা যখন প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন , বাংলাদেশের ঘড়ির কাঁটা তখন ভোর চারটে ছোঁবে।
গতবারের রানার আপদের সাথে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা কিউইদের দ্বৈরথ ঠিক কতোটা জমবে? তাত্ত্বিক বিচারে ম্যাচের ‘ভোল্টেজ’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক রেকর্ড কি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে? বোদ্ধামহলের বিশ্লেষণ থেকে চলুন একটু ধারণা নেয়া যাক। তার আগে চলুন একটু ফিরে দেখি...
মুখোমুখি নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলংকা
বিশ্বকাপের মাঠে ১৯৭৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯ বার মুখোমুখি লড়াইয়ে নিউজিল্যান্ড জিতেছে ৩ বার, বাকি ৬ বারেই জয় ছিল শ্রীলংকার। ২০০৩ আসর থেকে এ পর্যন্ত খেলা ৫টি ম্যাচের সবক’টিতে জয় পায় লঙ্কানরা। তবে সব ধরণের টুর্নামেন্টে এ যাবত ৮৯টি একদিনের আন্তর্জাতিকে মুখোমুখি হয়ে নিউজিল্যান্ড জিতেছে ৪১টি, শ্রীলংকা জিতেছে ৪০টি, টাই হয়েছে ১ টি আর অমীমাংসিত ছিল ৭টি ম্যাচ। জানুয়ারিতে ক্রাইস্টচার্চে দু’ দলের এখনও পর্যন্ত একমাত্র লড়াইটি নিউজিল্যান্ড জিতে নেয় ৩ উইকেটে।
দুই শিবিরে এক ঝলক
নিউজিল্যান্ড
কিউইরা বছরটা শুরুই করেছে শ্রীলংকাকে ঘরের মাঠে ৪-২ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়ে। অতঃপর পাকিস্তানের বিপক্ষেও দুটো ম্যাচেই জয়... বিগত এক বছরের নিউজিল্যান্ডকে নিকট অতীতের সাথে ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। ঘরে-বাইরে এমন ধারাবাহিকতা ব্ল্যাকক্যাপরা বহুদিন পায় নি। সেজন্যেই কিনা সাবেক তারকাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি। কারও চোখে এটাই নিউজিল্যান্ডের এ যাবতকালের সেরা স্কোয়াড, কেউবা বলছেন নিউজিল্যান্ড এবার ফাইনাল খেলবেই!
ব্যাটিং লাইন আপে অভিজ্ঞ ম্যাককালাম, উইলিয়ামসন, রস টেলরদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। সে তালিকায় লুক রঙ্কি, মার্টিন গাপ্টিল আর অল-রাউন্ডার কোরি অ্যান্ডারসনের মতো নামগুলো যোগ হলে রানের চাকায় লাগাম দেয়া কতোটা কঠিন হতে পারে তা প্রতিপক্ষ বোলারমাত্রই বোঝেন।
পেস আক্রমণে কাইল মিলস, টিম সৌদি, ট্রেন্ট বোল্ট, অ্যাডাম মিলনে, মিশেল ম্যাকলেনাগান...বিধ্বংসী বোলিং লাইন আপ গঠনে এদের যে কাউকে বেছে নিতে পারেন নির্দ্বিধায়। আর ঘূর্ণি বলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ডেনিয়েল ভেট্টরি আর নাথান ম্যাককালাম তো থাকছেনই।
শ্রীলংকা
লঙ্কান ক্রিকেটে এতোটা বাজে সময় শেষ কবে গিয়েছে বলা কঠিন। ‘৯৬-এর চ্যাম্পিয়ন আর দুইবারের রানার আপদের নিয়ে খুব ভালো কিছু আশা করার সুযোগ অন্তত সাম্প্রতিক রেকর্ড দিচ্ছে না। একের পর এক সিরিজ হারা ম্যাথিউসদের পরাজয় পিছু ছাড়ে নি বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতেও, এমনকি হার মানতে হয়েছে দুর্বল জিম্বাবুয়ের কাছেও! এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের দলটায় শনির ভর বজায় থাকলে বরং খারাপ কিছুর শঙ্কাই বেশী থেকে যাচ্ছে।
কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনেরা এ আসর থেকেই সব ধরণের ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন। নামের ওজন সঙ্গি করে দলে আছেন তিলকরত্নে দিলশানও। অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস বহু ম্যাচে বিপর্যয়ের মুখে দলের হাল ধরেছেন। প্রথম ম্যাচে লাসিথ মালিঙ্গার নিশ্চিত অংশগ্রহণ কিছুটা হলেও স্বস্তি আনবে লঙ্কা শিবিরে। তাঁর সাথে নুয়ান কুলাসেকারা, থিসারা পেরেরা পেস আক্রমণে সঙ্গী হবেন। ঘূর্ণি বলে অভিজ্ঞ রঙ্গনা হেরাথ কতোটা সাফল্য পাবেন বলা কঠিন।
চোখ রাখুন...
