বুরেওয়ালার বম্বশেলের গল্প
১
নব্বই দশকের শুরুর দিকে কাউন্টি ক্রিকেটে, ব্যাটসম্যানরা পায়ের আঙ্গুল বাঁচাতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। বুক-কান-মাথা বাঁচানোর রক্ষাকবচের মতো তাঁরা বুটজুতার ভেতর, পায়ের আঙ্গুলে পরতে শুরু করেছিলেন এক ধরনের কবচ। যাতে তাদের পায়ের মাথাটা আস্ত থাকে, আঙ্গুলগুলো যেন ভেঙ্গে-টেঙ্গে না যায়!
রক্ষাকবচ না নিয়ে উপায় কি বলুন! তাদের যে তখন সামলাতে হচ্ছিল সারের এক তরুণ ফাস্ট বোলারকে। ঠিক পায়ের বুড়ো আঙ্গুল সই করে দেড়শ কিমির বল নামক এক চর্মগোলক ছুঁড়েন সেই তরুণ, বড় নির্দয়ভাবে। বল তো নয় যেন এক বম্বশেল, কামানের গোলা! হয় পা বাঁচাও, নয় উইকেট দাও।
তরুণের জন্ম পাঞ্জাবের ভিহারীতে। জন্ম, শৈশব, কৈশোর, বেড়ে উঠা সব সেখানেই। শুধুমাত্র ক্রিকেটের টানে, ভিহারী থেকে প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরের বুরেওয়ালাতে ছুটে যেতেন নিজেকে আরো শাণিত করার লক্ষ্যে। সেখানেই হয়তো তালিম নিয়েছিলেন, কিভাবে ব্যাটসম্যানের বুড়ো আঙ্গুল ভাঙতে হয়!
তাঁর বোলিংয়ে মেইল ট্রেনের গতি দেখে ধারাভাষ্যকার ‘চিশতী মুজাহিদ’ তাকে ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘বুরেওয়ালা এক্সপ্রেস’ বলে। পরে যখন গতি মেইল ট্রেনের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে গেল, তখন আর এক্সপ্রেস রইলেন না, হয়ে গেলেন ‘বুরেওয়ালা বম্বশেল’! এতক্ষণে তাঁকে বোধ হয় আপনাদের চিনে যাওয়ার কথা!
২
ছেলেবেলায় পুকুরে ঝাঁপ দেয়ার জন্য উঁচুতে উঠতে গিয়ে হারিয়েছিলেন বাঁহাতের কনিষ্ঠা। ভাগ্যিস, ডান হাতের কনিষ্ঠা হারাননি, তাহলে কে জানে ক্রিকেটবিশ্ব কি রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত রয়ে যেত! তবে মাঠে ফিল্ডিং কিংবা ক্যাচিংয়ে কখনোই বুঝতেই দেননি হাতের একটি আঙ্গুলের অভাব।
পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় ‘ইমরান খান’ টিভিতে একটি ম্যাচে তাঁকে দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, ডেকে নেন নিজের দলে। নামিয়ে দেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন মঞ্চে।
শারজায় সুযোগ পেয়ে যান সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। টেস্ট ক্যাপও মাথায় উঠি উঠি করছিল।
১৫ই নভেম্বর ১৯৮৯তে, করাচি জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পাকিস্তান-ভারত মহা উত্তাপের এক টেস্ট ম্যাচে অভিষিক্ত হলেন তিনি। স্বপ্নের নায়কদের পেলেন সহযোদ্ধা হিসেবে। শৈশবের মহানায়ক, ইমরান খানকে পেলেন দলনায়ক হিসেবে। স্বপ্নের ঘোর যেন তাঁর কাটে না!
আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা রাখছেন। ধমনি জুড়ে পূর্ণ পৌরুষত্বের আবাহন। সেই আবাহনের শিহরণের চেয়েও হয়তো বেশী রোমাঞ্চিত ছিলেন, প্রথম টেস্ট ক্যাপ মাথায় নিয়ে!
