"বাংলাদেশের জয় ক্রিকেটেরই জয়"
ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের জয়টা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন ক্রিকেট লেখক ক্রিস স্টোকস। প্যাভিলিয়নের পাঠকদের জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটে তাঁর সেই লেখাটিই হুবুহু অনূদিত হলো।
মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের দ্বারে তখন একদল স্কুল ছাত্র ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আগ্রহভরে তাকিয়ে ছিল মাঠের দিকে।
মেহেদী হাসান মিরাজ যখন স্টিভেন ফিনের উইকেট তুলে নিলেন তখন মাঠের উদযাপন সংক্রমিত হলো গ্যালারির হাজারো মানুষের মধ্যে। বুনো আনন্দ ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়লো আশেপাশের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর ছাদে জড়ো হওয়া অগুণিত শিশুদের মাঝেও। খাপছাড়া নৃত্যের উদ্দাম প্রকাশে স্বাগত জানানো হলো নতুন এক ইতিহাসকে।
বাংলাদেশের এই জয় যা আসলে জিম্বাবুয়ে কিংবা দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া অন্য কারও বিপক্ষে প্রথম, তা সূচনা করেছে ইতিহাসের নতুন পাঠের।
খেলোয়াড়রা সেটা জানতো। জানতো গ্যালারির বাঁধভাঙা জনতা। এমনকি জানতো সেই বাচ্চারা, যারা শেষ বিকেলের এই মাহাত্ম্যপূর্ণ জয়ে শুকিয়ে নিচ্ছিল নিজেদের শরীর।
তিন দিনের ভেতর পাওয়া এই জয়ের প্রভাব অনেকদিন ধরেই অনুরণিত হবে ক্রিকেট বিশ্বের আনাচে-কানাচে। শুনতে যত ক্লিশেই শোনাক না কেন, এই জয় আসলে টেস্ট ক্রিকেটেরই একটা বিশেষ অর্জন।
এই ঘনবসতির দেশে এমন এক জয়ের প্রভাব এই বাচ্চারা ও তাদের মতো লাখো অনেকের মনে কী প্রভাব ফেলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আশা করা যায়, দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ তাদের জন্য অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে এবং এমন কিছুই স্বপ্নে দেখার আশা নিয়ে তারা ঘুমুতে যাবে।
গত কয়েক বছর ধরে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো উন্নতি করেছে। এবার তাঁরা টেস্ট ক্রিকেটের কুলীন রাজ্যেও পা রেখেছে জয়ের ডঙ্কা বাজাতে।
কুলীন বধে বাংলাদেশের সময় লেগেছে ১৬ বছর ও ৯৫টি টেস্ট। কিন্তু এই ম্যাচে তারা যে সামর্থ্য দেখিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পাওয়া জয়ে যে আত্মবিশ্বাসের জোগান এসেছে তাতে নিশ্চিত বলা যায় ওদের আর হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে ঘরের মাঠে তো না-ই।
ভবিষ্যতে টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে এমনই কিছু সিরিজই।
বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড খেলেছে একটা রোমাঞ্চকর সিরিজ। স্বাগতিকরা হয়তো চট্টগ্রাম টেস্ট হেরে গিয়েছিল মাত্র ২২ রানের জন্য। কিন্তু তারা এখানে ফিরে এসেছে নতুন উদ্যমে। সাহস, নৈপূণ্য ও ধৈর্য্যের যুথবদ্ধ প্রয়োগে জিতে নিয়েছে এমন এক টেস্ট ম্যাচ যা পাগলাটে শেষ সেশন পর্যন্ত সমান সমানে হেলে ছিল দুই দলের পাল্লাতেই।
চা বিরতিতে যাওয়ার সময় ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ছিল বিনা উইকেটে ১০০। জয়ের জন্য লক্ষ্য ছিল ২৭৩। এশিয়ায় নিজেদের সর্বোচ্চ রান তাড়া করার জন্য ইংলিশদেরই মনে হচ্ছিল ফেভারিট।
কিন্তু সবকিছু বদলে গেল কত সহজে। দিনের শেষ সেশনের প্রথম বলেই যখন মেহেদী হাসান মিরাজ বোল্ড করলেন বেন ডাকেটকে। সেই শুরু। এরপর ইংল্যান্ড সাক্ষী হল এক ভয়াবহ ধসের যা ২২.৫ ওভারের ভেতর ৬৪ রানে অল আউট করে দিল ইংলিশদের।
এই সিরিজের আগে ১৫ মাস টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় পা রাখেনি বাংলাদেশ। তৃপ্ত অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বলেছেন, এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এক স্মরণীয় মুহূর্ত।”
“গত দুই বছরে আমরা ঘরের মাঠে দারুণ খেলেছি। ঘরের মাঠে সব দলকে হারানো আমাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এখন আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ হলো ওদের বিদেশের মাটিতে হারানো।”
“আপনি আমাদের রেকর্ডের দিকে তাকান। আমি ভেবেছিলাম আমরা আরও টেস্ট খেলার সুযোগ পাবো। আশা করি আমরা আরও ভালো করব এবং শক্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আরও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাব।”
এই সিরিজের অবিসংবাদিত তারকা মেহেদী। অভিষেক সিরিজের দুই টেস্টে ১৯ উইকেট তুলে নিয়ে যে বিশ্ব ক্রিকেটে ঘোষণা করেছে নিজের আগমনী বার্তা।
এর ১২টাই এসেছে ঢাকা টেস্টে। মুশফিকুর বলেছেন, “সে দুর্দান্ত খেলেছে। কেবল তো তার শুরু হলো। সে দারুণ একজন ব্যাটসম্যানও। আশা করি সে বাংলাদেশের একজন দুর্দান্ত অলরাউন্ডারে পরিণত হবে।”
পরাজয়ের পরও বিনীত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক। স্বীকার করেছেন ২০১০ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরের পর দলটি অসাধারণ উন্নতি করেছে।
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই ওরা অনেক এগিয়েছে। তবে শেষবার আমরা একেবারে আলাদা উইকেটে খেলেছিলাম। পিচ ছিল পুরো সমান। বলও তেমন স্পিন করেনি। খেলা পাঁচ দিনে গড়িয়েছিল।”
“ওরা সাহস করে জয়ের কথা ভেবেছে এবং চেষ্টা করেছে। কেন করবে না বলুন? ওদের দারুণ কিছু স্পিনার আছে।”
“বসে থাকা এটা বলা খুব সহজ যে ‘ধুর! এটা বাংলাদেশ’। কিন্তু আসলে স্পিনিং উইকেটের এই কন্ডিশনে তাঁদের বোলাররা দুর্দান্তরকম অভিজ্ঞ। আমি জানি ১৯ উইকেট পাওয়া ছেলেটার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু সে খুব ভালো বোলার এবং এই কন্ডিশনে খেলে অভ্যস্ত। সিরিজটা খুবই কঠিন ছিল।”
আসলে এই সিরিজে বাংলাদেশের স্পিনিং উইকেট বানানোর সিদ্ধান্ত তাঁদের বাড়ন্ত আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন। ওদের এই বিশ্বাস ছিল যে যে জয় মোটেই অসম্ভব নয়।
এই বিশ্বাসটাই সত্যি হয়েছে এক ঐতিহাসিক অর্জনের মাধ্যমে যা দর্শকদের মগজের কোষে অমলিন থাকবে অনেক দিন। বিশেষ করে সেই বাচ্চাদের, যারা ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে চাক্ষুস করেছে এক অতুলনীয় অর্জন।