সেদিনের এই দিনে: জোহানেসবার্গ জমজমাট
সে এক ম্যাচ আছে, কেবলই লাবণ্য ধরে।
জোহানেসবার্গে সেদিন যা হয়েছিল, ২২ গজে তার আগে-পরে আর সেরকম হয়নি। আন্তর্জাতিক ম্যাচ দূরে থাক, ক্লাব ক্রিকেট, এমনকি গলির ক্রিকেটেও কি এমন হয়? ৫০ ওভারের ম্যাচে ৪০০র বেশি স্কোরই দেখেনি তখন, সেখানে একদিনেই সেই এভারেস্টে পতাকা গাড়ল দুই দল। অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ রান তাড়া করে দক্ষিণ আফ্রিকা ১ বল হাতে রেখে জিতবে, সেটির পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষে কি কেউ বাজি ধরার সাহস করেছিলেন?
না করারই কথা। যে রেকর্ডটা ১০ বছর ধরে অনতিক্রম্য ছিল, সেটি গড়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে যাওয়া তো হ্যারি পটারের ভোজবাজির রাজ্যেও কল্পনা করা কঠিন। অস্ট্রেলিয়া যখন টসে জিতে ব্যাটিং ছিল, শুরুর পরও কেউ ভাবতে পারেনি ৪০০ হয়ে যাবে। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর সাইমন ক্যাটিচ শুরুটা বেশ ঝড়োই করেছিলেন, প্রথম ১৫ ওভারে রানের গড়ও প্রায় ছয়। কিন্তু সেখান থেকে কত আর হবে? বড়জোড় ৩৫০ বা খুব বেশি হলে ৩৮০।
কিন্তু সবকিছু বদলে গেল রিকি পন্টিং নামার পর। দেখতে দেখতে রানরেটের গ্রাফটা ওপরে উঠছে তো উঠছেই, ২৯ ওভার শেষে রান হয়ে গেল ২০০। তারপরও বাকি ২১ ওভারে আর কত হবে? টি-টোয়েন্টির ধরনে ব্যাট করলেও তো ৪০০র বেশি হওয়ার কথা নয়। পন্টিং প্রথম ৫০ করতে ৪৩ বল খেলে ‘একটু বেশিই’ সময় নিয়ে ফেলেছিলেন। রানের ফোয়ারা ছুটল ক্যাটিচ আউট হওয়ার পর। মাইক হাসি ক্রিজে নামলেন, পন্টিংয়ের সাথে মিলে শুরু করলেন প্রলয়নাচন। দুজন পরের ১৫.৪ ওভারে তুললেন ১৫৮ রান। অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়ে ওঠার বড় ভূমিকা যিনি রাখতে পারতেন, সেই অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসই খেলতে পারলেন মাত্র ১৩ বল। অবশ্য এর মধ্যেই ২৭ রান করে দলের স্কোর ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। ৫০ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর দাঁড়াল ৪৩৪, পন্টিং একাই করলেন ১৬৪। এই মাঠেই ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি করলেন, সেটাও এদিনের মতো ঝোড়ো ছিল না। পন্টিং কি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন, এই ইনিংস এভাবে বৃথা যাবে?
গ্রায়েম স্মিথ হয়তো ভেবেছিলেন। অসম্ভব তাড়া করে যেরকম একটা শুরুর কথা, ঠিক সেরকম হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। দ্বিতীয় ওভারেই আউট বোয়েটা ডিপেনার। তবে রক্ষণাত্মক ডিপেনারের আউটা বোধ হয় শাপেবর হলো আফ্রিকার জন্য। এরপর স্মিথ শুরু করলেন সংহারমূর্তি, দেখতে দেখতে ৫৫ বলে তুলে ফেললেন ৯০ রান। সেঞ্চুরিটা যখন মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার, তখনই আউট হয়ে গেলেন ক্লার্কের বলে। দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য ২২ ওভারে করে ফেলেছে ১৯০, অসম্ভবটা হঠাৎ করেই তখন বাস্তব।
সেই কৃতিত্বটা হার্শেল গিবসেরই বেশি। সাত বছর আগে এই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেই স্টিভ ওয়াহর ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন। সেই আফসোসটা গিবস শেষ পর্যন্ত ভুলেছিলেন এই ম্যাচে শেষে। ১১১ বলে ১৭৫ রানের ইনিংসে ম্লান করে দিলেন পন্টিংকেও। গিবস যখন আউট হলেন, জোহানেসবার্গ পেয়ে গেছে অলৌকিকের গন্ধ। ১৯ ওভারে ১৩৭ রান দরকার, হাতে উইকেট ছয়টি। ম্যাচ তো তখন দক্ষিণ আফ্রিকার।
কিন্তু তখনও বাকি ছিল অনেক কিছুর। ক্যালিস খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না, বিগ হিটার জাস্টিন কেম্পও বিদায় নিলেন। মার্ক বাউচার একা কী-ই বা করবেন? বাউচারকে দোসর বানিয়ে কুশীলব হয়ে গেলেন ইয়োহান ভ্যান ডার ওয়াথ। লুইসকে পর পর দুই ছয় মারলেন। ২২ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার ৩৬, পাল্লা আবার তাদের দিকে হেলে।
কিন্তু ৪৭তম ওভারেই ব্র্যাকেনের বলে আউট হয়ে গেলেন ভ্যান ডার ওয়াথ। এক ওভার পরে আউট রজার টেলেমেকাসও, দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ ওভারে দরকার ৭ রান। হাতে আছে দুই উইকেট। প্রথম বলে এক রান নিলেন বাউচার, দ্বিতীয় বলে হলের চার। চার বলে দরকার দুই রান। কিন্তু পরের বলে হল আউট, ক্রিজে শেষ ব্যাটসম্যান এনটিনি। পরের বলে এনটিনির সিঙ্গেল, স্ট্রাইক পেলেন বাউচার। লিকে পরের বলে চার মেরে শেষ করলেন সব নাটকীয়তার।
কিন্তু জোহানেসবার্গে সেদিন অমন ‘ভূতুড়ে’ কান্ড হয়েছিল কীভাবে? এমনিতেই উচ্চতার কারণে এই মাঠে বল একটু দ্রুতই আসে, কিন্তু ওয়ান্ডারার্সে সেটাই তো প্রথম ম্যাচ ছিল না। এরপর আরও ম্যাচ হয়েছে, এমন পাগুলে কাণ্ডও তো হয়নি। আর সেজন্য গ্লেন ম্যাকগ্রা আর শন পোলককেও একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। দুই জন ম্যাচটা খেলতে পারলে কে জানে এমন কিছু হয়তো হতোই না!