• ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ সিরিজ
  • " />

     

    সাক্ষী ছিলেন তাঁরা দু'জনও

    সাক্ষী ছিলেন তাঁরা দু'জনও    

    ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতে মোবাইল ফোন। সাংবাদিকের অভিনন্দনের জবাব দিয়ে জিজ্ঞাসা, ‘আমাদের ছবি যেন কোনদিকে তোলা হচ্ছে?’ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়ের পর একটা ‘অফিশিয়াল ফটোসেশন’ হচ্ছে বাংলাদেশ দলের। সাকিব আল হাসান যাবেন সেখানেই। সাকিবের এটি প্রথম টেস্ট জয় নয়।

    মুশফিকুর রহিমের বাবা দাঁড়িয়ে আছেন গ্যালারিতে। মুশফিক একটু আগে সেখানে থেকে এসে ড্রেসিংরুমে ঢুকেছেন। এরপর গেলেন তামিম ইকবাল। হাত ধরে, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বললেন। গ্যালারি থেকে আসা সম্বোধনের জবাব দিলেন ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে। তামিমেরও এটি প্রথম টেস্ট জয় নয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় বাদ দিলে, এর আগের ছয়টি জয়েই ছিলেন তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান।

     

    কিন্তু এমন জয়ে তো ছিলেন না!

     

    ***

    ডুনেডিন, নিউজিল্যান্ড। টেস্ট অভিষেক হয়ে গেল বাংলাদেশের তরুণ ওপেনারের। প্রথম ইনিংসে করলেন ৫৩, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪। অবশ্যই দুই ইনিংসেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ হারলো ৯ উইকেটে। তামিম ইকবাল হয়তো বুঝে গেলেন, ওয়ানডেতে সাফল্য পেলেও টেস্ট সুদূরের আকাশ, পারফর্ম একাই করলেই তো আর টেস্ট জেতা যাবে না!

     

    সাকিবের অভিষেক দেশের মাটিতেই। চট্টগ্রামে। ভারতের সংগে সে ম্যাচটা অবশ্য ড্র হয়েছিল, বৃষ্টির বদৌলতে। প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য ছিলেন, করেছিলেন ২৭ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং বা ব্যাটিং, কোনোটাই পাননি! ড্র, অন্তত পরাজয়ের থেকে তো ভাল!

     

    ***

    তামিমের এমনিতে টেস্টে ব্যাটিং গড় ৪০। বাংলাদেশের জেতা ম্যাচগুলোতে তা হয়ে যায় পঞ্চাশের ওপরে! ৮টি সেঞ্চুরির ৪টিতে জয়, ড্র একটিতে।

    সাকিবের ব্যাটিং গড় ৩৯ থেকে ৪৬ হয়ে যায়, যখন বাংলাদেশ জেতে। ১৫৯টি উইকেটের ৪০টি পেয়েছেন ৭ ম্যাচ। নিজের ক্যারিয়ারসেরা বোলিংটাও হারা ম্যাচে!

     

    ***

    চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশ লিড দেখছে। দিনের দ্বিতীয় বলেই মঈন আলিকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মারতে চাইলেন সাকিব। কেন? কে জানে! হয়তো স্নায়ুর চাপে। হয়তো কোনো পরিকল্পনা ছিল। কিংবা ভাবা যায়, সাকিব এমনই। সাকিব ব্যাটিং করেন এভাবেই। সাকিব কথা বলেন এভাবেই। কিন্তু সবসময় কি এসব ভাবেন কেউ? মুন্ডুপাত কি থেমে থাকে! নাহ। সাকিবের মুন্ডুপাত চললো। বাংলাদেশের লিড পাওয়া হলো না, অনেক ‘ওপরের’ ইংল্যান্ডকে অনেক কাছে পেয়েও যেন বাগে আনা গেল না! অনেক কাছের জয়টা চলে গেল কতোদূরে! সাকিব সে ম্যাচেও ৫টা উইকেট নিলেন ইনিংসে, মোট ৭টা পেলেন ম্যাচে। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেল যেন সেই আউট! সাকিব কি পুড়েছিলেন হতাশার আক্ষেপে? পুড়তেই পারেন। কিংবা সাকিব বলেই ভাবা যায়, সাকিব এতোকিছু ভাবেন না।

     

    তামিম সেই টেস্টেই নিজের ‘স্বভাববিরুদ্ধ’ একটা ইনিংস খেললেন। উইকেটকে বুঝলেন, রইলেন খোলসের ভেতরে। উইকেটটা সহজে দিলেন না প্রথম ইনিংসে। তাঁর অমন ইনিংসে ভর করেই না সাকিবের জন্য এতো আক্ষেপ! তামিম দ্বিতীয় ইনিংসে পারলেন না প্রথম ইনিংসের মতো করে। ম্যাচশেষের হতাশাটাও কি সাকিবের মতোই! নিজের মতো করে খেললেও দল জেতে না, স্বভাববিরুদ্ধ ইনিংস খেললেও দল জেতে না। দল তাহলে জেতে কখন!

