সেদিনের এই দিনে: ১ বলে ২২ রানের প্রহসন
স্কোরকার্ডের দিকে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন দুজন। ডিজিটাল বোর্ডে জ্বলজ্বল করে লেখা, দক্ষিণ আফ্রিকার জেতার জন্য ১ বলে লাগবে ২২ রান! দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন বোধ হয় নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একটু আগেই তো ছিল সেখানে লেখা ছিল ১৩ বলে ২২ রান। ভোজবাজির মতো সেটা ১২ বল কমে গেল! নোঙরে জাহাজ ভেড়ানোর যখন খুব কাছাকাছি দক্ষিণ আফ্রিকা, তখন এক ঝড় এসে যেন সেই জাহাজকে নিয়ে গেল মাঝদরিয়ায়। প্রহসনের বৃষ্টি আইন দুর্দান্ত এক ম্যাচের শেষে আক্ষরিক অর্থেই যেন ঢেলে দিল জল।
১৯৯২ বিশ্বকাপে অনেক দিন দিক দিয়েই উড়েছিল নতুনের কেতন। রঙিন পোশাক, সাদা বল, ফ্লাডলাইটের আলোয় খেলা- বিশ্বকাপের রঙটাই যেন বদলে গিয়েছিল সেবার। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বৃষ্টি আইনই ভজকট পাকিয়ে দিল ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার সেমিফাইনালে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যও তো বিশ্বকাপটা ছিল অন্যরকম। বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তির পর প্রথম কোনো বিশ্বকাপে নিজেদের প্রমাণও করে যাচ্ছিল শুরু থেকেই। সেমিফাইনালে টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলস। বৃষ্টি ম্যাচের আগেই জানান দিয়েছিল, সুযোগ পেলেই বাগড়া দিয়ে যাবে। খেলা শুরু হতেও কিছুটা দেরি হয়। ইংল্যান্ডও ৫০ ওভারের বদলে ব্যাট করার সুযোগ পায় ৪৫ ওভার। ৮৩ রান করে সামনে থেকে পথ দেখিয়েছিলেন গ্রায়েম হিক, ইংল্যান্ড ৪৫ ওভারে শেষ পর্যন্ত করতে পারে ২৫২ রান।
ওভারপ্রতি পাঁচেরও বেশি। এখন যতই সহজ শোনায়, তখন সেরকম পরিস্থিতি ছিল না মোটেও। ৩০০ রান তাড়া করে জেতাই তো ছিল অসম্ভব। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা শুরু থেকেই জানিয়ে দিচ্ছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যাবে। শুরুটা সবাই খুব ভালো করেছিলেন, তবে কেউই খুব বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। ২০৬ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর জয়ের স্বপ্নটাও একটু হয়তো ফিকে হয়ে এসেছিল।
তবে ম্যাকমিলান ও রিচার্ডস হাল ছেড়ে দেননি। সপ্তম উইকেটে দুজন ২৬ রানের জুটিও গড়ে ফেলেছিলেন। একটা সময় আফ্রিকার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ১৩ বলে ২২। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ঠিক তখনই বেরসিকের মতো থাবা দেয় বৃষ্টি।
কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য সেটি থেমে যায়। সিডনির লাউডস্পিকারের ঘোষণা শুনে স্তম্ভিত দর্শকেরা, দক্ষিণ আফ্রিকার ৭ বলে দরকার ২২ রান। গ্যালারি থেকে ভেসে আসতে থাকে দুয়ো, মেজাজ হারিয়ে অনেকেই ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন বোতল। কিন্তু নাটকের সেটা তো কেবল শুরু। একটু পরেই আবার জানানো হয়, আসলে ১ বলে দরকার ২২ রান। দর্শকেরাও তখন বুঝে উঠে পারছিলেন না আসলে ঠিক কী হয়েছে। হতভম্ব ম্যাকমিলান শেষ বলটা খেললেন কোনোমতে। সিডনির কালো আকাশ তখন ছেয়ে গেছে বিভ্রান্তির মেঘে।
কিন্তু ১৩ বল থেকে মাত্র ১ বলে নেমে এসেছিল কেন? বৃষ্টি আইনে তখন নিয়ম ছিল, ম্যাচের প্রথমে ব্যাটিং করা দলের যেসব ওভারে সবচেয়ে কম রান উঠবে, তাড়া করা দল থেকে সেই ওভারগুলো প্রথমে কেটে ফেলা হবে। ১২ মিনিট খেলা পণ্ড হয়েছে, সেই হিসেবে দুই ওভার কেটে ফেলার কথা। ইংল্যান্ডের ইনিংসে ঠিক দুই ওভারই মেডেন ছিল, ওই হিসেবে ২২ রান থেকে আর কোনো রান কমেনি। (যদিও এখানে একটা ভুল আছে, আসলে একটা লেগ বাইকে হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার লক্ষ্য ছিল আসলে ১ বলে ২১ রান)।
তার চেয়েও বিস্ময়কর, ওই দিন ম্যাচ শেষ হওয়ার একদম শেষ সময় ছিল ১০টা বেজে ১০। কিন্তু এতশত নাটকের শেষে সিডনির ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছিল ১০ টা বেজে ৮। চাইলে ওই দুই ওভার খেলাই যেত। এমনকি বৃষ্টির জন্য রিজার্ভ ডেও ছিল, কিন্তু চ্যানেল নাইন পরের দিন খেলা নিয়ে না যাওয়ার ব্যাপারে গোঁ ধরে ছিল। সেরকম কিছু হলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকমও হতে পারত। কে জানে, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে এসেই হয়তো বাজিমাত করে ফেলত দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু আয়োজকদের গোয়ার্তুমি আর প্রহসনের আইন সবকিছু ওলট পালট করে দিল। এরপর ডাকওয়ার্থ লুইস মেথড এসে ক্রিকেটকে বদলে দিল অনেকটাই। সেই নিয়মে শেষ বলে জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার হতো ৫ রান। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ২২ মার্চ তারিখটা দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে লেখা থাকবে কালো দিন হিসেবেই।