ক্রিকেট-ধর্মের দেশের প্রথম সব টেস্ট
ক্রিকেট সেখানে ধর্মের মতো। দর্শক, উইকেট মিলিয়ে ভারত যেমন অন্যান্য দলগুলোর জন্য কঠিন এক পরীক্ষার নাম, তেমনি নাম এক রোমাঞ্চেরও। নিজেদের প্রথম টেস্টটা সেই ভারতের সঙ্গে খেললেও তাদের মাটিতে গিয়ে এতোদিন বাংলাদেশ খেলেনি কোনো টেস্ট। বাংলাদেশের প্রথম ভারত-টেস্টের আগে তাই অন্য দলগুলোর প্রথম টেস্টগুলোর দিকে চোখ বুলানো...
জিমখানায় শুরু, জিমখানার শেষ
রঞ্জিৎসিনজি মারা গেলেন ১৯৩৩ সালে। সে বছরই টেস্ট ক্রিকেট প্রথমবারের মতো এলো ভারতে। মুম্বাইয়ের (তখনকার বোম্বে) জিমখানা গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ড তাদের ভারত সফরের ১৬তম ম্যাচটা খেলতে নামলো। সেই জিমখানা গ্রাউন্ড ইউরোপিয়ানদের জন্য আলাদা করে তৈরী করা হয়েছিল। এই মাঠে চাকর-বাকর ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিলনা কোনো ভারতীয়র, এমনকি রঞ্জিৎসিনজিরও না। সেসব নিয়ম শিথিল হয়ে এলো ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্টের আগে। কোনো গ্যালারি নেই, দর্শকদের জন্য টানানো হলো শামিয়ানা। ১৫ ডিসেম্বর টেস্ট শুরুর দিন জিমখানার টিকেটের দাম বেড়ে হলো স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচগুণ। ইতিহাস দেখতে এলো ৫০ হাজার দর্শক। ব্রায়ান ভ্যালেন্টাইনের সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে ২১৯ রানের লিড নিয়ে সেই দর্শকদের যেন হতাশই করলো ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে লালা অমরনাথ ও সিকে নাইডুর জুটির (১৮৬) খবর ছড়িয়ে পড়লো, শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যাঁরা রাতের মধ্যেই এলেন মুম্বাইয়ে, হতাশ হলেন সকালে উঠে। চতুর্থ দিনে ইংল্যান্ডকে মাত্র ৪০ রানের লক্ষ্য দিতে পারলো ভারত, তবে এর আগে ভারতের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিটা পেয়ে গেলেন লালা অমরনাথ (১১৮)। নিজের সেরা ইনিংস তিনি মনে করতেন এটিকেই। ‘পিতা’ অমরনাথ আর সেঞ্চুরি পাননি, মুম্বাইয়ের জিমখানা মাঠেও আর কোনো টেস্ট বা আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়নি। বিশ্বযুদ্ধের পর মুম্বাইয়ের ক্রিকেট চলে ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে, আর জিমখানা হয়ে রইলো ইতিহাসের সাক্ষী।
হেমুর প্রতিরোধ
লালা অমরনাথ তখন ভারতের অধিনায়ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের পর ক্রিকেট ফিরলো ভারতে, জন গোড্ডার্ডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমবার ভারতে এলো পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে। ওয়ালকট, গোমেজ, উইকস, ক্রিস্টিয়ানির সেঞ্চুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করলো তখনকার বিশ্বরেকর্ড ৬৩১ রান। চতুর্থ দিনে এসে অল-আউট হলো ভারত; সাত নম্বরে নামা হেমু অধিকারির সেঞ্চুরির (১১৪*) পরও পড়তে হলো ফলো-অনে। তবে দুইদিনের ব্যবধানেই ভারতকে দুইবার অল-আউট করার কাজটা কঠিনই হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দ্বিতীয় ইনিংসে গোড্ডার্ড ব্যবহার করেছিলেন নয়জন বোলার। তবে শেষবেলার উত্তেজনা মিইয়ে দিলেন ওই অধিকারিই, সাথে পেলেন চান্দু সারওয়াতেকে। ড্র হলো দিল্লী টেস্ট।
মানকড়ে ছিন্ন পাকিস্তান
আবদুল হাফিজ কারদার ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের হয়ে খেলতেন আব্দুল হাফিজ নামেই। ‘দেশভাগ’ হলো, কারদার খেলা শুরু করলেন পাকিস্তানের হয়ে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রথম টেস্টে নেতৃত্ব দিলেন তিনিই, পুরোনো সতীর্থ আমির এলাহিকেও পেলেন সঙ্গে। ভারতের অধিনায়ক তখনও লালা অমরনাথ। বিজয় হাজারে আর হেমু অধিকারির পর ১১ নম্বরে নেমে হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন গুলাম আহমেদ। দশম উইকেট পার্টনারশিপটাও ছিল ১০৯ রানের। ভারতের প্রথম ইনিংসের ৩৭২ রান পাকিস্তান টপকাতে পারলো না দুই ইনিংস মিলিয়েও। মূল আঘাতটা হেনেছিলেন ভিনু মানকড়। প্রথম ইনিংসে হানিফ মোহাম্মদ ও নজর মোহাম্মদের ৬৪ রানের জুটি রান আউটে ভাঙ্গার পর শুরু হয়েছিল মানকড়-যাদু, থেমেছিলেন ৫২ রানে ৮ উইকেট নিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসেও মানকড়ের বাঁহাতি স্পিনের জবাব খুঁজে পাননি পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা। মানকড় এবার নিলেন ৫ উইকেট, ৭৯ রানের বিনিময়ে। প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান করেছিল আর ২ রান বেশি।
হায়দরাবাদ : নিউজিল্যান্ডের ভারতীয় ভেন্যু!
