নেপথ্যের তাঁরা
সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে চলতি ক্রিকেট বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডকে গ্রুপপর্ব থেকে বিদেয় করে শেষ আটের টিকিট কাটা মাশরাফি বাহিনী বাহবা পাচ্ছে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী শুরু করে রথী-মহারথিদেরও। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমই হোক আর বাস্তব দুনিয়ার কর্পোরেট অফিস কিংবা চায়ের দোকান; বাংলাদেশজুড়ে আলোচনা এখন একটাই, ক্রিকেট। কিন্তু সে আলোচনায় টাইগারদের কোচরা কতোটা গুরুত্ব পাচ্ছেন? সাফল্যের ভাগ কি তাঁদেরও পাওয়া উচিৎ নয়? সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে সে প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন মহিবুল্লাহ ত্বকি।
সাফল্যের কৃতিত্ব কেউ যতটুকু পান, ব্যর্থতার দায়ও বোধহয় তাঁকে ততটুকুই নিতে হয়। হয়তো মাঠের খেলায় ভূমিকাটা অনেক বেশী থাকে বলেই ফুটবল দলের কোচেরা দুটোই প্রায় সমান সমান পেয়ে থাকেন। আরও একটি ‘হয়তো’ যোগে বলতে হচ্ছে, ক্রিকেট মাঠে কোচদের ভূমিকা অতোটা থাকে না। তাই দলের বাজে পাফরম্যান্সে যেমন তাঁদের নাম সেভাবে উঠে আসে না তেমনি বড় সাফল্যেও ‘পিছনের তাঁরা’ পিছনেই থেকে যান। কিন্তু তারপরও কেন যেন মনে হয় ব্যর্থতার দায় একজন ক্রিকেট কোচের উপর আমরা যতোটা চাপাই, সাফল্যের কৃতিত্ব তাঁকে ততোটুকু দিতে কার্পণ্য করি।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নক-আউট পর্ব নিশ্চিত করা বাংলাদেশ দল ভাসছে দেশ-বিদেশের অভিনন্দন জোয়ারে। ইংলিশবধের নায়ক রিয়াদ, মুশফিক, রুবেলদের পাশাপাশি ভূয়সী প্রশংসা পাচ্ছে মাশরাফি বিন মর্তুজার অধিনায়কত্বও। সেখানে চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে, হিথ স্ট্রিক বা রিচার্ড হালসালের মতো নেপথ্য কারিগরদের নাম ক’জনই বা নিচ্ছি? কোন বোদ্ধার বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে নয়, সাধারণ ক্রিকেট দর্শক হিসেবে খোলা চোখে সেই পিছনের তাঁদের খানিকটা কৃতিত্ব দেয়ার চেষ্টা করা যাক।
গত বছরের মে মাসে চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর ভারতের দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-০ ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ। সেটার দায় তাঁর কাঁধে সেভাবে চাপে নি। তবে তারপরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের প্রাক্কালে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাকিবের উপর বিসিবির কঠোর নিষেধাজ্ঞার পিছনে অনেকে এই ভদ্রলোকের ভূমিকা খুঁজে পেয়েছিলেন। সাকিববিহীন বাংলাদেশের ক্যারিবিয় সফরের দুঃসহ স্মৃতি এখানে আর নাই বা টানা হল।
দু’ দুটো বাজে সিরিজ দিয়ে হাথুরুসিংহের বাংলাদেশ অভিযানের শুরুটা যে মোটেও ভালো হয় নি তা বলাই বাহুল্য। শ্রীলংকার সাথে হেরে শুরু হওয়া বছরে বাংলাদেশের একমাত্র সম্বল ছিল টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে আফগানিস্তান ও নেপালের বিপক্ষে দুটো জয়। উপর্যুপরি হারে পর্যুদস্ত টাইগারদের সামনে বছরের শেষে অক্সিজেন হয়ে আসে জিম্বাবুয়ে সিরিজ। তিনটি টেস্ট আর পাঁচটি ওয়ানডের সবক’টি বেশ ভালো ব্যবধান রেখেই জিতে নেন মাশরাফিরা।
একজন কোচের সাথে একটা দলের রসায়ন পুরোপুরি গড়ে উঠতে যে সময়ের প্রয়োজন প্রথম দুটো সিরিজে সে সময়টুকু হাথুরুসিংহে পান নি- এমনটা যদি বিবেচনা করা হয় তবে জিম্বাবুয়ে সিরিজটাই ছিল ‘কার্যত’ তাঁর প্রথম মিশন। সেখানে ষোলোআনা সাফল্যের পিছনে হাথুরুসিংহের অবদান কতোটুকু ছিল সেটা তাঁর শিষ্যরা ভালো বলতে পারবেন। দর্শকের জায়গা থেকে সে জয়ে তাঁকে প্রাপ্য কৃতিত্ব না দেয়ার কোন যৌক্তিক কারণ সম্ভবত নেই।
