• ভারত-ইংল্যান্ড
  • " />

     

    'বেবি বয়কটের' ভারতীয় গুরুর গল্প

    'বেবি বয়কটের' ভারতীয় গুরুর গল্প    

    ডিসেম্বর মাসের শীতের সকাল। ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে বাবা ইসমাইল এলেন মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আসা ইসমাইল পুলিশে চাকুরি করা এক বন্ধুর থেকে খবর পেয়েছেন, মুম্বাইতে নাকি বিদ্যাধর পোরাধকর নামের একজন কোচ আছেন। তাঁর কাছে ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেটের হাতেখড়ি নিতে আসে। এটা শুনেই ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়েছেন। যদি তাঁর ছেলেকেও একটু ক্রিকেটজ্ঞান দেন, ছেলের আবার ক্রিকেট খেলার খুব শখ! বিদ্যাধর ইসমাইলের কথা রাখলেন, একবার পরখ করেই রাজি হয়ে গেলেন ছেলেটিকে ক্রিকেট শেখাতে। সেই শুরু, ২০১১ সালের ওই কনকনে ঠাণ্ডার সকাল বদলে দিয়েছে হাসিব হামিদের জীবন।

     

    যেখানে যাত্রার সূচনা হয়েছিল, ঠিক ৫ বছর পর সেই ভারতেই চক্রটা পূর্ণ হয়েছে। রাজকোটে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হওয়া হামিদের ব্যাটিং দেখে হয়তো আবেগটা ধরে রাখতে পারেননি পোরাধকর। এই তো সেদিনের কথা, লিকলিকে ছেলেটি প্রথমবারের মতো ব্যাট হাতে খেলতে নেমেছিল! পোরাধকর আজও ভোলেননি ওই দিনগুলোর কথা, “ ক্রিকেটের প্রতি ওর ভয়ানক নেশা ছিল। শেখার আগ্রহটাও ছিল প্রবল। আগে কখনো ক্রিকেট না খেলায় অনেক কিছুই জানত না। ওকে আমি সবসময়ই বলতাম, বলের দিকে নজর রাখবে। সে খুব দ্রুত ব্যাপারগুলো ধরে ফেলত। টেস্টের সময় খেয়াল করে দেখবেন সে এখনো বল খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এটা ব্যাটিংয়ের অন্যতম প্রধান দিক। একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে না থেকে রান নিতে বলতাম, সেটাও সে মনে রেখেছে!”

     

    পোরাধকরের পরামর্শে ‘পোরাধকর একাডেমীর’ পাঁচ সপ্তাহের একটি স্বল্পমেয়াদী কোর্সে ভর্তি হন হামিদ। শুরু হয়ে যায় ক্রিকেটার হওয়ার যাত্রা। প্রতিদিন ভোরে বোম্বে জিমখানা থেকে ক্রস ময়দান পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়াতেন। এরপর সকাল ৭.৩০টা থেকে ৯.৩০টা পর্যন্ত এবং বিকেল ৪ টা থেকে ৬.৩০ পর্যন্ত দুই পর্যায়ে অনুশীলন করতেন হামিদ। অনুশীলনের দিনগুলোতে নানাভাবেই হামিদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতেন পোরাধকর, “আমি ওকে কোন ড্রিল দিয়ে অনুশীলন করাতাম প্রায় সময়ই। ব্যাট সোজা রেখে কোনে মারতে বলতাম, এরকম সে দিনে একশবারের বেশি করত। ম্যাচেও সে এভাবেই ব্যাট করেছে বরাবরই।”

     
      
    হামিদকে দেওয়া পোরাধকারের সত্যায়নপত্র 

    ক্রিকেটের হাতেখড়ির পর ফিরে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ৪ বছর পর আবারো পোরাধকরের কাছে ফেরেন। তবে এর মাঝেই স্বপ্নের দিকে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছেন। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে পার্থে করেছেন ৯১, ঘরোয়া ক্রিকেটেও সারের বিপক্ষেও করেছেন ৯১। জাতীয় দলের অধিনায়কের সাথে জুটি বেধে এসেক্সের বিপক্ষে করেছেন ৬৩ রান। কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ পেটে আরও বেশি কিছু করতে হবে, সেটা হয়তো বুঝতে পারছিলেন হামিদ। পোরাধকর নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন এবার আরও বেশি দৃঢ় মনোবল নিয়েই এসেছেন হামিদ, “দ্বিতীয়বার যখন সে ভারতে এলো, তার ব্যাটিংয়ে অনেক উন্নতি দেখেছিলাম। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল সেবার, সে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনকিছুই তাকে দমাতে পারেনি। সে স্পিনও দারুণ খেলছিল।”

     

    দ্বিতীয়বার মুম্বাইয়ে আসার পর হয়তো হামিদের মাঝে আরও বেশি জেদ চেপে বসেছিল। ঘরে ফিরে কাউন্টিতে দুর্দান্ত খেলতে থাকেন। ২০১৬ তে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, বাংলাদেশ সফরের জন্য ডাক পান জাতীয় দলে। সফরে আসার আগে পোরাধকরকে ফোন দিয়েছিলেন হামিদ, “সে আমাকে বলেছিল, “আমি দলে ডাক পেয়েছি, বাংলাদেশ যাচ্ছি!” একই সাথে একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলেন, “পোরাধকর স্যার, আমার জন্য আপনি যা করেছেন সেটার জন্য ধন্যবাদ। আমি আপনার অধীনে যা কিছু শিখেছি সেটা আজীবন মনে রাখব।” যদিও ওই সফরে অভিষেক হয়নি। হয়তো এটাই হামিদের নিয়তিতে ছিল, ভারতের মাটিতেই ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাট হাতে নামবেন!

     

    তবে নিজের চোখে হামিদের ব্যাটিংটা এবার দেখার সুযোগ হচ্ছে না পোরাধকরের। ইনজুরির কারণে মুম্বাই টেস্টে খেলতে পারবেন না হামিদ, এরই মাঝে দেশে ফিরে গিয়েছেন। এতে খুবই হতাশ পোরাধকর, “মুম্বাইয়ে এটা তার প্রথম ম্যাচ হতো, আমি তাকে ব্যাট করতে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। আমি টিভিতে তাকে দেখেছি, কিন্তু সামনাসামনি ব্যাট করতে দেখা পুরোপুরি ভিন্ন ব্যাপার। সে খেলবে না, তাই আমি আর টিকেট কাটিনি, ম্যাচও দেখতে যাব না।”

     

    বয়স হয়ে গিয়েছে, ৭০ বছরের পোরাধকর নিজের কোচিং ক্যারিয়ারে অনেককেই ক্রিকেট শিখিয়েছেন। ভারতের জহির খান, অজিংকা রাহানেও তাঁর কাছে খেলা শিখেছেন। হামিদের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় হাত হয়তো তাঁরই। বিনিময়ে কিছু চাননি, ভবিষ্যতেও চাইবেন না। ‘বেবি বয়কট’ তকমা তো লেগেই গিয়েছে গায়ে,  ধীরে ধীরে দলের অবস্থানকে আরও শক্ত করছেন। ১৯ বছরের হামিদ যখনই ব্যাট হাতে নামেন, চোখ দুটো হয়তো ভিজে আসে। যেই হাতে ব্যাট ধরা শিখিয়েছেন, ছোট্ট সেই ছেলেটি আজ বুক চিতিয়ে লড়াই করছে। সূত্রঃ ক্রিকইনফো।