'গুড ওল্ড শেপ'
ফতুল্লায় জাতীয় লিগের ম্যাচে ১১১ রানে আউট হয়েছেন রকিবুল হাসান। ১১১, নেলসন নাম্বার। ডেভিড শেফার্ড যে নাম্বার স্কোরবোর্ডে আসতেই লাফ দিতেন ছোট একটা। দুর্ভাগ্যের প্রতীক মানতেন এই নেলসন নাম্বারকে, সৌভাগ্য ফিরিয়ে আনতে দিতেন লাফ। ক্রিকেটার শেফার্ড নিয়মিতই করতেন এ কাজ, তবে দুই-একজন বন্ধু ছাড়া জানতেন না কেউ। তবে আম্পায়ারিংয়ের দ্বিতীয় টেস্টে এমন কাজ করার পরই পুরো মাঠ চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। শেফার্ড ভেবেছিলেন মাঠে বোধহয় কেউ ঢুকে পড়েছে। আসলে টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের ব্রায়ান জনস্টন রেডিও ধারাভাষ্যে শেফার্ডের এই কুসংস্কারের কথা বলছিলেন তখন। কেউ একজন জনস্টনকে লিখে পাঠিয়েছিলেন সেই টেস্টের আগে, '১১১-তে স্কোর গেলে এই গাধাকে দেখবেন একবার'।
এরপর থেকে শেফার্ড শুধু নিজের জন্য না, দর্শক বিনোদনের জন্যও নেলসন-লাফ দিতেন!
***
ভাইয়ের কাগজপত্রের দোকান, মা, ইনস্টো নামের শহর। ডেভিড শেফার্ডের শেকড় প্রোথিত সেখানেই। সেখান থেকেই কাউন্টি ক্রিকেট। গ্লসাস্টারশায়ারের হয়ে অভিষেক ১৯৬৫ সালে, অক্সফোর্ডের মাঠ দ্য পার্কে। অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছিলেন। ‘শেপ’ প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরি করেছিলেন আরও ১১টি। ২৮২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ, ১৮৩টি লিস্ট ‘এ’, সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ হাজার রান। তবে কোনোটিই যথেষ্ট ছিল না ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে। ১৯৭৯ সালে যখন শরীর আর সময় বাধা হয়ে দাঁড়ালো, ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন ডেভিড শেফার্ড। জহির আব্বাস, মাইক প্রক্টরের সাবেক সতীর্থ, গ্লসাস্টারশায়ারের হয়ে ১৩টি গ্রীষ্মে যিনি মিডল-অর্ডারে ব্যাটিং করেছিলেন, দর্শকদের কাছে যিনি ছিলেন ‘গুড ওল্ড শেপ’। কলিন মিলবার্নের অকাল মৃত্যুর পর শেফার্ডই ছিলেন যেন সেই অন্যরকমের পেশাদার ক্রিকেটারঃ হৃষ্টপুষ্ট, যিনি বল মারতে ভালবাসতেন। হৃষ্টপুষ্ট হলে কী হবে, ক্রিজে আর সবার মতোই দ্রুত দৌড়াতে পারতেন তিনি!
শেফার্ড ক্রিকেটার ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন, ক্রিকেটের নয়। ‘আসল’ ক্যারিয়ারয়টাই যে বাকি ছিল তখনও! সেই অক্সফোর্ডের মাঠ, দ্য পার্কেই দ্বিতীয় অভিষেক হয়ে গেল শেপের। ক্রিকেটার শেফার্ড বনে গেলেন আম্পায়ার। ১৯৮৫ সালে টেস্ট অভিষেকও হয়ে গেল।ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপেই।
স্কোর যখন নেলসন নাম্বারে!
১৯৮৫ থেকে ২০০১, প্রত্যেক বছরই ইংল্যান্ডের অন্তত একটি করে টেস্টে আম্পায়ারিং করেছিলেন শেফার্ড। ২০০২ সাল থেকে নিরপেক্ষ আম্পায়ারের নিয়ম চালু হয়ে গেল, শেফার্ডরা পড়লেন নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে। নিরপেক্ষ দেশ মানেই দেশভ্রমণের ঝক্কি, পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশ বিঁভুইয়ে পড়ে থাকা। শেফার্ড সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল শরীরকে ফিট রাখার লড়াইও।
সাইমন টফেল বলতেন, শেফার্ড হয়তো সবচেয়ে ফিট নন। তবে পাঁচদিন ম্যাচ চালিয়ে নেয়ার মতো ফিট ছিলেন তিনি, সেটা মুলতান বা মেলবোর্ন যেখানেই হোক না কেন। হয়তো এ কারণে বাড়তি এক সেশন জিমে কাটাতে হতো। টফেল থাকলে তাঁকেও রেখে দিতেন শেফার্ড, বিনিময়ে টফেল পেতেন আইসক্রিমের ‘ট্রিট’।
টফেল পেয়েছিলেন আইসক্রিমের ‘ট্রিট’, ক্রিকেটাররা পেয়েছিলেন এমন এক আম্পায়ার, যাঁর প্রতি সম্মানটা থাকবে অগাধ। আর ক্রিকেটদর্শক বা লেখকরা পেয়েছিলেন এক ‘টপিক’: ডেভিড শেফার্ডের কুসংস্কার। ডেভনে ক্লাব ক্রিকেটে খেলার সময় যেসব অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, আম্পায়ারিং শুরু করার পরও ছাড়েননি তা। নেলসন নাম্বার বা এর গুণিতকে পা তুলে ছোট লাফ দিতেন, যতোক্ষণ না স্কোরবোর্ড থেকে সেই স্কোরটা সরে যায়! ‘১৩’ নাম্বারটাও এড়িয়ে চলতেন, মাসের ১৩ তারিখে কেউ ফোন দিলেও ধরতেন না!
