'চিয়ার্স, মেট'!
সেই চেনা ঘাস, সেই চেনা গ্যালারি। দর্শক যেখানে গলা ফাটান, চিৎকার করেন। মাইকেল ক্লার্ক সেদিন হেঁটে হেঁটে এসসিজির মধ্যে গেলেন। হাঁটু গেঁড়ে বসলেন। ফিলিপ হিউজ যেন সঙ্গেই ছিলেন তাঁর। টেনে তুলে দেখতে চাইলেন, ক্লার্ক ঠিক আছেন তো! তাঁদেরকে যে চা-বিরতি পর্যন্ত ব্যাট করতে হবে! ক্লার্কের কয়েকটা দুর্বল শটের কথা মনে করিয়ে দিলেন। সে রাতে কোন সিনেমা দেখতে যাবেন, সেটা নিয়ে কথা হলো। এবং হ্যাঁ। গরু নিয়ে কথা হলো। ফিলিপ হিউজ কথা বলবেন, গরু, ফার্ম, গ্রাম থাকবে না, তা কি হয়!
ক্লার্ক যখন ম্যাকসভিল হাইস্কুলের হলরুমে কথা বলছেন, হিউজ তখন শুয়ে। একটা লোহার পাটাতনের উপরে একটা চৌকোণা বাক্সে। উপরে সাদা ফুল। সামনে হেলান দিয়ে রাখা কুকাবুরার একটা ব্যাট। পাশে একটা ব্লেজার, একটা টাই। তিনটা ক্যাপ। নিউ সাউথ ওয়েলস ব্লুজ। সাউথ অস্ট্রেলিয়ান রেডব্যাকস। আর ব্যাগি গ্রিন।
না থেকেও যে হিউজি ছিলেন ক্লার্কের সঙ্গে, এটাই কি ‘স্পিরিট’?
‘ফিলিপের চেতনা, আমাদের এই খেলার চিরদিনের অংশ হয়ে থাকবে। আমরা যে খেলাটা ভালবাসি, রক্ষক হয়ে কাজ করবে সেটার। আমাদের সাড়া দিতে হবে, লালন করতে হবে, শিক্ষা নিতে হবে। এবং অবশ্যই, আমাদের খেলা চালিয়ে যেতে হবে… চালিয়ে যেতে হবে, চা-বিরতি পর্যন্ত। রেস্ট ইন পিস, লিটল ব্রাদার। দেখা হবে, মাঠের মধ্যে।’
ক্লার্কের সঙ্গে কি দেখা হয়েছিল হিউজির? অ্যাডিলেড ওভালে?
****
পাঁচদিন পর অ্যাডিলেড ওভালে অস্ট্রেলিয়া নামলো ভারতের সঙ্গে টেস্ট খেলতে। সেঞ্চুরির পর ডেভিড ওয়ার্নার লাফিয়ে ওঠেন, ব্যাটটা উঁচিয়ে ধরেন আকাশপানে। শরীরের সঙ্গে লড়াই চলে মাইকেল ক্লার্কের। চোট নিত্যকার সঙ্গী তাঁর, কিন্তু এই টেস্টটা যে বেশী করে খেলা দরকার! ভবিষ্যত শঙ্কায় পড়ে যাবে, তাতে কি! ‘লিটল ব্রাদার’কে একটা স্নেহার্ঘ্য দেয়ার উপলক্ষ্যটা হাতছাড়া করতে চান না বলেই না মাইকেল ক্লার্করা ক্রিকেট খেলেন! চোট নিয়ে উঠে গেলেন, পরে নেমে পেলেন ঠিকই সেঞ্চুরি। ২৮টা টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে আবেগ মিশে ছিল যাতে!
প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি পেলেন স্টিভেন স্মিথও। ক্যারিয়ারের পঞ্চম। একটা ডাবলসে সেঞ্চুরি পূর্ণ হলো, স্মিথ উদযাপন করতে করতে এগিয়ে গেলেন অ্যাডিডেল ওভালের যে অংশে ‘৪০৮’ অঙ্কিত আছে, সেখানে। সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যাটটা তুললেন আকাশপানে, যেন হিউজকে ওয়ার্নার বা ক্লার্কের মতো করেই বললেন, ‘এটা তোমার জন্য, মেট’! স্মিথ এরপর থেকে সেঞ্চুরি করলে প্রায়ই আকাশপানে তোলেন ব্যাটটা।
অ্যাডিলেড ওভালে অস্ট্রেলিয়ানদের উদযাপনগুলো হলো দীর্ঘ। ৫০, ৬৩, ১০০, ৪০৮। স্মিথ সেঞ্চুরির পর মাইকেল ক্লার্ককে জড়িয়ে ধরলেন। ক্যামেরা প্যান করে স্মিথের মুখের উপর ধরলো, একটা স্বস্তি, একটা প্রাপ্তি। আর আবেগ। উপচানো আবেগ। হিউজির জন্য একটা সেঞ্চুরি!
