লাল সবুজের পাগলা
এই মেলবোর্নেই, অনেকের মতে, স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান খেলেছিলেন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসটা। ১৯৩৬-৩৭ এর সেই অ্যাশেজে, সিরিজের প্রথম দুই টেস্ট হেরে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠে গেছে যে অধিনায়কত্বের চাপ ব্যাটসম্যান স্যার ডনকে শেষই করে দিলো কি না। বৃষ্টি বিঘ্নিত এক ঘটনাবহুল ম্যাচে এই মেলবোর্নেই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে স্যার ডন করলেন একটা ঝকঝকে ২৭০, তাও আবার সাত নম্বরে নেমে! ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, শেষ তিন টেস্ট জিতে ৩-২’এ যে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতে নিলো, তার শুরুটা হয়েছিলো এই মেলবোর্ন দিয়েই। সেই থেকে মেলবোর্ন তাই সবসময়ই বিশেষ একটা জায়গা নিয়ে আছে স্যার ডনের মনে। যখনই খেলা জমে মেলবোর্নে, ভিআইপি গ্যালারির বিশেষ এক কোণে একটা চেয়ার পেতে গা এলিয়ে স্যার ডন চোখ রেখে দেন মাঠের দিকে। যেমনটা আজও করছেন।
এই মুহুর্তে স্যার ডনের চোখ বল করতে দৌড় শুরু করা ফাস্ট বোলারটির দিকে। পরলোকের একটা সুবিধা হচ্ছে, সর্বজ্ঞ হয়ে যাওয়া যায়। ফাস্ট বোলারটির ব্যথা এড়াতে চাওয়ার প্রচেষ্টা তাই নজর এড়াচ্ছে না তার।
ওদিকে মাঠে তখন তুমুল উত্তেজনা।
ফুল লেংথের সামান্য খাটো বলটা গ্লান্স করে ফাইন লেগে পাঠিয়েই ব্যাটসম্যান ছুটলো নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের দিকে। সেদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে ফলো থ্রু শেষ করেই হাঁটুর নিচে যুবতীর স্তনের মত অনবরত নড়তে থাকা একটা ব্যথা নিয়ে ফাস্ট বোলার যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালো, স্কয়ার লেগ থেকে ছুটে যাওয়া ফিল্ডার বলটা তখন বলটা তুলছে কেবল। সরাসরি থ্রো’তে সাদা রঙা বলটা উইকেট কিপারের গ্লাভসে এসে জমা পড়ার আগেই জায়গা বদল করে নিলো দুই ব্যাটসম্যান। মেলবোর্নের মাঠে ফ্লাডলাইটের আলোয় এই জমাট লড়াই দেখতে থাকা বিপুল সংখ্যক দর্শকের একটা বড় অংশই ফেটে পড়লো এই সিঙ্গেলের সাথে সাথে। এসে গেছে, সেট ব্যাটসম্যান ক্রিজে এসে গেছে! পাঁচ বলে নয় রান দরকার মাত্র, আজকালের টি টোয়েন্টি যুগে এমনকি টিলার সমান উচ্চতায়ও নেই এই টার্গেট। সবচেয়ে বড় কথা, এখনো আরো তিন উইকেট হাতে আছে।
পিচের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এই মুহুর্তে ফাস্ট বোলারের মাথায় অজস্র চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে কেন্দ্রীভূত হলো স্ট্রাইকে চলে আসা ব্যাটসম্যানের দিকে। ক্রিকেট দুনিয়ায় হালফিলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে থাকা তরুণটির নামের পাশে স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে অপরাজিত একশো বেয়াল্লিশ, একশো একুশ বলে। এর মাঝে শুধু গত পনেরো বলেই একচল্লিশ তুলে খেলাটা বলতে গেলে তাদের মুঠো থেকে বের করে নিয়েছে এই ব্যাটসম্যান। ওভারের প্রথম বলে নেয়া এই সিঙ্গেলটি তাই, খুব সম্ভব নিশ্চিত করে দিয়েছে ম্যাচের ভাগ্য।
সে ঘুরলো, হেঁটে ফিরে চললো বোলিং মার্কের দিকে। অবশ্য হাঁটুর কাছে জীবন্ত যন্ত্রণাটা তাকে হাঁটতেই দিচ্ছে না ভালো মতো। হালকা নিচু হয়ে নি-ক্যাপটা ঠিক করার সময় একটু বাড়লো যেন ব্যথাটা। সেটাকে অগ্রাহ্য করেই সে খুঁড়িয়ে চললো তার স্পটে। ঘুরে হাত তুলতেই কভারের ফিল্ডার একটু এগিয়ে এসে বলটা ছুঁড়ে দিলো তার দিকে। সে লুফে নিলো সেটা, ছোট্ট একটা বিরতির পর দৌড় শুরু করলো তারপর।