প্রথম দিন পাকিস্তান ব্যাটিং করেছিল, তাই তাঁর মাঠে নামার দরকারই পড়েনি। পরদিন ষোলই নভেম্বর, নবম উইকেট পতনের পর দুরুদুরু বুকে ব্যাট হাতে নামলেন তিনি। অপর পাশে আছেন, ইমরান খান। মহানায়কের সাথে ওয়াকারের কিছুক্ষণ মধ্যমাঠে কাটানোর স্বপ্ন চূরমার করে দিলেন, বেরসিক মনোজ প্রভাকর। ব্যাট হাতে দাঁড়ালেন কি দাঁড়ালেন না, প্রথম বলেই আউট!
তাঁর কি খুব রাগ হয়েছিল?
হয়তো হয়েছিল। সেই প্রভাকরকে যে দুরন্ত গতির এক ইয়র্কারে বোল্ড করে নির্মম প্রতিশোধটা নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি, সেদিনের সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই। মাঞ্জরেকারকে প্রথম স্লিপের ক্যাচ বানিয়ে প্রথম টেস্ট উইকেট অবশ্য ঝুলিতে পুরেছিলেন আগেই।
ভারতের অভিষিক্ত ‘বিস্ময়-বালক’ শচীন রমেশ টেন্ডুলকারকে যখন আউট করছিলেন, তখনও তিনি জানেন না, কত কথা, কত আলোচনা আর কত গল্পের সূচনা করলেন মাত্র!
অভিষেকেই পেয়েছিলেন চার উইকেট। গুরু ইমরান খান যে তাঁর নবীন কাঁধে ভরসার হাত রেখে ভুল করেননি, তাঁর প্রমাণ রেখেছিলেন প্রথম ম্যাচেই।
৩
নতুন বল হাতে পেতেন খুব কম সময়ের জন্যেই। ইমরান খান তাঁকে পুরনো বল হাতে দিয়েই বলে দিতেন, ‘সুইং-টুইং দেখার দরকার নেই তোর, দরকার নেই লাইন-লেংথ দেখার। তুই শুধু যত পারিস জোরে বল করবি।’ তিনি গুরুর মন্ত্রমুগ্ধ শিষ্য। তাই গুরুর বাক্য শিরোধার্য্য মেনে, দৌড়ে এসে ডান হাতে ছুঁড়ে দিতেন এক-একটি দেড়শ কিমির বম্বশেল! প্রতিভাগুণে আয়ত্ব করে নিয়েছিলেন রিভার্স সুইং। এই রিভার্স সুইংয়ে স্ব-রাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন, ‘কিং অব রিভার্স সুইং!’
যখন তরুণ ছিলেন
নিঁখুত ইয়র্কারে ব্যাটসম্যানদের ভূপাতিত করতেন বলে ‘ডিউক অব ইয়র্কার’ বলে ডাকা হতো তাঁকে। ঠিক বুটের মাথা সই করে ছুঁড়ে দিতেন ১৬৩ আউন্সের চর্মগোলকটি। অনেক সময় এমনও হয়েছে, তাঁর ইয়র্কারে টাল সামলাতে না পেরে ব্যাটসম্যান অসহায় হয়ে পড়ে গেছেন মাটিতে। কতবার ব্যাট-প্যাড মিস করে দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে ভেঙ্গে গেছে স্ট্যাম্প, ব্যাটসম্যান অবাক চোখে একবার বোলার আরেকবার স্ট্যাম্প দেখে, হতাশা মেখে হাঁটা দিয়েছেন প্যাভিলিয়নের দিকে!