****
মাইকেল হোল্ডিংয়ের অভিষেক সিরিজ। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। বোলার হোল্ডিংয়ের সামনে ইয়ান রেডপাথ, অ্যালান টার্নার, চ্যাপেল ভাতৃদ্বয়। আর ব্যাটসম্যান হোল্ডিংয়ের সামনে ডেনিস লিলি, জেফ থম্পসন। অস্ট্রেলিয়ান দর্শকরা কোরাস ধরতো, ‘লিল্লি, লিল্লি, লিল্লি, কিল, কিল, কিল’। লিলির বাউন্সার, অজিদের ছুটে আসা কথার বাণ সামলাতে পারলেন না হোল্ডিং। ভেঙ্গে পড়লেন, কেঁদেই দিয়েছিলেন! মাইকেল হোল্ডিং, পরবর্তীকালের ‘হুইস্পারিং ডেথ’! ‘ফা** অজিস’! অস্ট্রেলিয়া ‘টাফ’।
মাইকেল ক্লার্ক ও রিকি পন্টিং। ডেভিড ওয়ার্নার ও শেন ওয়াটসন। সাইমন ক্যাটিচ ও জাস্টিন ল্যাঙ্গার। ব্র্যাড হ্যাডিন ও ম্যাথু ওয়েড। ড্যারেন লেম্যান ও ব্রেট লি। অস্ট্রেলিয়ার ‘টাফ’ এই ক্রিকেটারদের মাঝে মিল ছিল খুবই কম। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তবে ব্যাগি-গ্রিন ছাড়া আর একটা বিষয়ে সবাই একমত ছিলেনঃ
ফিলিপ হিউজ।
ক্লার্কের খুব কাছের বন্ধু। পন্টিংয়ের শিষ্যতুল্য। দুজনের ম্যানেজারও ছিলেন একজনই, জেমস হেন্ডারসন। হিউজ তিনজনের ওপেনিং সঙ্গী ছিলেন, ওয়ার্নার, ওয়াটসন, ক্যাটিচ। হ্যাডিন বা ওয়েড, দুই উইকেটকিপারের সংগেই ছিল বন্ধুত্ব। হিউজি আবার লেম্যান, ল্যাঙ্গারের ছাত্র ছিলেন, ব্যক্তিগত কোচ নেইল ডি’কস্টার সঙ্গে। হিউজকে তো ল্যাংগার নিজের বাড়িতেই রেখেছিলেন। ল্যাংগার-পত্নী হিউজিতে এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন, মজা করে বলতেন, তাঁদের কোনো এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে! তা না হলেও অন্তত দত্তক নিতে!
এঁরা সবাই ছুটে গিয়েছিলেন সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে। হিউজির শয্যাপাশে। প্রার্থনা করেছিলেন সেই মিরাকলের। যেটা কোনোদিন আসেনি।
ম্যাথু ওয়েডের হাতের ট্যাটু
****
মাইকেল ক্লার্ক অবসরে গেছেন। ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে দেখছিলেন, কিভাবে স্টিভেন স্মিথের অস্ট্রেলিয়া পরাস্ত হচ্ছে একে একে! যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টানা ১৯ বছর টেস্ট হারেনি অস্ট্রেলিয়া, সেই তাঁদের কাছেই হারতে হলো টানা তিনটা টেস্ট! এবি ডি ভিলিয়ার্স বা ডেল স্টেইনবিহীন দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেই অল-আউট হতে হলো ৮৫ রানে! প্রতিপক্ষের রান ৩২৬, অস্ট্রেলিয়া দুই ইনিংস মিলিয়েও করতে পারলো না তা! চাপে পড়ে গেলেন ড্যারেন লেম্যান, রড মার্শ। এবং অবশ্যই স্টিভেন স্মিথ। ক্লার্ককে মাঠের মধ্যে জড়িয়ে ধরার দিন ফুরিয়ে এসেছে, স্মিথের কাঁধেই যে নেতৃত্ব এখন।
কিন্তু গলদটা আসলে কোথায়?