ঘরের মাঠের ওই সিরিজের পর চলতি বিশ্বকাপই বাংলাদেশের পরবর্তী মিশন। কোচের পরামর্শে ভালো ফলের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ দল অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমায় বেশ লম্বা সময় হাতে রেখেই। দেশ ত্যাগের আগে কোচ-অধিনায়ক দু’জনই প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বলেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালের কথা। মূল পর্বের আগে খেলা প্রস্তুতি ম্যাচগুলোর সবক’টিতে হেরে যাওয়া মাশরাফিদের ‘ভালো কিছু’ করে দেখানোর যোগ্যতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হাথুরুসিংহের ছেলেরা সেই ‘প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচ হাতে রেখেই।
এ পর্যন্ত খেলা চারটি ম্যাচের মধ্যে শ্রীলংকার বিপক্ষেরটি বাদ দিলে বাকি তিনটিতে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কমই ছিল। দল নির্বাচন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তারপরও ঢের হয়েছে। শেষপর্যন্ত জয়গুলো না আসলে হয়তো সে বিতর্ক আরও উস্কে যেত। ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন আনা উচিৎ কিনা, আরও একজন স্পিনার বেশী নিয়ে খেলা যেত কিনা, বোলিং বা ফিল্ডিং সাজানোর কাজটা কতোটুকু কার্যকরভাবে বাংলাদেশ করতে পেরেছে - এসব নিয়ে আলোচনা আসলে শেষ হবার নয়। কিন্তু জয়ের ভিতর ইতিবাচক কিছু খুঁজতে গেলে প্রথমেই সম্ভবত আসবে ব্যাটিং ধ্বসের মতো একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা থেকে আপাত মুক্তি। এই ক’দিন আগেও টপ অর্ডার একবার মুখ থুবড়ে পড়লে সে ম্যাচে ‘সম্মানজনক’ একটা সংগ্রহই হয়ে যেত বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য। অথচ এখন শুরুতে দু-তিনটে উইকেট হারালেও বাংলাদেশ লড়াই করার মতো পুঁজি দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারছে। উদ্বোধনী জুটিতে একটু স্থিতিশীলতার সাথে ব্যাটিং অর্ডারে খানিকটা রদবদল বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে হয়তো সামগ্রিক ধারণাটুকুই বদলে দিতে পারে।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের কথাই ধরা যাক। বর্তমান দলটির সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যানদের একজন। ৯৮ ইনিংসে ৩৩.৪১ গড়ে ১২টি অর্ধশতক, একটি শতক ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ দেয় না। তারপরও তিনি সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সমালোচনার শিকার হওয়াদেরই একজন। সেটার একটা বড় কারণ হতে পারে তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরণের সাথে পজিশনটা ঠিক যাচ্ছিল না। ক্যারিয়ারের বেশীরভাগ (৬৩টি) ম্যাচ খেলেছেন সাত নম্বর পজিশনে। সে সময় তাঁর কাছে হাত খুলে মার চায় দল; যে চাহিদাটুকু বেশীরভাগ সময়ই তিনি মেটাতে পারেন না। কিন্তু টপ অর্ডারে তিন বা চারে নেমে তিনি যে ইনিংসগুলো খেলছেন সেগুলোর প্রয়োজন দল অনুভব করছিল অনেকদিন ধরেই।
বিভিন্ন ব্যাটিং পজিশনে মাহমুদুল্লাহর ক্যারিয়ার সংক্ষেপ
পজিশন | ইনিংস | রান | গড় | সর্বোচ্চ | স্ট্রাইক রেট |
৭ম | ৬৩ | ১৪০৪ | ৩৩.৪২ | ৭৫* | ৭৫.৩২ |
৬ষ্ঠ | ২০ | ৩৭৫ | ২২.০৫ | ৫৮* | ৬৪.৯৯ |
৫ম | ৪ | ১১২ | ২৮.০০ | ৪৮ | ৬৯.৫৬ |
৪র্থ | ৬ | ৩২৮ | ১০৯.৩৩ | ১০৩ | ৭৭.৯০ |
৩য় | ২ | ৯৭ | ৪৮.৫০ | ৬২ | ৭১.৮৫ |
সমালোচনার মুখে একজন খেলোয়াড়কে দলে রাখাটাই যেখানে চ্যালেঞ্জ, সেখানে তাঁর দীর্ঘদিনের ব্যটিং পজিশন বদলে টপ অর্ডারে তুলে দেয়াটা রীতিমতো দুঃসাহসিকই ছিল। বলা বাহুল্য, সে চ্যালেঞ্জে প্রাথমিকভাবে দলের থিংক ট্যাঙ্ক সফল। আর প্রধান কোচ হিসেবে সেখানে হাথুরুসিংহের ভাগ খোঁজাটা কি অন্যায় হবে?
