• বিশ্বকাপ বাছাই
  • " />

     

    যেভাবে ব্রাজিলকে বদলে দিলেন তিতে

    যেভাবে ব্রাজিলকে বদলে দিলেন তিতে    

    .

    নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ। দল ফর্মে। নেইমার জাদুতে সেমিতেও গেল স্কলারির শিষ্যরা। ইঞ্জুরিতে নেইমার ও সাসপেনশনে কাপ্তান সিলভা ছিটকে গেলেও জার্মানীর বিপক্ষে ম্যাচের আগে আশাহত হয়নি ব্রাজিল সমর্থকেরা। ’০২ বিশ্বকাপে জার্মানদের হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলা স্কলারিই যে হটসিটে! কিন্তু ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বেলো হরিজন্তেতে যা ঘটলো, তা আক্ষরিক অর্থেই ব্যাখ্যাতীত। ৭-১ গোলের পরাজয়, তাও নিজেদের মাটিতে! সেদিন ব্রাজিলের কট্টর সমর্থক ক্লোভিস আগস্তুস ফার্নান্দেজের রেপ্লিকা বিশ্বকাপ জড়িয়ে কান্না আজো নাড়া দেয় ফুটবল অনুরাগীদের। চার দিন পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে নেদারল্যান্ডের কাছে ০-৩ গোলের পরাজয়। লজ্জায়,অপমানে পদত্যাগ করলেন স্কলারি। ব্রাজিলকে দেখে মনে হচ্ছিল,ফুটবল খেলাটাই যেন ভুলে গেছে 'জোগো বনিতো'র দেশটা...


    .

    স্কলারির প্রস্থানে ব্রাজিলের হটসিটে ফিরলেন '৯৪ বিশ্বকাপজয়ী কাপ্তান দুঙ্গা। আক্রমণাত্মক ফুটবলে বিশ্বাসী 'সেলেসাও'দের জন্য রক্ষণাত্মক চিন্তাধারার দুঙ্গাকে এমন এক সঙ্কটময় সময়ে দায়িত্ব দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি ব্রাজিল সমর্থকেরা। ‘সেলেসাও’ সমর্থকদের দুঃস্বপ্নটাই শেষমেশ সত্যি হল। '১৫ এর কোপাতে তাও কোয়ার্টার পর্যন্ত গিয়েছিল ব্রাজিল; ’১৬ তে তো ছিটকে গেল গ্রুপপর্ব থেকেই! কোপাতে বিগত শতকের সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্সের দরুণ বরখাস্ত হলেন দুঙ্গা। ব্রাজিলের কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা ছিল আর্জেন্টিনার র‍্যাকিংয়ে এক নম্বর হওয়া। 'গেল গেল' রব উঠতে তাই সময় লাগেনি খুব একটা...

     

    .

    আদেনর লিওনার্দো বাচ্চি। ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলে তার পরিচিতিটা 'তিতে' নামেই। দুঙ্গার পর ব্রাজিলের ফুটবলকে বাঁচানোর দায়িত্বটা পড়ে তিতের ঘাড়েই। ক্যারিয়ারে ব্রাজিলের একাধিক ক্লাবের ম্যানেজার থাকাটাই তিতের ‘প্লাস পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করেছিল। একে একে ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলাকে হারানো তিতের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা আসে চিরশত্রু আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সেই পরীক্ষায় ‘লেটার মার্কস’ নিয়েই উত্তীর্ণ হন তিতে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে রীতিমত হেসেখেলে ৩-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে তিতের শিষ্যরা। অনভিজ্ঞতাকে দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করা নিন্দুকদের মুখে যেন চুনকালিই দিয়ে দিলেন তিতে...

     

    মন ভাল তো সব ভাল

    স্কলারির পর দুঙ্গার প্রত্যাবর্তনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল সমগ্র ব্রাজিল। কোচ হিসেবে রক্ষণাত্মক চিন্তাধারার একজনকে এনে হিতে বিপরীতই হয়েছিল ‘সেলেসাও’দের। দুঙ্গা শুরু থেকে মানুষের অসন্তোষকে নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগানোর কথা বললেও শেষমেশ তা হয়ে ওঠেনি। অবস্থার উন্নতি তো করতে পারেনই নি, উলটো একাধিক তারকাকে বসিয়ে রেখে গালমন্দও খেয়েছেন বেশ।