দুই দলের মধ্যে প্রথম টেস্ট। ভেন্যু হায়দরাবাদের ফতেহ ময়দান। পলি উমরিগরের ডাবল সেঞ্চুরি (২২৩), ভারতের হয়ে প্রথম। ভারত ৪ উইকেটে ৪৯৮ রান নিয়ে যতক্ষণে ইনিংস ঘোষণা করলো, হয়ে গেছে আরেকটি রেকর্ড। ভারতের তখনকার সর্বোচ্চ স্কোর। প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ড পড়লো সুভাষ গুপ্তের লেগস্পিনের তোপে। ৭৬.৪ ওভার বোলিং করলেন গুপ্তে, ১২৮ রান খরচায় নিলেন ৭ উইকেট। ৩২৬ রান করে অল-আউট নিউজিল্যান্ড পড়লো ফলো-অনে। দ্বিতীয় ইনিংসেও প্রথম আঘাতটা হানলেন গুপ্তেই, ম্যাচের পঞ্চম সেঞ্চুরি করে অবশ্য ম্যাচ ড্র-ই করতে সহায়তা করলেন বার্ট সাটক্লিফ (১৩৭*)। হায়দরাবাদের ফতেহ ময়দানের নাম এরপর বদলে হয়েছে লাল বাহাদুর শাস্ত্রি স্টেডিয়াম, টেস্ট হয়েছে আর দুইটি। দুইটিতেই ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল সেই নিউজিল্যান্ডই!
বেনোর স্পিন, লিন্ডওয়ালের পেস
সুভাষ গুপ্তের লেগস্পিনের তোপে পড়েছিল কিউইরা, এবার ভারতই পড়লো আরেক লেগস্পিনারের তোপে, রিচি বেনো। মূল তিন অজি পেসার ভারতের মাটির প্রথম টেস্টে নামতেই পারেননি, আরেকজন পাঁচ ওভার বোলিং করেই উঠে গিয়েছিলেন পেট গড়বড় করায়। কিন্তু বেনো ছিলেন, স্বাগতিকরা তাঁর ৭২ রানে ৭ উইকেটের বোলিং ফিগারেই গুটিয়ে গিয়েছিল ১৬১ রানে। তবে গুলাম আহমেদ আর ভিনু মানকড়ের নিয়ন্ত্রিত স্পিনে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া হারিয়ে ফেলেছিল ৮ উইকেট, লিড তখন মাত্র ৩৯ রানের। উদ্ধারকর্তা হয়ে এলেন নয় নম্বরে নামা অধিনায়ক ইয়ান জনসন, ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টের আগের এই টেস্টে তিনি পেয়েছিলেন নিজের ষষ্ঠ ফিফটি। শেষ দুই উইকেটে ১১৯ রান যোগ করেছিলেন জনসন; প্যাট ক্রফোর্ড ও ল্যাংলিকে সঙ্গে নিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত গুটিয়ে গেল ১৫৩ রানে, ত্রিশের কোঠা পেরোতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান। প্রথম ইনিংসে উঠে যাওয়া পেসার রে লিনডওয়াল নিয়েছিলেন বেনোর মতোই ৭ উইকেট, মাত্র ৪৩ রান খরচায়।
সব ছাপিয়ে মেন্ডিস
ভারতের সঙ্গে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি এর আগে ছিল শুধু ডন ব্র্যাডম্যান ও এভারটন উইকসের। সে তালিকায় যুক্ত হলেন দুলিপ মেন্ডিস। চেন্নাইয়ে রানপ্রসবা টেস্টের দুই ইনিংসেই মেন্ডিস করেছিলেন ১০৫ রান করে। প্রথম ইনিংসে ৩৪৬ রানে অল-আউট হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কাকে যেন এরপর ব্যাটিং শেখাতে নেমেছিলেন গাভাস্কার- ভেংসরকার-সন্দীপ প্যাটেলরা। ওভারপ্রতি ৪.৩২ হারে ভারত ইনিংস ঘোষণার আগে তুলেছিল ৫৬৬ রান, ৬ উইকেটে। শ্রীলঙ্কাও যেন কম যায় না, ৪.০৮ হারে ৩৯৪ রান তুলে ভারতকে দিল আকর্ষণীয় এক লক্ষ্য, ১৭৫ রানের। বাধ্যতামূলক ২০ ওভারের সঙ্গে ভারতের হাতে ছিল ৫৩ মিনিট। রোমাঞ্চকর এক জয়ের দিকেই ছুটছিল ভারত, কপিল দেব ও সন্দীপ প্যাটেলের ব্যাটে। তবে দুজন ফিরলেন দ্রুত, রেকর্ড ১৪৪১ রানের টেস্টটাও তাই হলো ড্র।