বিতর্ক হতে পারে তিন নম্বর পজিশনে মমিনুল হকের বদলি হিসেবে সৌম্য সরকারের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। পেসার অলরাউন্ডার হিসেবে দলে থাকলেও আফগানিস্তান ম্যাচের তিন ওভার বাদ দিলে সৌম্যর হাতে বল দেখা যায় নি। ব্যাটিংটাই যদি তাঁর একমাত্র কাজ হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে তিন নম্বরে দারুণ স্বচ্ছন্দ মমিনুলকে বসিয়ে সৌম্যকে একাদশে নেয়াটা কতোটা যুক্তিসংগত? হাতে ভালো স্ট্রোক থাকলেও এক-দু' রানের প্রতি অনীহার জায়গাটায় এই তরুণের আরও কাজ করা প্রয়োজন। টানা চার ম্যাচ দৃষ্টিকটুভাবে উইকেটের পিছনে তালুবন্দী হওয়ার বিষয়টিও ভাববার মতো। প্রধান কোচের প্রিয়পাত্র হিসেবেই দলে আছেন, এমনটা শোনা যায়। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন কিনা সেটা বলার সময় হয়তো এখনও আসে নি।
কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট বাংলাদেশের নেপথ্য নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কৃতিত্ব পাওনা সম্ভবত বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিকেরই। মাশরাফিদের দলে যোগ দিয়েছেন হাথুরুসিংহের সাথেই। স্পিননির্ভর বোলিং আক্রমণের তকমাটা বাংলাদেশের গায়ে সেঁটে আছে দীর্ঘদিন। সে তকমা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি, গতিময় উইকেটে টাইগাররা কতোটুকু কি করতে পারবে সে শঙ্কাও দিনকে দিন কেবল জোরালো হচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর পর মাশরাফি-রুবেলরা শঙ্কাটুকু কেবল ভুল প্রমাণ করেই ছাড়েন নি, আফগানিস্তানের পর ইংল্যান্ড ম্যাচেও রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছেন। রুবেল-তাসকিনদের পাশাপাশি মাশরাফিও কখনও কখনও ঘন্টায় ১৪০ কি.মি. গতির ঝড় তুলেছেন। এ পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে বাংলাদেশের বোলারদের দখল করা ২২টি উইকেটের ১৭টিই নিয়েছেন পেসাররা। গতকালের ইংল্যান্ড ম্যাচটির স্লগ ওভারে রুবেল-তাসকিনরা স্নায়ুচাপ সামলে যেভাবে পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছেন কেবল সেটুকুর জোরেই বাংলাদেশ বহু ‘ক্লোজ’ ম্যাচে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারতো। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে আরও একটি কৃতিত্বের কথা না বললেই নয়, গোটা ইনিংসে একটিও ওয়াইড বল দেন নি বাংলাদেশের বোলাররা। অতিরিক্ত বাবদ খরচ হওয়া মাত্র ৫ রানের চারটি লেগবাই সূত্রে আর একটি নো বল।
এসবের কৃতিত্ব হিথ স্ট্রিক দেয়া যায় কিনা বা দিলেও কতোটুকু, সেসব ‘টেকনিক্যাল’ চিন্তাভাবনা দলের কর্তা ব্যক্তিদের মাথায় থাকুক। সাধারণ দর্শক হিসেবে এখানেও হিথ স্ট্রিককে সাফল্যের ভাগ দিতে কার্পণ্য করার কোন সুযোগ নেই।
গত জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকেই বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়েও একটা বড় ধরণের ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়। মিস ফিল্ডিং বা ক্যাচ মিসের প্রবণতা যে পূর্বের তুলনায় অনেক কমেছে সেটা সম্ভবত অস্বীকার করার উপায় নেই। এ যাত্রায়ও শ্রীলংকার সাথে ম্যাচটা বাদ দিলে বাকিগুলোয় ফিল্ডারদের শরীরী ভাষায় নেতিবাচক কিছু সেভাবে লক্ষ্য করা যায় নি। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের পিছনে যদি কাউকে খুঁজতে চান তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই রিচার্ড হালসাল। ৪৬ বছর বয়সী এই জিম্বাবুইয়ান মাস ছয়েক হল বাংলাদেশ দলের ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান কোচিং প্যানেলের কারোরই দলের সাথে এক বছরও অতিক্রান্ত হয় নি। এতোটা স্বল্প সময়ে একজন কোচ ভালো কি মন্দ সে বিচারে যাওয়ার সুযোগ সামান্যই। তবে তার মধ্যেও দলের হারজিতে তাঁদের ভূমিকার প্রশ্নটা চলে আসেই। সে জায়গা থেকে হারের দায়টুকু কোচের উপর যতটুকু দেয়া হচ্ছে, জেতার কৃতিত্ব বেশী না হোক প্রাপ্যটুকু তাঁরা পাচ্ছেন তো?