নিজেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দেশী পেসাররা
দুর্দান্ত খেলে এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি কপিল দেব। বলেছিলেন, “ভারতের থেকেও বাংলাদেশের পেস আক্রমণ উন্নত।” ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের নায়ক যে মোটেই বাড়িয়ে বলেননি তার প্রমাণ বছরজুড়ে দিয়ে এসেছেন মাশরাফি-তাসকিন-মুস্তাফিজরা। এবারের বিপিএলেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশি পেসারদের দাপট। রুবেল-শহীদ-তাসকিন-শফিউলরা প্রতি ম্যাচেই দাগছেন বোলিং তোপ, যাতে রীতিমতো নাকাল বাঘা বাঘা দেশি-বিদেশি ব্যাটসম্যানরা। টি-টোয়েন্টি যে কেবল ব্যাটসম্যানদের খেলা নয় বরং বোলারদেরও, প্রতিনিয়ত তা-ই প্রমাণ করছেন মাঠে। এবারের শীর্ষ পাঁচ উইকেট শিকারির তিনজনই বাংলাদেশি পেসার।
একটা সময় ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে যখন বোলিং মানেই ছিল স্পিন। গতির দিক দিয়েও পেসাররা ছিল অনেকটা পিছিয়ে। স্পিনটাকেই মূল অস্ত্র করে এগুচ্ছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেট। কিন্তু সে বিশ্বাসের ভিত্তি ফুঁড়ে অকস্মাৎ আবির্ভাব হলো মাশরাফি বিন মুর্তজার। তিনি এলেন দিগ্বিজয়ী বীরের মতো। বিশ্ব তাকিয়ে দেখলো বাংলার সন্তানরাও পারে। সাঁই সাঁই গতির আনকোরা ঝলকে উপড়ে দিতে পারে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ব্যাটসম্যানের স্টাম্প। বাউন্সারের ছোবলে হেলমেটের বর্ম ভেদ করে ঢুকে পড়তে পারেন ব্যাটসম্যানের মস্তিষ্কের ভেতরে। আঁধার রাতের ভয় হয়ে। তন্দ্রাবিধ্বংসী ঘোর হয়ে। টিভি পর্দায় এমন নমস্য আদর্শ দেখেই বেড়ে উঠেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান, শফিউল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ, মোহাম্মদ শহীদ, রুবেল হোসেন ও আল-আমিন হোসেনরা। দিন দিন তাঁরা হয়ে উঠেছেন আরো নির্ভীক। আরো কালান্তক।
১৭ উইকেট নিয়ে এবারের বিপিএলে শীর্ষ উইকেট শিকারি চিটাগং ভাইকিংসের আফগান অফ স্পিনার মোহাম্মদ নবী। তাঁর পরেই আছেন তিন বাংলাদেশি পেসার। শফিউল ইসলাম, মোহাম্মদ শহীদ ও তাসকিন আহমেদ। শফিউল নিয়েছেন ১৬ উইকেট। বাকিরা ১৫টি করে। শীর্ষ দশেও আছেন আরও দুজপন। ১০ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে আবুল হাসান আছেন সাতে, সমান ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট নিয়ে নয়ে আছেন রুবেল হোসেন। চাইলে একে বাংলাদেশি পেসারদের জয়যাত্রার অন্যতম স্মারক হিসেবে ধরে নিতে পারেন।
বিপিএলের প্রথম আসরে শীর্ষ পাঁচ তো দূরে থাক, দশেই জায়গা পাননি কোনো বাংলাদেশি পেসার। দ্বিতীয় আসরে এসে ১১ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়ে দশ নম্বরে জায়গা পান রুবেল হোসেন। ওই আসরে আর কোনো বাংলাদেশী পেসার শীর্ষ দশে ছিলেন না। এরপর তৃতীয় আসরে এসে দ্রুতই উন্নতি ঘটে পেসারদের। শীর্ষ পাঁচে জায়গা করে নেন আবু হায়দার (২১ উইকেট) ও আল-আমিন হোসেন (১৭)। ১০ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়ে নয় নম্বরে ছিলেন সেবার অভিষিক্ত মুস্তাফিজুর রহমান।
চার আসর মিলিয়ে বিপিএলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হিসেবে আছেন একজন পেসার। ৩৬ ম্যাচে ৫৯ উইকেট নিয়েছেন কেভন কুপার। শীর্ষ পাঁচের বাকি সবাই স্পিনার। ৩৭ ম্যাচে ৪০ উইকেট নিয়ে ছয় নম্বরে আছেন শফিউল ইসলাম। ৩১ ম্যাচে ৩১ উইকেট নিয়ে আবুল হোসেন রাজু ও ৪৪ ম্যাচে ৩১ উইকেট নিয়ে মাশরাফি আছেন নবম অবস্থানে। ১৮ ম্যাচে ২৯ উইকেট নিয়ে তাঁদের পরেই আছেন মোহাম্মদ শহীদ।
শুধু উইকেট নয়, গতির ঝড়ও তুলতে দেখা গেছে বাংলাদেশের পেসারদের। রংপুর রাইডার্সের হয়ে প্রায় প্রতি ম্যাচেই একশো চল্লিশ কিলোমিটারের ওপর গতিতে বল করছেন রুবেল হোসেন। চোট ও ফর্মহীনতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছেন তিনি। চট্টগ্রামের হয়ে পেস-বাউন্সে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের নাকাল করেছেন তাসকিন আহমেদ। গতিতে না হলেও লাইন-লেন্থ মিলিয়ে দুর্দান্ত বল করেছেন শফিউল ইসলাম ও মোহাম্মদ শহীদ। ঢাকা ডায়নামাইটসের তরুণ পেসার আবু জায়েদ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন রেখেছেন নিজেদের সামর্থ্যের স্বাক্ষর। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ব্যর্থ হলেও ১০ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে ঠিকই উজ্জ্বল মাশরাফি বিন মুর্তজা।
ব্যাপারটাকে দেখতে পারেন বাংলাদেশি পেসারদের ক্রমোন্নতি হিসেবে। বিপিএলের প্রতিটি আসরেই নিজেদের আরও ছাড়িয়ে গেছেন বাংলাদেশি পেসাররা। প্রতিবারই আগের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন। শীর্ষ উইকেট শিকারির কুলীন তালিকায় লিখিয়েছেন নিজেদের নাম। জাতীয় দলের হয়ে যেমন পত পত করে উড়িয়েছেন লাল-সবুজ পতাকা, তেমনি ঘরোয়া কিংবা টি-টোয়েন্টি লিগেও রেখেছেন সামর্থ্যের প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে তাসকিন আহমেদের বলা মন্তব্যটাই স্মর্তব্য, “"আমাদের লোকাল ফাস্ট বোলাররা ভালো করছে। এটা খুবই ভালো দিক। আগের দিকের বিপিএলে বিদেশী ফাস্ট বোলারদের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল থাকতে হতো। এবার শফিউল ভাই, শহীদ ভাই ভালো করেছে। এটা দেখতেও ভালো লাগে। নিজের কাছে গর্ব হয়, আমি আসলে বাংলাদেশ দলের বোলার।"
নিউজিল্যান্ড সফরের আগে বাংলাদেশি পেসারদের এমন পারফরম্যান্স নিঃসন্দেহে আত্মবিশ্বাসের পালে উত্তুঙ্গ হাওয়া বইয়ে দেবে। ঘাসে ছাওয়া কিউই পিচে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটবে বাংলাদেশের রথ, সেই আশায় এখন বুক বাঁধাই যায়।