'বাংলাদেশের অগ্নিপরীক্ষা'
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৫২টি টেস্ট আর ১৬৪ট একদিনের আন্তর্জাতিক খেলা ডিন জোন্স ক্রিকেট কোচিংয়ের পাশাপাশি খ্যাতি পেয়েছেন কলামিস্ট কাম ভাষ্যকার হিসেবেও। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের প্রথম মৌসুমে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন চিটাগং কিংসের সাথে। সে সুবাদে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কাছ থেকে দেখার সুযোগও পেয়েছেন। শনিবারের বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি সামনে রেখে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের কলামে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থার একটি খণ্ডচিত্র আকার চেষ্টা করেছেন ৫৪ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান।
আবহাওয়ার অনুমতি মিললে শনিবার গ্যাবার বাউন্সি উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশটির ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা বোঝার জন্য এরচেয়ে ভালো উপলক্ষ আর কি হতে পারে? বাংলাদেশ কি পারবে অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তির বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে?
এসব প্রশ্নের উত্তরেই আইসিসি পেয়ে যাবে দল হিসেবে বাংলাদেশ কতোটা উন্নতি করছে তার জবাব।
কয়েক বছর ধরেই আইসিসির উপর ক্রিকেট অনুরাগি, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন দেশের তরফে চাপ আসছে টেস্ট ক্রিকেটের মান বজায় রাখার। হ্যাঁ মানছি ক্রিকেটটা গোটা বিশ্বে আমাদের ছড়িয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু সেটা কিসের বিনিময়ে? টেস্ট আর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মানের প্রশ্নে তো কোন ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
আইসিসির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে আগামী বিশ্বকাপে অংশ নেবে দশটি দল। ক্রিকেট থেকে চাকারদের মূলোৎপাটন করা গেছে, আইসিসির দায়িত্ব এখন সেসব দেশগুলোর পিছনে লেগে থাকা যারা প্রত্যাশিত মানে ক্রিকেটটা খেলতে পারছে না।
কথার মারপ্যাঁচে না গিয়ে একটু ঝেড়ে কাশা যাক। জিম্বাবুয়ে এবং বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে মানসম্পন্ন টেস্ট খেলতে পারছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এসব দেশে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ক্রিকেট আর ফুটবলের যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, সেখানে খেলার মানে আরও উন্নতি অবশ্যই প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে সাহায্য করবার জন্য আইসিসির পক্ষে যা যা করা সম্ভব সবই তাঁরা করছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতির স্বার্থেই ২০১৪ সালের টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপ এককভাবে আয়োজনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিসিবির আর্থিক দুর্গতির বিষয়েও আইসিসি ওয়াকিবহাল আছে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা কখনই বিসিবির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে নি। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেট আশানুরূপ উন্নতি না করলে তেমন কিছু করাটা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক খেলে ১৯৮৬ সালের মার্চে। ২০০০ সালের নভেম্বরে তাঁরা আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। এখন পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ছাড়া দেশটি টেস্ট খেলছে ৭৪টি, হেরেছে ৬৪টি আর জিতেছে মাত্র ২টি। সে দুটোও আবার খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সে বিবেচনায় ওয়ানডে রেকর্ড কিছুটা ভালো, ১৬৬টি হারের বিপরীতে জয় ২৭টি।
পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশের বোলারদের পারফরম্যান্স মন্দ নয়। কিন্তু ব্যাটিং টপ অর্ডার ভয়াবহ নাজুক। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের বিশ্বকাপেও অনুজ্জ্বল বাংলাদেশ। বিগত চারটি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তাঁদের অবস্থান যথাক্রমে অষ্টম, নবম, সপ্তম ও নবম।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা ক্রিকেটীয় অবকাঠামোয়। সত্যি বলতে সেখানে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট বলে কিছু নেই। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ নামে যে টুর্নামেন্টটা হয় সেটা মূলত ৫০ ওভারের ক্রিকেট। দলগুলোর মালিক বোর্ডের কর্মকর্তারাই। এসব দল থেকেই বেঁছে নেয়া হয় জাতীয় দলের খেলোয়াড়। বানিজ্যিকভাবে চলা টুর্নামেন্টে বিদেশী খেলোয়াড়দের প্রতি বাড়তি আগ্রহ থাকে মালিকপক্ষের। দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এমনও হয় যে বিদেশী কোন খেলোয়াড়কে সুবিধেমতো দলে পেতে কখনও কখনও ম্যাচই পিছিয়ে দেয়া হয়।
আমার কাছে বাংলাদেশের আরও একটা বড় সমস্যা মনে হয় বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মানসিকতায়। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বেশি করে চারদিনের ম্যাচ খেলা উচিৎ। অথচ দুঃখজনক হল বিসিবি সহযোগী বা প্রথম শ্রেণীর অন্য দেশগুলোর সাথে চারদিনের ম্যাচের সিরিজ আয়োজন করতে সম্ভবত ভয়ই পায়। পাছে না আবার টেস্ট স্ট্যাটাসটাই হারাতে হয়! কিন্তু একটা নির্দিষ্ট কাঠামোয় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট না খেলে উন্নতিটা আসলে কি করে সম্ভব?