এবারের ডেলিভারিটা করতেই শরীরের কোথাও কিছু একটা ছিঁড়ে গেলো মনে হলো তার, মুখে দিয়ে সামান্য যন্ত্রণাসূচক শব্দও বের হয়ে গেলো অনিচ্ছায়। আর সেই অবসরে ব্যাটসম্যান, এই গ্রীষ্মে এই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই তিন টেস্টে ঊনআশি গড়ে রান তুলেছে যে, গুড লেংথের বলটাকে এগিয়ে এসে দারুণ দক্ষতায় চিপ করে তুলে দিলো এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে। দুই ড্রপ খেয়েই বলটা গড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো বাউন্ডারির বাইরে, মিড অফের ফিল্ডার প্রায় বিশ গজ দৌড়ে এসে দেখার মতো সেইভটা না করলে সেটা আসলে বাউন্ডারিই হতো। উল্লাসরত সমর্থকেদের মাঝ দিয়ে দুইবার জায়গা বদলে নেয়ার ফাঁকে তেমন কোনো তাড়াহুড়ো দেখালো না ব্যাটিং টিম। তারা জানে চার বলে সাত রান তেমন কোনো টার্গেট নয়, তাদের কোনো তাড়া নেই।
ফাস্ট বোলারটি জোরে জোরে চিৎকার করে মিড অফের ফিল্ডারের দিকে তাকিয়ে হাতে তালি দেয়। সে জানে, ফিল্ডারের সাহায্য না পেলে এখনই শেষ হয়ে যেতে পারতো খেলাটা। ক্রিকেট একজনের খেলা না, আর সর্বস্ব দিয়ে যখন ক্রিকেট মাঠে এগার জন যখন খেলে, দলের হারার সম্ভাবনা তখন কমে যায় অনেকটাই। হাততালি থামিয়ে ঘোরার মুহুর্ত থেকেই তার মাথায় ভাসতে থাকে হালকা একটা দুশ্চিন্তা। সে বুঝে গেছে, এই ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে তাকে ঢেলে দিতে হবে অভিজ্ঞতার সবটুকু।
বোলিং মার্কের দিকে আবারো হাঁটতে হাঁটতে আরো তীব্রভাবে নিজের অস্তিত্ব জানানা দেয় তার হাঁটু। সেই হাঁটুজোড়া, সাতবার যারা সার্জনের ছুরির নিচে সঁপে দিয়েছে নিজেদের। ব্যথাটাকে অগ্রাহ্য করতে চায় সে, মন ঘুরিয়ে নিতে চায় অন্যত্র। আর ভিআইপি গ্যালারি থেকে তার এই প্রচেষ্টা দেখে স্যার ডনের মনে পড়ে যায় বিশেষজ্ঞের মত, ‘এই হাঁটু নিয়ে ছেলেটা যে দাঁড়িয়ে থাকে, এইটাই তো অকল্পনীয় ব্যাপার!’
আর ফাস্ট বোলারের মনে পড়ে ডাক্তারের সতর্কবাণী, যে কোনো দিন অচল হয়ে যেতে পারে তার পা।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে প্রায়ই ম্যাসেজ করে সাড়া ফেরাতে হয় তার পায়ের পাতায়, কখনো কখনো খেলার পরেই হাঁটুতে জমে থাকা পানি বের করে নিতে হয় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে। তারপরেও, তবুও, তার মনে হয় এই বল করে যাওয়াটাই তার নিয়তি। শরীরে কুলোয় না বলে লাল রঙা বলকে সুইং করানো ছেড়েছে সে বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে, এই সাদা বলই এখন তার একমাত্র অস্ত্র। কিন্তু কাজটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। দিনে দিনে চওড়া হচ্ছে ব্যাটসম্যানদের ব্যাট, এর মাঝে তিরিশ পেরিয়ে যাওয়া একজন পেসারের ভুল করার জায়গা নেই খুব বেশি, বিশেষ করে স্পিড স্কেলেও তার ঘোরাফেরা যখন একশো ত্রিশের আশেপাশে।...
ডাক্তারের কথা মনে হতেই এক ঝটকায় ফাস্ট বোলারের মনে পড়ে নিজের ছোটো ছেলেটার কথা। এখনো এক বছর পুরো হয়নি গুল্টুর, বাপের খুব ন্যাওটা হয়েছে সেটা। টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার সময় প্রায় হামা দিয়ে স্ক্রিন ধরতে চাওয়া পিচ্চিটা এখন হসপিটালে, টাইফয়েড হয়েছে নাকি। গতকাল দুপুরে দেশ থেকে ফোন এসেছিলো। খবরটা শোনার পর থেকে অনেকটাই ভারী হয়ে আছে তার মন। ছেলের মুখ, সেটা আবার কখন দেখা হবে তার?...