     

    ***

    লর্ডস, লন্ডন। তামিম ইকবালের সেই উদযাপনটা মনে আছে? ভোলার কথা নয়। দুহাতে বোর্ড আঁকলেন, অনার্স বোর্ড। জার্সির পেছনে হাত দিয়ে নামটা লিখতে বললেন সেখানে। জ্বর নিয়ে খেলেছিলেন। অনার্স বোর্ডে দুই ইনিংসে ফিফটি করলে নাম তোলা যায় কিনা, জিজ্ঞাসা করেছিলেন সেটাও! কিন্তু সেঞ্চুরির ব্যত্যয় হলে তো হবে না! তামিম করলেন। রোমাঞ্চিত হলো বিশ্ব। চার মেরে সেঞ্চুরি। কিন্তু বাংলাদেশ? তামিমের ইনিংসটাই তো ফলো-অনে। তাঁর আগে পরে আর কিচ্ছু নেই!

     

    এরপর ওল্ড ট্রাফোর্ড। বিরুদ্ধ কন্ডিশন। শুধু তামিম কেন, বিশ্বের নামজাদা সব ব্যাটসম্যানদের জন্যই! কিন্তু ওল্ড ট্রাফোর্ডের সাথে তামিমের একটা ‘দেনা-পাওনা’ ছিল, কেভিন পিটারসেনের সংগে। কেপি তামিমকে ঢাকা আর চট্টগ্রামে ভাল খেলতে দেখে বলেছিলেন, ‘পারলে ওল্ড ট্রাফোর্ডে’ সেঞ্চুরি করে দেখিও!’ তামিম অবশ্য তখন জানতেন না, ফিরতি সিরিজে ওল্ড ট্রাফোর্ডে আদৌ টেস্ট আছে কিনা! তামিম সেখানেও খেলেছিলেন, নিজের মতো করেই। কিন্তু দল? তামিমের আফসোস বাড়িয়ে কী লাভ বলুন!

     

    ***

    জেমি সিডন্স হঠাৎ বলে বসলেন, সাকিব খেলবেন বিশেষজ্ঞ বোলার হিসেবে। তার আগ পর্যন্ত সাকিব যতোটা না বোলার ছিলেন, তার চেয়ে বেশী ছিলেন ব্যাটসম্যান! সিডন্সের কথাতে হোক, আর যে করেই হোক, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পেয়ে গেলেন ৭ উইকেট! এখন পর্যন্ত তাঁর ক্যারিয়ারসেরা বোলিং! কিন্তু চট্টগ্রাম সেবারও একগাদা আক্ষেপ দিয়েছিল, জেতার সম্ভাবনা জাগিয়েও হারতে হয়েছিল তিন উইকেটে!

     

    সাকিব অবশ্য ‘নায়ক’ ছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘দ্বিতীয় সারির’ দলের সংগে সিরিজ জয়ে। যে সিরিজে হঠাৎ করে ফেবারিট হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশই, হঠাৎ করে অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন সাকিব। সাকিব নায়ক ছিলেন জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও। কিন্তু ওই যে, ‘বড়’ কোনো দলের সংগে টেস্ট না জেতার ‘আফসোস’! তামিমের মতো ছিল তো সাকিবেরও!

     

    ***

    তামিম খেললেন, তামিমের মতো করেই। ইংল্যান্ডের সঙ্গে তৃতীয় সেঞ্চুরি। তামিমের রান ১০৪। দলের রান? ২২০! ৪৯ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ রীতিমতো ধ্বসে গেল, যেন একা একাই! তামিম তবুও এ সেঞ্চুরিটাকে ‘বিশেষ’ কিছু বললেন, তিনি যে নিজের মতো করে খেলেছেন! কে জানে, তখনও হয়তো, আবার ‘ব্যর্থ’ সেঞ্চুরির আক্ষেপ তাড়া করে ফিরছিল তাঁকে!

    তবে দ্বিতীয় ইনিংসেও তামিম খেললেন নিজের মতো করেই। সাত চারে ৪০ রান। উইকেটে টিকে থাকতে হলে রান করতে হবে, বুঝে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও, এবারও কাছে এসে দূরে যাওয়ার গল্প যেন লেখা হচ্ছিল!

    সাকিবও সে ইনিংসে করলেন ৪১ রান। তবে সাকিব, সাকিব হয়ে উঠলেন বোলিংয়ে। ব্রেকথ্রু এনে দিলেন মিরাজ। আর চেপে ধরলেন সাকিব। বেন স্টোকসকে বোল্ড করা বলটা যেন মনে করিয়ে দিল সেই পুরোনো সাকিবকে। উদযাপনে থাকলো ভিন্নতা। তামিমের উদযাপনেও থাকে যেমন!

    শেষটা হলো ‘নতুন’ মিরাজকে দিয়েই। সেখানে সাকিব থাকলেন না, তামিম থাকলেন না।

     

    ***

     

    শেষে না থাকলে কি হবে! সাকিব-তামিম তো ছিলেন। বাংলাদেশের পরাজয়গুলোতে। বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় সারি’র বা ‘খর্বশক্তি’র দলগুলোর সঙ্গে জয়গুলোতে।

    এবং হ্যাঁ। এ জয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা সাফল্যে।

    বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন দিনের বিজ্ঞাপন তাঁরা।

    এমন সময়ে তাঁরা না থেকে কি পারেন!