    তিতের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। দুঙ্গা নয়, ’১৪ বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর তাকেই স্কলারির উত্তরসূরি হিসেবে চেয়েছিল ব্রাজিলবাসী। আগমনের পর থেকেই ব্রাজিল মিডিয়া, সাবেক খেলোয়াড়- সবার কাছ থেকেই সাধুবাদ পেয়েছেন। কিংবদন্তী জিকো তো বলেই দিয়েছেন, “লিগে একের পর এক অসাধারণ মৌসুম কাটানোর পর তিতে ব্রাজিলের হটসিটে বসাটা সবচেয়ে বেশি ডিজার্ভ করে”। তিতের অধীনে যেন ব্রাজিল ড্রেসিং রুমেও শান্তি ফিরে এসেছে। ব্যাপারটা অনেকটা বেনিতেজ ও জিদানের মাদ্রিদের দলের মত। দুঙ্গার অধীনে হারানো ‘ফিল গুড’ ফ্যাক্টরটা তিতের অধীনে ফিরে পেয়েই আপন শক্তিতে জ্বলে উঠেছেন নেইমার, কৌতিনহোরা।

     

    পজিশন নয়, খেলার ধরণ বদলাও

    দুঙ্গার অধীনে একই ফরমেশনেই খেলে যাচ্ছিল ব্রাজিল। দল ‘ক্লিক’ না করার পরও নিজের মাঝেমধ্যে ৪-৩-৩ এ খেললেও প্রিয় ৪-২-৩-১ থেকে সরে আসতে চাননি দুঙ্গা। দুঙ্গার অধীনে একাধিক গড়পড়তা পারফরম্যান্সের পেছনে খেলোয়াড়দের ভিন্ন পজিশনে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাটা অন্যতম কারণ।

    তিতের অধীনে অবশ্য এমনটা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। রেনাটো, নেইমার, ক্যাসেমিরো, কৌতিনহো- সবাইকেই জায়গা মত খেলানোর জন্য প্রিয় ফরমেশন ৪-১-৪-১ থেকে সরে আসতেও পিছপা হননি। ফলাফল? দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্রাজিলের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ, এখন টেবিলের শীর্ষে অবস্থান করছেন নেইমাররা।

     

    উইং থেকে মধ্যমাঠ

    দুঙ্গার উইংপ্রীতির কারণে লিভারপুলের হয়ে মাঠ কাঁপালেও ব্রাজিলে সুযোগই পাচ্ছিলেন না কৌতিনহো। উইং দিয়ে ঢোকার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও একরোখার মতো নিজের ধরণ নিয়েই পড়ে ছিলেন দুঙ্গা।

     

     

    করিন্থিয়ান্স, গ্রেমিও- ক্যারিয়ারজুড়ে যেকোনো ক্লাবেই উইংয়ের চেয়ে মধ্যমাঠ দিয়ে আক্রমণ গড়ার দিকে বেশি জোর দিতেন তিতে। উইং দিয়ে তেড়েফুড়ে বের হওয়ার চেয়ে মধ্যমাঠে ছোট ছোট পাসে খেলাটাই বেশি পছন্দ ব্রাজিল নবাগত কোচের। তিতের অধীনে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় কৌতিনহো হওয়াটা তা-ই প্রমাণ করে।

     

    নামে নয়, কর্মে পরিচয়

    ফিরমিনো, গ্যাব্রিয়েল হেসুস ও গ্যাব্রিয়েল বার্বোসা। ইউরোপের অন্যতম ‘হটকেক’ এই তিন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার থাকা সত্বেও দুঙ্গা সেই দিয়েগো তারদেল্লিদেরই খেলিয়েছিলেন। রবিনহো সুযোগ পেলেও এই তিনজনই ছিলেন ব্রাত্য। একজন স্ট্রাইকারের অভাবটা বিগত দুই কোপা আমেরিকাতে বেশ ভুগিয়েছে ‘সেলেসাও’দের। ক্যাসেমিরো, রেনাটো আগুস্তোরা ক্লাবের হয়ে ধারাবাহিক পারফর্ম করলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই লুইস গুস্তাভো, এলিয়াসদের নিয়েই বারবার দল সাজিয়েছিলেন দুঙ্গা।

    তিতের অধীনে অবশ্য সুযোগ পাচ্ছেন সবাইই। ফারনান্দিনহো, ক্যাসেমিরো, কৌতিনহো, হেসুস অবশেষে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলতে পারছেন। দলে ফিরে এসেছেন দুঙ্গার অধীনে প্রায় ব্রাত্য হয়ে পড়া সাবেক কাপ্তান থিয়াগো সিলভাও। করিন্থিয়ান্সের থাকার সময় ‘সিলভার সাথে অন্যায় হচ্ছে’, এমনটাই বলেছিলেন তিতে। ব্রাজিলের হটসিটে বসেই বিশ্বের অন্যতম সেরা সেন্টার ব্যাককে দলে ফেরানোয় ভূয়সী প্রশংসায় সিক্ত হয়েছেন তিতে।