কেন উইলিয়ামসন
দু’দিন আগে এই ক্রাইস্টচার্চেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে করেছেন ৬৬ রান। দারুণ ছন্দে থাকা ২৪ বছর বয়সী এই কিউই ব্যাটসম্যান সর্বশেষ সাতটি একদিনের ম্যাচে করেছেন দুটো শতক আর তিনটি অর্ধশতক! গেলো বিশ্বকাপে চারটি ম্যাচ খেললেও সেভাবে রান পান নি। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের শুরুটা স্মরণীয় করে রাখতে উইলিয়ামসন মুখিয়েই থাকবেন।
কুমার সাঙ্গাকারা
চলতি নিউজিল্যান্ড সফরে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার ভিড়ে ব্যক্তিগত সাফল্যে এগিয়ে আছেন তিনিই। কিউইদের বিপক্ষে সর্বশেষ ওডিআই সিরিজের শেষ ম্যাচে অপরাজিত ১১৩ রান করে দলের জয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। এর আগের ডদু’ ম্যাচেও রান পেয়েছেন সত্তর-আশির ঘরে। ২১টি শতক, ৯৩টি অর্ধশতকে ১৩ হাজার ৬৯৩ ওডিআই রানের মালিকটিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া বাহুল্য। লঙ্কান ক্রান্তিকাল কাটাতে সাঙ্গার ব্যাটে রানের বিকল্প কমই আছে।
উইকেটে একনজর
সোয়াশ’ বছরের পুরনো হ্যাগলে ওভাল একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের মুখ দেখেছে বছরখানেক হল। এ পর্যন্ত ১টি টেস্ট আর ৩টি ওডিআইয়ের ভেন্যুর উইকেট সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তাই জানানো যাচ্ছে না। এ মাঠে নিউজিল্যান্ড-শ্রীলংকার সর্বশেষ ম্যাচটির দিকে ফিরে তাকালেও খুব বেশী তথ্য মিলছে না। নিউজিল্যান্ডের পক্ষে বাঁহাতি পেসার মিশেল ম্যাকলেনেগান যেমন ৪টি উইকেট নিয়েছেন, শ্রীলংকার পক্ষে ঘূর্ণি বলে সাফল্য পেয়েছিলেন সেনানায়েকে, দিলশানরা। তবে সংক্ষিপ্ত রেকর্ড আর আবহাওয়া বিপর্যয়ের শঙ্কা আমলে নিলে টস জেতা অধিনায়ক সম্ভবত প্রথমে ফিল্ডিংই করতে চাইবেন।
সম্ভাব্য একাদশ
নিউজিল্যান্ডঃ মার্টিন গাপ্টিল, ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম (অধিনায়ক), কেন উইলিয়ামসন, রস টেলর, গ্র্যান্ট এলিয়ট, লুক রঙ্কি (উইকেট রক্ষক), কোরি অ্যান্ডারসন, ডেনিয়েল ভেট্টরি, টিম সৌদি, অ্যাডাম মিলনে, ট্রেন্ট বোল্ট
শ্রীলংকাঃ তিলকরত্নে দিলশান, লাহিরু থিরামান্নে, কুমার সাঙ্গাকারা (উইকেটরক্ষক), মাহেলা জয়াবর্ধনে, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস (অধিনায়ক), দিমুথ করুণারত্নে, জীবন মেন্ডিস, রঙ্গনা হেরাথ, লাসিথ মালিঙ্গা, থিসারা পেরেরা, নুয়ান কুলাসেকারা
দলপতিদের বয়ানে
“অবশ্যই আমার চোখে এটা আমাদের সেরা দল। অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের চমৎকার একটা সমন্বয় আমরা পেয়েছি। আশা করি সুযোগটুকু কাজে লাগাতে পারব।” -ব্র্যান্ডন ম্যাককালাম, নিউজিল্যান্ড।
"কঠিন ম্যাচ হবে, সমানে সমান লড়াই হবে। নিজেদের সেরাটা যারা দিতে পারবে জয় হবে তাঁদেরই।” -অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস, শ্রীলংকা।