বলের উপর তাঁর এই অসাধারণ নিয়ন্ত্রণের কারণে, তাঁর অধিকাংশ টেস্ট উইকেটই এসেছে, বোল্ড আর লেগ বিফোরে।
দুরন্ত গতির সাথে সুইংয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে জন্ম দিয়েছিলেন, ‘বেনানা সুইং’ নামের আশ্চর্য্য দৃষ্টিনন্দন এক ফাস্ট বোলিং শিল্পের। অনেকটা কার্ভের মতো করে ‘সি শেপ’ তৈরী করতো বলে, বলা হতো বেনানা সুইং।
১৯৯০তে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের সেরাটা দেখিয়েছিলেন। তিন টেস্টের সিরিজে নিয়েছিলেন ২৯ উইকেট। প্রথমবারের মতো ম্যাচসেরাও হয়েছিলেন লাহোর টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে। ফয়সালাবাদেও নিয়েছিলেন দুই ইনিংসে সাত ও পাঁচ মিলিয়ে, বারো উইকেট। নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা তিন ওয়ানডেতে, পাঁচ দিনের ব্যবধানে উইকেট নিয়েছিলেন, পাঁচের নামতা পড়ে। পাঁচ, পাঁচ, পাঁচ। তিন পাঁচে, পনেরো উইকেট।
তারপরের বছর ১৯৯১তে ইংল্যান্ডে গিয়ে সারের হয়ে মাতিয়ে ছিলেন কাউন্টি। মাত্র মাস কয়েকের মধ্যে চারদিনের ম্যাচগুলোতে শতাধিক উইকেট নিয়েছিলেন সেবার। তবে তাঁর দূর্ভাগ্য যে তিনি মৌসুম-সর্বোচ্চ ১১৩ উইকেট নিয়েও পারেননি সারেকে ‘কাউন্টি-শিরোপা’ এনে দিতে।
সারেকে না পারলেও পরের বছর বিলেত সফরে পাকিস্তানকে ঠিকই সিরিজ জিতিয়েছিলেন তিনি। ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা রিভার্স সুইংয়ের সমাধান না-পেয়ে, হতবিহ্বল হয়ে, বারবার ‘কলাপ্স’ করেছে। ওয়াকার-ওয়াসিমে নাকানি-চুবানি খেয়ে অভিযোগ এনেছে বল টেম্পারিংয়ের। ওয়াকারের বয়েই গেছে তাদের অভিযোগ শুনতে!
পাকিস্তান টেস্ট সিরিজ জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। তিনি নিয়েছিলেন সিরিজ-সর্বোচ্চ ২২ উইকেট।
১৯৯১-১৯৯৩ এই তিন বছরে মাত্র ১৮ গড়ে নিয়েছিলেন ১০৯টি টেস্ট উইকেট। ওয়াসিম আকরামের সাথে জুটি বেঁধে বিলেতে তো বটেই, ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বক্রিকেটেই। ‘টু ডব্লিউস’ এর একজন হয়ে বিশ্বক্রিকেটে ফাস্ট বোলিংয়ের অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন, রোমাঞ্চকর নব্বইয়ের দশকে যোগ করেছিলেন অন্য রকম এক মুগ্ধতা।
এরই ফলস্বরুপ, ‘৯২তে হয়েছিলেন, উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার। ফর্মের এমনই তুঙ্গে ছিলেন যে, জিওফ বয়কট বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ওয়াসিম-ওয়াকার যদি কমলা নিয়েও বল করে, তাহলেও ইংলিশ-ব্যাটসম্যানরা তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না’।
৪
গতির ঝড় তুলতে গিয়ে কখনো-সখনো বেধড়ক পিটুনী খেয়েছেন। তবুও গতি কমানোর চিন্তাও করেননি। তাঁর দীর্ঘদিনের সতীর্থ ও নতুন বলের সঙ্গী, ওয়াসিম আকরাম বলেছেন, ‘আমি ওয়াকারের সাথে অনেকদিন খেলেছি। এবং এই লোক প্রতি ম্যাচেই টানা দেড়শ কিলোমিটার গতিতে বল করে গেছে’। ওয়াকারের ভাষ্য ছিল একদম সহজ সরল, ‘আমি ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছি, মিডিয়াম পেসার নয়!’