***
কুসংস্কার বাদ দিলে শেফার্ড ছিলেন পুরোদস্তুর এক আম্পায়ার। ক্রিকেটারদের যিনি সম্মান করতেন, যিনি বেশীরভাগ সিদ্ধান্ত সঠিক দিলেও করতেন ভুল। সবচেয়ে বেশী ভুল হয়েছিল ২০০১ সালে। হেডিংলিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচে দু'জন ইংলিশ ব্যাটসম্যানকে আউট দিয়েছিলেন, যেগুলো ছিল নো বল! টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল, এড়িয়ে গিয়েছিল শেফার্ডের চোখ। এরপর আম্পায়ারিংই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। জানা অজানা অনেকের কাছ থেকে এরপর চিঠি পেয়েছিলেন শেফার্ড, তিনি যেন ক্রিকেটকে ছেড়ে না যান! পাশে ছিল ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডও! ছাড়েননি শেষ পর্যন্ত। চালিয়ে গিয়েছিলেন আরও চার বছর।
ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই ছিল শেপের!
জুলাই ১৫, ২০০৫। ওভালের ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য ২২৯। ২২১ রানের পর ড্যামিয়েন মার্টিন একটা সিঙ্গেল নিলেন, শেফার্ড পেলেন নিজের কুসংস্কার মানার শেষ সুযোগ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সেটিই যে ছিল তাঁর শেষ ওয়ানডে। টেস্টকে বিদায় বলেছিলেন আরও আগে। আইসিসি লর্ডসে আলাদা ম্যাচ আয়োজন করতে চেয়েছিল, শেফার্ড না বলেছিলেন। বিদায় নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে, স্যাবাইনা পার্কে। ব্রায়ান লারা একটা ব্যাট উপহার দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘ধন্যবাদ। দায়িত্ব পালনের জন্য, পেশাদারিত্বের জন্য। আর অনেক স্মৃতির জন্য। অবসর উপভোগ্য হোক।’
৯২টি টেস্ট, ১৭২টি ওয়ানডে, ছয়টি বিশ্বকাপ, তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালে আম্পায়ারিং করা শেফার্ড অবসর জীবনে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ইনস্টোতে। যেখানে তাঁর শেকড়, যেখানে তাঁর ভাইয়ের দোকান। আর যেখানে ছিলেন তাঁর ২৬ বছরের জীবনসঙ্গী জেনি। যাঁকে বিয়ে করেছিলেন ২০০৮ সালে এসে।
ক্যান্সার ধরা পড়েছিল এরপর। দুই বছর ভুগে জীবনের বাইশ গজকে বিদায় বলেছিলেন ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর। জীবনের ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালের ২৭ ডিসেম্বর। মাঝে শেফার্ডের আরও দুইটা ক্যারিয়ার ছিল। ক্রিকেটার হিসেবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে না পারলেও আম্পায়ার শেফার্ড গিয়েছিলেন চূড়ায়। সাদা কোট পরে যিনি ঘুরেছিলেন বিশ্ব, ক্রিকেটের দায়িত্ব পালনে। অবশ্যই ক্রিকেটকে ভালবেসে।
***
সাইমন টফেল, আলিম দার, কুমার ধর্মসেনা, রিচার্ড কেটেলবোরো। আইসিসির বর্ষসেরা আম্পায়ার পুরষ্কার জিতেছিলেন এর আগে এই চারজনই। টফেল পাঁচবার, দার ও কেটেলবোরো তিনবার করে, একবার ধর্মসেনা। এবার জিতেছেন মারাই এরাসমুস। দক্ষিণ আফ্রিকান এই আম্পায়ারের রোল-মডেলদের একজন ডেভিড শেফার্ড। ২০০৯ সাল থেকে আইসিসি এরাসমুসদের জন্য এ পুরষ্কারের নামকরণ করেছে ডেভিড শেফার্ডের নামে। ডেভিড শেফার্ড, তাঁর চেয়ে বড় ‘রোল-মডেল’ আর কেই-বা হতে পারতেন এক্ষেত্রে!
এখনও হয়তো তাই একটা প্রজন্ম আম্পায়ারের কথা উঠলেই সবার আগে ভাবেন একটি নাম, ডেভিড শেফার্ড। মনে পড়ে সেই হৃষ্টপুষ্ট শরীরের মানুষটাকে, নেলসন নাম্বারে ছোট লাফ দেয়া সেই ভদ্রলোককে। যে ক্রিকেটকে ভালবাসতেন, সেই ক্রিকেটেরই এক চূড়ায় তো পৌঁছেছিলেন ডেভিড রবার্ট শেফার্ড।