     

    তারুণ্যের জয়গান

    ফিরমিনো, কৌতিনহো, গ্যাব্রিয়েল হেসুস, ক্যাসেমিরো। এমন আরো অনেক তরুণ ক্লাব পর্যায়ে নিজেদের প্রমাণ করতে থাকার পরও দুঙ্গার ব্রাজিল দলে জায়গা পাচ্ছিলেন না। ডেভিড লুইজ, তারদেল্লিদের দিয়ে কাজ না হওয়ার পরও নিজের ভুল স্বীকার করতে চাননি দুঙ্গা।

    ব্রাজিলীয়ান লিগে ক্যারিয়ারের সিংহভাগ কাটিয়ে দেওয়া তিতে এসব তরুণদের প্রতিশ্রুতি ও ধারাবাহিক পারফরম্যান্স সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এসেই একে একে ক্যাসেমিরো, কৌতিনহো, ফিরমিনো, হেসুস, বারবোসা- সবাইকেই সুযোগ দিয়েছেন তিতে। কোচের আস্থার প্রতিদানটা খুব সম্ভবত সবচেয়ে ভাল মত দিয়েছেন ১৯ বছর বয়সী স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল হেসুস। কোয়ালিফায়ারে ব্রাজিলের হয়ে একমাত্র নেইমারই(৪) হেসুসের(৩) চেয়ে বেশি গোল করেছেন। এই তারুণ্যের জয়গানেই দক্ষিণ আমেরিকার কোয়ালিফায়ার টেবিলে শীর্ষে আছে তিতের ব্রাজিল।

     

    নেইমারকে নেইমারের মত থাকতে দাও

    কোচ থাকাকালীন সময় দুঙ্গা একাধিকবার বলেছেন, ব্রাজিল নেইমারের খুব একটা নির্ভর করে থাকে না। ঠিক কি কারণে এমনটা বলেছিলেন জানা না গেলেও এরপর থেকেই মূলত দুঙ্গার সাথে নেইমারের সম্পর্কে ছেদ পড়তে থাকে। বার্সার হয়ে মাঠ কাঁপালেও দুঙ্গার অধীনে ব্রাজিলের হয়ে শেষের দিকে কেমন যেন নিষ্প্রভ ছিলেন।

    কিন্তু তিতে আসার পরপরই বদলে সব হিসাব নিকাশ। নেইমারকে প্রিয় লেফট উইংয়ে খেলানোর পাশপাশি আক্রমণভাগে নিজের মত করে খেলার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেন। এতেই বার্সার পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও জ্বলে ওঠেন নেইমার। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে লক্ষ্যভেদ করে মাত্র ২৪ বছরেই ‘সেলেসাও’দের হয়ে গোলের হাফসেঞ্চুরি করেছেন এই সুপারস্টার! হেসুস, কৌতিনহোর সাথে দারুণ বোঝাপড়ায় একের পর এক রক্ষণভাগ দুমড়ে মুচড়ে রাশিয়ার পথে এগুচ্ছে নেইমার ও ব্রাজিল।

     

    দুঙ্গার ব্রাজিল ও তিতের ব্রাজিল। ফুটবলে যেকোনো দলে ম্যানেজারের প্রভাবটা বুঝতে শুধুমাত্র এই দুইজনের দলের মধ্যকার আকাশ-পাতাল পার্থক্যই যথেষ্ট।  দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায়ই দক্ষিণ আমেরিকার কোয়ালিফাইং গ্রুপে ষষ্ঠ থেকে প্রথম স্থানে নিয়ে এসেছেন ‘সেলেসাও’দের। অনেকেই ইতোমধ্যে নেইমারদের হাতে রাশিয়া বিশ্বকাপের শিরোপা দেখতে পাচ্ছেন। মাত্র পাঁচ মাসে দল ও খেলোয়াড়দের মনোভাবে আমূল পরিবর্তন আনা তিতে কিন্তু পা এখনো মাটিতেই রাখছেন। পথটা অনেক দূরের, যাত্রাটা অনেক দুর্গম- সবই জানা আছে বর্ষীয়ান এই কোচের। রাশিয়া বিশ্বকাপে কি হবে তা এখনই বলা যায় না, কিন্তু তিতের জাদুতে যে ব্রাজিল বদলে গেছে- তা অবশ্য বলতেই হয়।