আইসিসির তরফে বিসিবিকে চাপ দেয়ার সময় হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের উপর এমন শর্ত আরোপ করা উচিৎ যে যদি তাঁরা পূর্ণ সদস্যপদ বহাল রাখতে চায় তবে যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আনে। আইসিসি যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরও সময় আর অর্থ ব্যয় করতে ইচ্ছুক থাকে তবে তাঁদের উচিৎ প্রথমেই বোর্ডে তিনজন স্বাধীন পরিচালক নিয়োগ দেয়া। অতঃপর কোচ থেকে শুরু করে কর্মচারী এবং নির্বাচকদেরকেও আইসিসির তরফে নিযুক্ত করা হোক।
বাংলাদেশে আইসিসির প্রথম কাজটা হবে একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট কাঠামো তৈরি করা। প্রতিভা অন্বেষণের জন্য একটা একাডেমিও গড়ে তোলা উচিৎ। প্রতিটা বাংলাদেশি তরুণ যেন দেশের হয়ে খেলার সামর্থ্য জানান দেয়ার সুযোগটা পায়।
গত চার বছরে বাংলাদেশ চার চারবার কোচ বদলেছে, শুধুমাত্র খেলোয়াড়দের মন যোগাতে। এই জায়গাটিতেও কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। আইসিসির উচিৎ কোচিং স্টাফ ঠিক করে দেয়া। অনুশীলনে চাপ একটু বেশী হয়ে গেলেই যাতে কোন খেলোয়াড় ঘনিষ্ঠ কোন বোর্ড কর্তার কাছে গিয়ে নতুন কোচের জন্য ধরনা দিতে না পারে। সময় হয়েছে উঠে দাঁড়ানোর, ভালো ক্রিকেট খেলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার।
আরও একটা বিষয় আমাকে কষ্ট দেয় সেটা হল বাংলাদেশের বেশীরভাগ ক্রিকেটার মনে করে দেশের জন্য খেলতে পারাটাই যথেষ্ট। জয়টাকে তাঁরা কোন বাড়তি গুরুত্ব দেয় বলে আদতে মনে হয় না। একটা অর্ধশতক কিংবা গোটা তিনেক উইকেট পেলেই তাঁরা খুশী। অথচ অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের দিকে তাকালে তাঁদের লজ্জাই হওয়ার কথা। খেলোয়াড়দের মনে রাখা উচিৎ যে যদি তাঁরা আইপিএল, বিগ ব্যাশ, সিপিএল প্রভৃতি খেলে ভালো রোজগার করতে চায় তাহলে প্রথমে তাঁদেরকে নিজ দেশের হয়ে ভালো খেলে জেতার অভ্যেস গড়তে হবে।
আমি জানি উপরে আমি বাংলাদেশের ইতিবাচক কোন ছবি আঁকতে পারি নি। তারপরও আমি খুব দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি এই দলটার ভবিষ্যৎ আছে। তাঁদের দারুণ কিছু প্রতিভা আছে। তবে সেসবের পরিচর্যাটা জরুরী। বোর্ড কর্তাদের উচিৎ ব্যক্তিগত স্বার্থ, রেষারেষির ঊর্ধ্বে উঠে খেলাটির ভবিষ্যৎ উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করা।
তাঁদের পুরো ক্রিকেট কাঠামোটাই আগাগোড়া বদলে ফেলা প্রয়োজন। বাংলাদেশের দর্শকদের ক্রিকেটপ্রেম গোটা বিশ্বেই খুব বিরল এবং তাঁরা তাঁদের প্রিয় দলটার কাছ থেকে আরও অনেক বেশী পাবার দাবী রাখে।
গ্যাবার বাউন্সি, সবুজ উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার পেস আক্রমণের সামনে বাংলাদেশ কেমন করে সেটা শনিবারেই দেখা যাবে। তাঁদের শারীরিক সামর্থ্যের একটা ভালো পরীক্ষা হবে। প্রমাণ হবে দেশের হয়ে খেলাটা তাঁদের কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। খেলোয়াড়েরা নিশ্চয়ই খুব ভালো করেই জানে যে এই বিশ্বকাপে যদি তাঁরা ভালো লড়াই না করতে পারে তবে আগামীকাল বলে কিছু তাঁদের সামনে নাও থাকতে পারে!