শেফিল্ড শিল্ডের কাঠামোতে? ঠাসা আন্তর্জাতিক সূচী? ‘বিগ-ব্যাশ’ইজম? আইপিএলের প্রভাব? উত্তর হয়তো এখনও মেলেনি, তবে অস্ট্রেলিয়া দলে নাটকীয় সব পরিবর্তন এলো তৃতীয় টেস্টের আগেই। নাটকীয়, কিন্তু অনুমিত যেন! প্রধান নির্বাচক রড মার্শ পদত্যাগ করলেন। বাদ দেয়া হলো পাঁচজনকে। সিরিজের মাঝখানে।
নতুন অস্ট্রেলিয়া। নতুন একটা টেস্ট। গন্তব্য, অ্যাডিলেড ওভাল। সেই নভেম্বর, সেই অ্যাডিলেড।
ক্রিকেটের পরিবর্তনশীলতা নতুন নয়, দুই বছরেও ক্রিকেটে কম পরিবর্তন আসেনি! সবচেয়ে বড়টা বোধহয় দিবা-রাত্রির টেস্ট। নতুন অস্ট্রেলিয়ার সামনে ক্রিকেটের নতুন সংস্করণ, প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে।
৯ উইকেটে ২৫৯ রান নিয়েই প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে দিল দক্ষিণ আফ্রিকা! ফ্লাডলাইটের কঠিন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিং করানো হবে বলে! ফিল্ডিং করতে করতে উঠে গিয়েছিলেন বলে ওপেনিংয়ে নামা হলো না ওয়ার্নারের, ম্যাট রেনশকে সঙ্গী করে নামতে হলো উসমান খাওয়াজাকে। দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলেন দুজন। খাওয়াজার সেঞ্চুরি পরদিন। স্মিথ আর হ্যান্ডসকবের সঙ্গে স্টার্কের ফিফটি। দলে স্বীকৃত অলরাউন্ডার নেই, সেই ক্ষতিটাই পুষিয়ে দিলেন হয়তো।
অস্ট্রেলিয়া জিতলো। দুই রান বাকি থাকতে আউট হয়ে গেলেন স্টিভেন স্মিথ। অস্ট্রেলিয়া যখন জিতলো, উইকেটে তখন দুই অভিষিক্ত। ম্যাট রেনশ, পিটার হ্যান্ডসকব। একদিন বাকি থাকতেই। ২৭ নভেম্বরে। অজিরা এদিন হাতে কালো আর্মব্যান্ড পরে নেমেছিলেন, ‘পিএইচ’ লেখা।
অস্ট্রেলিয়া সিরিজ হেরে গেছে আগেই, তবুও হোয়াইটওয়াশ এড়ানো, কিংবা গ্রীষ্মের প্রথম জয়ে তো উদযাপন হবেই! ড্রেসিংরুমের একটা ছবি দেখা গেল এরপর, স্মিথ-ডু প্লেসিরা পাশাপাশি বসে পান করছেন। সবকিছুর পর তো ক্রিকেটই সব!
****
কিন্তু কিছু ছবি হয়তো দেখা যায়নি। হয়তো ঘটেছে এমন।
ড্রেসিংরুমে ‘টিম-সং’ এ নেতৃত্ব দিয়েছেন্ন ন্যাথান লায়ন, এই টেস্টে যাঁর বাদ পড়ার কথা ছিল। ডেভিড ওয়ার্নারের হয়তো আরেকবার মনে পড়েছে ফিলিপ হিউজের কথা, যেমন মনে পড়ে প্রতিদিন!
অস্ট্রেলিয়ার জয় দেখে এদিন মাইকেল ক্লার্কের হয়তো মনে পড়েছে সেদিনের এসসিজির কথা। হিউজির কন্ঠ যখন ক্লার্ককে বলেছিল, ‘চা-বিরতি পর্যন্ত ব্যাটিং করতে হবে।’
আর স্মিথের হাতের বোতলটা হয়তো আরেকটা অদৃশ্য বোতলের সঙ্গে টোকা লেগেছে।
স্মিথ বলেছেন, ‘চিয়ার্স, মেট’!