আড়ালে থাকা মিলানের মহারাজ
১৯৭৪ সালের এক রৌদ্রস্নাত সকাল। মিলান শহরের উত্তর-পূর্বে ইন্টার মিলানের ট্রেনিং কমপ্লেক্স অ্যাঞ্জেলো মোরাত্তিতে বয়সভিত্তিক দলের জন্য কিশোরদের ট্রায়াল নেওয়া হচ্ছিল। সেদিনের ট্রায়ালে আপন ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন ইন্টার অনূর্ধ্ব-১৬ দলের জিউসেপ্পে বারেসি। কিন্তু ‘অনুজ’ বারেসির পারফরম্যান্স ঠিক মনে ধরল না ইন্টারের হর্তাকর্তাদের, আগামী বছর আবারো চেষ্টা করার পরামর্শ দিলেন। প্রথম ফুটবলীয় পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েও দমে যাননি ছোট বারেসি। পরদিনই ট্রায়াল দেন ইন্টারের চিরশত্রু এসি মিলানে। ‘রোজ্জোনেরি’দের ঠিকই মনে ধরলো বাদামী চুলের সেই কিশোরকে। বড় জন ইন্টারে, ছোট জন এসি মিলানে- কপালের ফেরে বারেসি ভ্রাতৃদ্বয় হয়ে গেলেন একে অপরের ‘শত্রু’।
ইন্টারের সেই ভুলের সুবাদে এসি মিলান পেয়েছিল এক কাঁচা হীরে। বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে ১৯৭৭ সালে অভিষিক্ত হন ‘রোজ্জোনেরি’দের হয়ে। এরপর থেকে টানা ২০ বছর এসি মিলানের মধ্যমণি হয়ে ছিলেন তিনি, মাত্র ২২ বছর বয়সে যাঁর তরুণ কাঁধে পড়েছিল মিলানের অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব। নাম ফ্রাঙ্কো বারেসি। ক্যারিয়ারজুড়ে অসামান্য মনোবলের জোরেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনেক উঁচুতে। বেকেনবাওয়ারের ‘সুইপার’ রোলটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই বারেসিই।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘রোজ্জোনেরি’দের মূল দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্কো বারেসি। ১৯৭৮ সালের ২৩ এপ্রিল ভেরোনার বিপক্ষে সর্বপ্রথম লাল-কালোদের হয়ে মাঠে নামেন । বয়সে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় বারেসির নাম হয়েছিল ‘পিশচিনিন’ বা ‘ছোটজন’। অভিষেকের পরবর্তী মৌসুম থেকেই মিলানের অপরিহার্য এক সদস্যে পরিণত হন। তেমন লম্বা বা শক্তিশালী না হওয়ায় তাঁকে সুইপার বা লিবেরো রোলে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন লিডহোম। সেই ’৭৯ থেকে অবসরের আগে ’৯৭ পর্যন্ত ‘লিবেরো’ রোলে বিশ্ব মাতিয়েছলেন ।‘লিবেরো’ হিসেবে দুনিয়া কাঁপানোয় ‘কাইজার ফ্রাঞ্জ’নামেও ডাকা হত তাঁকে।
বারেসির ‘সুইপার বা লিবেরো’ রোলটি ছিল বেশ চমকপ্রদ। ট্যাকলিং, হেডিং-এ দুর্দান্ত বারেসিকে আক্রমণ রুখে বল নিয়ে সামনে এগুনোর ‘লাইসেন্স’ দিয়ে দিয়েছিলেন লিডহোম। দূরপাল্লার পাসের পাশাপাশি বল পায়ে সমান দক্ষ হওয়ায় অচিরেই ‘লিবেরো’তে মানিয়ে নেন বারেসি। মালদেরা, কলোভাটিদের থেকে মালদিনি, কস্তাকুর্তা- মিলানের রক্ষণভাগে একাধিক পরিবর্তনের মাঝেও বারেসিই ছিলেন ধ্রুবক। হ্যাংলা-পাতলা মনে হলেও বারেসির ট্যাকলিং ছিল ভয়ঙ্কর এবং নিঁখুত। ইতালীয়ান উইঙ্গার জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলা একবার বলেছিলেন, “বারেসির বিপক্ষে যতবার খেলেছি, প্রত্যেক ম্যাচ শেষে পায়ে বরফ এবং ক্রিম ব্যবহার করতে হয়েছে”। ত্রাপাত্তোনি, সাচ্চির তারকাখচিত মিলানের প্রতিআক্রমণে বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর দল হয়ে ওঠার পেছনে বিশাল ভূমিকা ছিল ফ্র্যাঙ্ক বারেসির।
চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে, তেমনি বারেসির সাফল্যমন্ডিত মিলান ক্যারিয়ারেও ছিল কালো অধ্যায়ের ছাপ। ১৯৮০ সালে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের লজ্জাজনক কেলেঙ্কারীর কারণে মিলানকে নামিয়ে দেওয়া হয় দ্বিতীয় বিভাগে। অবশ্য ৮০-৮১ মৌসুমেই সিরি বি জিতে প্রথম বিভাগে আসে ‘রোজ্জোনেরি’রা। কিন্তু ৮১-৮২ মৌসুমে আবারো অবনমিত হয় মিলান। বড় দলগুলো বারেসিকে দলে ভেড়াতে উঠেপড়ে লাগলেও নাড়ীর টানেই মিলান ছাড়েননি তিনি। এক সংবাদ সম্মেলেনে বলেছিলেন, “যখন আমাকে কেউ দলে নিতে চায়নি, তখন মিলান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। মিলানের হয়েই আমি অবসর নিতে চাই”। বিশ্বস্ততার এমন উদাহরণের জন্যই মিলান সমর্থকদের সাথে আজো এক আত্মিক সম্পর্ক বজায় আছে বারেসির।
‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’। মিলানের তখনকার অন্ধকার যুগের আড়ালে হাসছিল সম্ভাবনাময় নতুন যুগ। সেই যুগের সূচনা হয় ১৯৮৬ সালে, যখন এসি মিলান কিনে নেন ইতালীর প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি। শুরুতেই ক্ষুরধার ট্যাকটিশিয়ান আরিগো সাচ্চিকে নিয়ে আসেন বার্লুসকোনি। এরপর একে একে মিলানের লাল কালো জার্সি গায়ে জড়ান ভ্যান বাস্তেন, রুড গুলিত, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডরা। আগে থেকেই ছিলেন মালদিনি, কোস্তাকুর্তা, ডোনাডুনিরা। অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্কো বারেসির হাত ধরে ইউরোপে ছড়ি ঘোরানো শুরু করে ‘রোজ্জোনেরি’রা।
বার্লুসকোনি অধ্যায়ের দশকখানেক পর অবসরে যাওয়া বারেসি লিগ জিতেছিলেন ৬ বার, তিনবার করে জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ইউয়েফা সুপার কাপ। একজন ডিফেন্ডার হয়েও ৮৯-৯০ ইতালীয়ান কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ’৮৯-এর ব্যালন ডি’অরে রানার আপ হয়েছিলেন বারেসি। ‘রোজ্জোনেরি’দের ইতিহাসের অন্যতম বর্ণাঢ্য এই কিংবদন্তীকে ১৯৯৯ সালে মিলান তাদের ‘প্লেয়ার অফ দ্যা সেঞ্চুরি’ খেতাব দেয়।
ক্লাব ফুটবল দাপিয়ে বেড়ানো বারেসি নিজের প্রথম দুই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের মূলপর্বে (ইউরো ’৮০ এবং বিশ্বকাপ ’৮২) মাঠে নামেননি একবারও। ’৮৬-এর বিশ্বকাপে বারেসিকে দলেই নেননি কোচ এনজো বেয়ারজট। বেয়ারজটের বদলি হিসেবে আসা অ্যাজেগ্লিও ভিচিনির অধীনেই মূলত সূচনা হয় বারেসির ইতালী অধ্যায়। ’৯০ বিশ্বকাপে ইতালী তৃতীয় হলেও সেবারের অলস্টার দলে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ’৯৪ বিশ্বকাপ সমগ্র ইতালীর জন্য এক দীর্ঘশ্বাস। নরওয়ের বিপক্ষে ম্যাচে হাঁটুর তরুণাস্থি ছিঁড়ে যায় বারেসির। তিন থেকে ছয় মাস সময় নেওয়া এই ইঞ্জুরিতে পড়েই যুক্তরাষ্ট্রে সার্জারি করিয়ে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করে দেন তিনি। মাত্র ২৫ দিন পর ফাইনালে সবাইকে চমকে দিয়ে মূল একাদশেই নামেন বারেসি। অতিরিক্ত সময়ের পরও গোলশুন্য থাকা ফাইনালের নিষ্পত্তি হয় পেনাল্টিতে। বাজ্জিও, মাসারোর পাশাপাশি পেনাল্টি মিস করেন বারেসিও। মাঠ ছাড়ার আগে বারবার ইতালী সমর্থকদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নেন । ’৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন।
’৯৪ বিশ্বকাপে রানার আপ হলেও বারেসির বীরত্ব এবং দেশপ্রেম ছুঁয়ে গিয়েছিল সবাইকে। ম্যাচ শেষে ক্রন্দনরত অধিনায়ককে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন রোমারিওরা। ২৭ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে জিতেছেন সম্ভাব্য সবকিছুই। দলীয় শিরোপা, কেতাবী সব পরিসংখ্যান বাদ দিলেও মিলান সমর্থকদের কাছে ঈশ্বরতুল্যই থাকবেন বারেসি। ৮৯-৯০ মৌসুমের মিলান ডার্বিতে হাত ভেঙ্গে গেলেও দমে যাননি, দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছিলেন। বারেসির প্রতি মিলানের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ছিল সীমাহীন। অবসরের পরপরই প্রিয় অধিনায়কের ৬ নম্বর জার্সিটি তুলে রাখে ‘রোজ্জোনেরি’রা। মিলান অন্তঃপ্রাণ এই কিংবদন্তীর জার্সির আদলে বানানো প্রকান্ড এক ব্যানার এখনো সান সিরোর উত্তর স্ট্যান্ডে শোভা পায় মিলান আল্ট্রাসদের হাতে।
বারেসির অধিনায়কত্বেই রিয়ালের পাশাপাশি টানা দুইবার ইউয়েফা কাপ জিতেছে কেবল এসি মিলানই। বারেসির হাত ধরেই ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছিল ‘লিবেরো’ রোলটি। তবে এসি মিলান সমর্থকদের কাছে এসব কিছুর নয়, পাশের বাড়ির ছেলেটি হয়েই চিরকাল আপন হয়ে থাকবেন ‘ইল কাপিতানো’।