বিশ্বকাপকে যিনি হ্যাটট্রিক চিনিয়েছিলেন
ইনজুরি। শব্দটা ছোট হলেও পরিণতি হতে পারে বিধ্বংসী। নিমিষেই কালের অতলগর্ভে হারিয়ে পেতে এমন কোনো প্রতিভাবান, যার কিংবদন্তী হওয়া ছিল সময়ের দাবি। পায়ের কারিকুরিতে দর্শকদের চোখ ছানাবড়া করা তারকা হয়ে যায় দীর্ঘশ্বাসের পাত্র। ইনজুরির নিষ্ঠুর কষাঘাত থেকে বাদ যাননি রোনালদো, বাস্তেনদের মত কিংবদন্তীরাও। ফরাসী কিংবদন্তী জাঁ ফন্টেইনের তো ক্যারিয়ারই ছিনিয়ে নিয়েছে। সেই ’৫৮ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে করেছিলেন ১৩ গোল, প্রায় দশক ছয়েক পর আজো রেকর্ডটি অক্ষুণ্ন আছে স্বমহিমায়। জাঁ ফন্টেইনের মত আছেন আরো একজন, একটিমাত্র বিশ্বকাপ খেললেও যিনি সামর্থ্যের জানানটা ঠিকই দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম হ্যাট্রট্রিকটাও এসেছিল তাঁর পা থেকেই, তাও আবার অভিষেকেই। নাম তার গিলের্মো স্তাবিল, যাঁর অনবদ্য প্রদর্শনে প্রথম বিশ্বকাপটা ঘরে প্রায় তুলেই নিয়েছিল আর্জেন্টিনা।
স্তাবিলের ক্লাব ফুটবলে আসার ঘটনাটা বেশ চমকপ্রদ। এখানে-সেখানে ‘খ্যাপ’ খেলেই প্রথম নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে থাকেন ‘দ্যা ফিল্টার’ খ্যাত এই স্ট্রাইকার। নিজ শহর পার্ক প্যাট্রিসিও এবং পুয়ের্তো মাদেইরোর এক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন স্তাবিল। ম্যাচটি দেখতে মাঠে এসেছিলেন আর্জেন্টিনার অন্যতম বড় ক্লাব হুরাকানের স্কাউটরা। ম্যাচ শেষেই স্তাবিল পরিবারের সাথে কথা বলে নেয় তারা। দিন আনতে দিন ফুরায়, এমতাবস্থায় ছেলে যদি নেশাকে পেশা বানিয়ে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে আসে, ক্ষতি কি- এমনটা ভেবেই হুরাকানের প্রস্তাবে সম্মতি জানায় স্তাবিলের পরিবার। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই হুরাকানের মূল দলে জায়গা করে নেন স্তাবিল। ১৯২৪ থেকে ১৯৩০- ৬ বছরে হুরাকানের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বনে যান স্তাবিল। মাত্র ১২০ ম্যাচে লক্ষ্যভেদ করেন প্রায় শতাধিকবার, লিগ জিতেছিলেন দুবার।
এতকিছুর পরও আর্জেন্টিনার মূল দলে জায়গা করে নিতে পারছিলেন না। হুরাকানের হয়ে মাঠ কাঁপালেও জাতীয় দলে জায়গা না পাওয়ার মূল কারণ ছিল ‘লা আলবিসেলেস্তে’ দের বিশ্বজোড়া প্রতাপ। বছর দুয়েক ধরে জাতীয় দলের কড়া নাড়া স্তাবিলের জন্য মাহেন্দ্রক্ষণটা আসে প্রথম বিশ্বকাপে। চেরো, ফেরেরাদের নিয়ে সাজানো আর্জেন্টিনার দলে একজন স্ট্রাইকারের জায়গা পাওয়াটা ছিল অনেক কঠিন। নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাছে যখন স্তাবিলের হার আসন্ন, তখনই ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকান এই স্ট্রাইকারের দিকে। বিশ্বকাপ শুরু হতে না হতেই মানসিক চাপে ভেঙ্গে পড়েন রবার্তো চেরো। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই স্ট্রাইকারের আকস্মিক এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনে মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান স্তাবিল। মেক্সিকোর বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় স্তাবিলের। দেশের হয়ে প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে বসেন তিনি। চিলি, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে পরবর্তী দুই ম্যাচে করেন জোড়া গোল। ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে প্রথমার্ধ শেষে স্তাবিলের গোলেই লিড নিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু শেষমেশ ৪-২ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় স্তাবিলদের।
বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে ইতালির জেনোয়াতে পাড়ি জমান স্তাবিল। জেনোয়াতেও অভিষেকে হ্যাটট্রিক করেন তিনি। শোনা যায়, স্তাবিলের খেলায় মুগ্ধ কিংবদন্তী ফ্যাসিবাদী নেতা মুসোলিনী স্তাবিলকে ’৩৪ বিশ্বকাপে ইতালির জাতীয় দলে খেলার প্রস্তাব দেন। মুসোলিনীর ভয়ে নত না হয়ে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন স্তাবিল। কিন্তু ’৩১ এবং ’৩৩-এ দুবার মারাত্মক ইঞ্জুরিতে পড়ে আন্ত্জাতিক পর্যায়ে আর খেলাই হয়নি স্তাবিলের। বিশ্বকাপের পরপরই জেনোয়া ছেড়ে নাপোলিতে পাড়ি জমান এই আর্জেন্টাইন। কিন্তু আগের ক্ষুরধার ফর্মটা আর ফিরে পাননি।
অবসরের পর কোচ হবেন- স্তাবিলের স্বপ্নটা ছিল এমনই। কিন্তু এর আগেই স্বপ্নটা পূরণ হয় স্তাবিলের। ৩১-৩২ মৌসুমে লুইজ বার্লান্দোর সাথে জেনোয়ার কোচ হন তিনি। ইতালিয়ান ও বিশ্বফুটবলে ‘প্লেয়ার-ম্যানেজার’ দের অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন স্তাবিল। রেড স্টার প্যারিসেও খেলোয়াড়ের পাশাপাশি চার বছর কোচের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ইঞ্জুরির কাছে হার মেনে ফুটবলকে ১৯৩৯ সালে বিদায় জানান ‘এল ফিল্টাদোর’। অবসরের পর দেশে ফিরে এসে স্যান লরেঞ্জোর দায়িত্ব নেন।
স্তাবিলের স্বপ্ন ছিল আর্জেন্টিনার মূল দলের কোচ হওয়া। অবসরের মাত্র বছরখানেক পরই বাস্তবতায় পরিণত হয় তাঁর সেই স্বপ্ন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৬০- সুদীর্ঘ ২১ বছর আর্জেন্টিনার দায়িত্বে ছিলেন স্তাবিল। এর পাশাপাশি হুরাকান, রেসিং-এরও কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রেসিংকে লিগও জিতিয়েছিলেন টানা তিনবার। তাঁর অধীনে আর্জেন্টিনা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর ছিল, তার একটা উদাহরণ দিই। আর্জেন্টিনাকে ৮টি দক্ষিণ আমেরিকা চ্যাম্পিয়নশিপের(এখনকার কোপা আমেরিকা) মূল আসরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ৬টিতেই! এর মধ্যে আবার ১৯৪৫-১৯৪৭ পর্যন্ত শিরোপা জিতেছিলেন টানা তিনবার! স্তাবিলের অধীনেই ’৪৬-এর কোপা আমেরিকা জিতেছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, যা ছিল ‘দ্যা ব্লন্ড অ্যারো’র একমাত্র আন্তর্জাতিক শিরোপা।
বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ- ইউরোপের অন্যতম সেরা এই দুই দলের মূলে আছে দুই আক্রমণভাগ; ‘এমএসএন’ এবং ‘বিবিসি’। স্তাবিলের এহেন ঈর্ষন্বীয় সাফল্যের পেছনেও অন্যতম কৃতিত্ব ছিল ‘লা ম্যাশিনা’ (যন্ত্রমানবের দল) এবং ‘লস কারাসুকিয়াস’ (কদাকার ফেরেশতারা) নামক দুই আক্রমণভাগের। মুনোজ, মরেনো, লুস্টাওদের নিয়ে সাজানো দলটিকে এখনো আর্জেন্টিনার অন্যতম আক্রমণাত্মক দল হিসেবে ধরা হয়। চল্লিশের দশকে মুনোজ, মরেনোদের বদান্যতায়ই টানা ৩ বার কোপা আমেরিকা জেতে আর্জেন্টিনা। ’৪৬ এর কোপায় এঁদের সাথে ছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানোও। অবসরের সময় মুনোজ, স্টেফানোরা আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগের ব্যাটনটা দিয়ে যান সিভোরি, মাশিও, কারবাতাদের হাতে। ৫০-এর দশকে আর্জেন্টিনার কোপা সাফল্যের মূল কান্ডারি ছিল ‘লস কারাসুকিয়াস’রাই।
কোচ স্তাবিল
জীবনখেলায় মুদ্রার দুপিঠ দেখতে হয় সবাইকেই। স্তাবিলও বাদ যাননি। কোচিং ক্যারিয়ারে সবচেয়ে খারাপ সময়টা যায় ’৫৮ বিশ্বকাপে। ’৩৪-এর পর তিনটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণে অপারগতা জানায় আর্জেন্টিনা। বিশ্বযুদ্ধ দুইয়ের কারণে পরবর্তী দুই বিশ্বকাপেও অংশ নেয়নি তারা। দুই যুগ পর ’৫৮ বিশ্বকাপে খেলতে আসে আর্জেন্টিনা। কিন্তু প্রত্যাবর্তনটা স্মরণীয় করে রাখতে পারেনি তারা। চেকোস্লোভাকিয়ার কাছে ৬-১ এবং পশ্চিম জার্মানীর কাছে ৩-১ গোলে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে স্তাবিলের ‘আলিসেলেস্তে’রা। দুঃখ, অপমানে পদত্যাগই করেন স্তাবিল। কিন্তু নিজ মানুষদের ভালবাসায় পরের বছরই ফিরে আসেন তিনি। এসেই আর্জেন্টিনাকে প্যান আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতান তিনি। পরের বছর আবারো পদত্যাগ করেন স্তাবিল। তাঁর প্রস্থানের পর কেবলমাত্র দুবার (’৯১ এবং ’৯৩) কোপা আমেরিকা জিততে পেরেছিল আর্জেন্টিনা।
ফুটবলটা তাঁর কাছে কখনোই ট্যাকটিকাল কিছু ছিল না। সর্বদাই মনে করতেন, ট্যাকটিক্সের চেয়ে মাঠে খেলোয়াড়দের পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে ফলটা ভাল হবে। বলতে গেলে ফুটবলের ‘ম্যান ম্যানেজমেন্ট’ এরও পথপ্রদর্শক তিনিই। ইউরোপীয়ান ফুটবলটা ট্যাকটিক্সের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়ায় আর ইউরোপে ফিরে যাননি। জীবনের বাকিটা সময় কাটিয়েছিলেন স্কাউট হিসেবেই। তাঁর অবসরেই সমাপ্তি ঘটে আর্জেন্টিনার রোমান্টিক ফুটবলারদের যুগ ‘লা নুয়েস্ত্রা’র।
জীবদ্দশায় দেশকে বিশ্বকাপ জিততে দেখেননি। স্তাবিলের মৃত্যুর (’৬৬) প্রায় এক যুগ পর ’৭৮-এ নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। দেশকে প্রথমারের মত সোনার ট্রফিটি জেতান কোচ সিজার মেনোত্তি, হুরাকানে স্তাবিলের শিষ্য ছিলেন তিনি। নিজেদের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মূহুর্তটা গুরুকেই উৎসর্গ করেন মেনোত্তি। ইঞ্জুরি আক্রান্ত ক্যারিয়ারে স্তাবিল প্রতিভার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি পুরোপুরি, কিন্তু তা পুষিয়ে নিয়েছেন কোচ হিসেবে সাফল্যের ফুলঝুড়িতে। তবে এতসব সাফল্য ছাপিয়ে গিলের্মো স্তাবিলকে আর্জেন্টিনাবাসী মনে রাখবে সেই ‘ডেমিগড’ হিসেবেই, ১৯৩০ সালে মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে বুয়েন্স আইরেসের যে টগবগে তরুণ হয়ে উঠেছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলের ‘পোস্টার বয়’...