দুজন যখন বন্ধু
ওয়াসিম আকরামের সাথে জুটি বেঁধে বোলিং করেছেন, দু’জনে ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। আবার জনশ্রুতি আছে যে, ওয়াসিমের সাথেই ছিল তাঁর সবচেয়ে বেশী রেষারেষি। এই রেষারেষির ব্যাপারটা কেউ কখনো সরাসরি অস্বীকার করেননি।
তবে ওয়াকার খেলোয়াড়ী জীবনে একবার বলেছিলেন, ‘ওয়াসিম ক্যাপ্টেন বলে তাকে বোলিংয়ের ঠিকমতো স্পেস দেয়া হয় না’। ব্যস! এরপর এ নিয়ে আর কিছুই বলেননি কখনো। যদিও ওয়াসিম আকরাম বলেছেন, ‘আমরা একে অপরকে প্রচন্ড ঘৃণা করতাম। এত ঘৃণা যে মাঠে কেউ কখনো একজন আরেকজনের সাথে কথাও বলতাম না’।
কখনো কখনো ওয়াকার দুঃখপ্রকাশও করেছেন, তাদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত দলের নবীন-তরুণ সদস্যদের উপর প্রভাব ফেলেছিল বলে। এখন ফিরে দেখলে ব্যাপারটাকে, ওয়াকার বেশ কদর্য ছিল বলে মনে করেন ।
তবে আবার এটাও মেনেছেন, ‘আমরা দুজনই ভাবতাম উইকেট আমিই নেবো। ওকে উইকেট নেওয়ার কোন সুযোগই দেবো না’। স্বীকার করেছেন, ‘হ্যাঁ, রেষারেষি-প্রতিদ্বন্ধিতা ছিল। তবে তা ছিল স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা’। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাকি আখেরে পাকিস্তান দলকেই সাহায্য করেছে। মজার ব্যাপার, দুজনেই দুজনের অধিনায়কত্বে খেলেছেন।
বিশ্বকাপের সাথে কি এক বৈরীতা আছে তাঁর। ফর্মের চূড়ায় থাকাকালে ইঞ্জুরীর কাছে হার মেনে, স্বদেশের সবচেয়ে গৌরবের ’৯২ বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি। ঘরের মাঠে ’৯৬ বিশ্বকাপটাও কেটেছিল যাচ্ছে-তাই ভাবে। আর ’৯৯ বিশ্বকাপে কেবল বাংলাদেশের সাথেই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন।
সেই ওয়াকার দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে গেলেন দলের দলনায়ক হয়ে। যদিও গ্রুপ পর্বের বাঁধা উৎরাতে পারেননি। জীবনের শেষ ওয়ানডেটাও খেলা হয়ে যায় সেখানে। শেষ টেস্ট খেলেছিলেন তারও মাস-দুয়েক আগে। আনুষ্ঠানিক অবসরের ঘোষণাটা দিয়েছিলেন পরের বছর। সবধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের সময় বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো আরো বছর খানেক খেলে যেতে পারবো, কিন্তু আমি খেলার প্রতি আমার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলেছি’।
সাদা বলে সবচেয়ে বেশী ‘তেরো’ বার পাঁচ বা ততোধিক উইকেট আছে তাঁর। চার উইকেটও পেয়েছেন সর্বোচ্চ ২৭ বার। মাত্র ২৬২ ম্যাচে ৪১৬ উইকেটই সাক্ষ্য দেয়, কোন মানের বোলার ছিলেন তিনি! ৮৭ টেস্টে নিয়েছিলেন ৩৭৩ উইকেট।
মাত্র বাইশ বছর বয়সে, নিয়মিত অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামের অনুপস্থিতে পেয়েছিলেন অধিনায়কত্ব। তেরো উইকেট নিয়ে দলের জয়ে সামনে থেকে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব, হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। ২০০১-এ লিডসে, ওয়ানডেতে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ৩৬ রানে ৭ উইকেট, অধিনায়কের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড হয়ে আছে এখনো।
এই কয়েকটা সংখ্যা বা পরিসংখ্যানের কি সামর্থ্য যে, ওয়াকার ইউনিসের মাহাত্ন্য বোঝাবে?
তিনি সরফরাজ নেওয়াজ, ফজল মাহমুদ, ইমরান খানদের উত্তরসূরী। ফাস্ট বোলিং তাঁর কাছে কেবল বোলিং-ই নয়, একটা নেশা, একটা শিল্প, একটা উত্তরাধিকার। তাই গতির সাথে আপোস করেননি কখনোই। তাঁর মতে, ‘ফাস্ট বোলিং হচ্ছে এমন একটা শিল্প, যা দিয়ে ব্যাটসম্যানের উপর নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়!’ ফাস্ট বোলিংয়ের সাথে আপোষ করতে চাননি বলে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজটিকে ‘বিদায়’ বলতে দ্বিধা করেননি।
গতি আর সুইংকে কতটা ভালোবাসলে এমন আত্মত্যাগ স্বীকার করা যায়, সেটা একবার ভাবুন তো?