কাম্বলির টেস্ট
স্কোরকার্ড বলছিল জিম্বাবুয়ে ২৭৫, ৩ উইকেটে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ১১৫, গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ৯৬, দুজনই অপরাজিত। চতুর্থ দিন, লাঞ্চের পর আধা ঘন্টাখানেক পার হয়েছে তখন। ড্রয়ের দিকে এগুচ্ছে দিল্লী টেস্ট। হঠাৎ করেই যেন আফ্রিকার মরুভূমির কোনো উষ্ণ বাতাস এসে এলোমেলো করে দিল সব, ৩২২ করেই অলআউট হল জিম্বাবুয়াইনরা। চা বিরতির পর জিম্বাবুয়ে ব্যাটিংয়ে নামলো দ্বিতীয়বার। প্রথম ইনিংসে মনিন্দর সিংকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে মারতে গিয়ে জিম্বাবুইয়ান ধ্বস শুরু করা অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন ৬২ রান করে, তবে ইনিংস ও ১৩ রান ব্যবধানে পরাজয়টা ঠেকাতে পারেননি। ভারতের ৫৩৬ রানের প্রথম ইনিংসটা ছিল অবশ্য প্রায় একজনেরই গল্প, বিনোদ কাম্বলি। ২৮ চারে, প্রায় সাড়ে পঁচাত্তর স্ট্রাইক রেটে ক্যারিয়ার সেরা ২২৭ রানের ইনিংসটা যে সেবারই খেলেছিলেন ভারতের ‘আক্ষেপ-বালক’!
স্পিনরাজ্যে পেসার রাজা
ভারতের সঙ্গেই দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের ‘দ্বিতীয় অভিষেকের’ প্রথম ওয়ানডেটা খেলেছিল, ১৯৯১ সালে। তবে ভারতের মাটিতে টেস্ট খেলার জন্য আফ্রিকাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও বছর পাঁচেক। ভিভিএস লক্ষণের অভিষেক টেস্ট, অধিনায়ক শচীন টেন্ডুলকার। ভারতের প্রথম ইনিংসে কোনো ফিফটি নেই, তবে তাঁদের ২২৩ রান ছাপিয়ে আফ্রিকা করতে পারলো ২৪৪। আহমেদাবাদের ‘চিরায়ত’ ভারতীয় উইকেটে প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট নিলেন স্পিনার সুনীল যোশি। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯০ রান করে মুখ থুবড়ে পড়লো ভারত, অ্যালান ডোনাল্ডের পেস আর পল অ্যাডামসের চায়নাম্যানে। তবে আফ্রিকাও যেন অপেক্ষা করে ছিল আরও সশব্দে মুখ থুবড়ে পড়ার জন্য। দৃশ্যপটে এলেন পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ, তাঁর ২১ রানে ৬ উইকেট আফ্রিকাকে গুটিয়ে দিল ১০৫ রানে; জয় থেকে ৬৪ রান দূরে থাকতেই। বেশ কয়েকটি ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্ত দিয়ে দৃশ্যপটে অবশ্য ছিলেন আম্পায়ার শ্যাম বানশালও।