... মাথা থেকে চিন্তা ফেলে সে রানআপ শুরু করে আবার। হাঁটুটা যেন কামড়ে ধরেছে কেউ। কিন্তু সে দৌড়ে যায় আলোকিত স্টেডিয়ামের অজস্র শব্দ আর দেশে ফেলে আসা ছেলেটাকে নিয়ে আশা কিংবা আশঙ্কা সঙ্গী করে। সে বল করে।
গুড লেংথ পিচ করে বল এগোয় মিডল আর লেগ স্টাম্পের মাঝ বরাবর। সেট ব্যাটার চোখের পলকে গতিপথ আন্দাজ করে উইলো চালায়, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একটু ফাইন হয়ে থাকা স্কোয়ার লেগ আর মিড উইকেটের দুই ফিল্ডারকে ব্যবচ্ছেদ করে বলটা পেরিয়ে যায় সাদা রঙা দড়ি। বাউন্ডারি!
ব্যাটিং দলের প্রচুর সমর্থক আজ মেলবোর্নে। স্টেডিয়াম যেন ফেটে পড়ে তাদের চিৎকারে, বাহারি কথামালায় ভর্তি ব্যনার বা ফেস্টুন জুম করে ক্যামেরাম্যানেরা, উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ব্যাটারের প্রশংসায় শুরু করেন ধারাভাষ্যকারেরা, সুন্দরী ফ্যানরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করে ভালোবাসা সূচক শব্দাবলী নিয়ে। উলটো পাশে হাতে গোণা কয়েকটা লাল সবুজের পতাকা নিয়ে স্টেডিয়ামে এসেছে যারা, তারা মলিন মুখে ধীরে ধীরে শুরু করে পতাকা গোটাতে। এতো কাছে তবু যেন আজ কত দূর...
ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে মাঝপিচের দিকে। এগিয়ে যায় তার পার্টনারও। পিচের মাঝে এসে মুখে হাসি নিয়ে তারা কথা চালায় নিজেদের মাঝে। আর সে ঘুরে দাঁড়ায় তখন।
‘... বাচ্চা !’ অস্পষ্ট একটা গালি দিয়ে নিজের উদ্দেশ্যেই নিজেকে বলে সে। মাথা ঠাণ্ডা রাখ্, মাথা ঠাণ্ডা রাখ্। সামান্য ভুল করলে এই ব্যাটসম্যান তোকে খুন করে ফেলবে। ...মনের মাঝে নিজেকে কষে একটা চড় দেয় সে। লাস্ট ওভার করতে এসে মুহুর্তের জন্যেও মনোযোগ হারানো চলে না, আর সে কী না ভাবছে নিজের ইনজুরির কথা, ছেলের টাইফয়েডের কথা ?
... সে এসে পৌঁছায় তার রানিং মার্কে। কভারের ফিল্ডার চিন্তিত মুখে বলটা ছুঁড়ে দেয় তাকে। তিন বলে তিন রানের ছোটো একটা পুঁজি নিয়ে বুকে নিয়ে বলটা ধরে সে। হাঁটুর ব্যথাটা তার শরীরের একটা অংশ হয়ে গেছে যেন, কোথাও কেউ টেনে যেন ছিঁড়ে নিচ্ছে তার লিগামেন্ট। তবু সে জানে, এই শত্রুর সাথে সাথে এ মুহুর্তে তার সঙ্গী হয়ে আছে আরো কিছু। দূরের একটা দেশে টিভিস্ক্রিনের সামনে অনেকগুলো মানুষ। সে কিছু একটা করতে চায় তাদের জন্যে। কী করবে, কীভাবে করবে, আদৌ করতে পারবে কি না- সে সব চিন্তার লেজ তার মগজে আসে না কিন্তু। সে কেবল একটা কিছু করতে চায়।
লাখের ঘর প্রায় ধরে ফেলা দর্শক তার মাথা থেকে উধাও হয়ে যায় এরপর। নিজের নাম, ছেলের মুখ ভুলে যায় সে। তার চোখের সামনে শুধু থাকে বাইশ গজের একটা ক্রিকেট পিচ। ও প্রান্তে তিনটা কাঠি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন।
পয়েন্ট আর কভারে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ফিল্ডার তাদের ক্যাপ্টেনের মুখের বামপাশটা দেখতে পায় খানিক, ডানপাশের কিছু অংশ দেখতে পায় মিড অনে ফিল্ডিং করতে থাকা দলের ওপেনার। বহু বছর পরে, যখন নিজের আত্মজীবনীতে আজকের এই ম্যাচের বর্ণনা দেবে কাভারে দাঁড়ানো দুনিয়া সেরা ক্রিকেটারটি, এই বিশেষ মুহুর্তটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই মুখভঙ্গী নিয়ে সে লিখবে, ‘আমি জানি না কেনো, আই মিন কোনোভাবেই আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না কেনো মনে হলো কথাটা। তবু বলি, ক্যাপ্টেনের মুখ দেখে সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো, আমরা এই ম্যাচ হারবো না।’
...আর ক্যাপ্টেন দৌড় শুরু করে আবার। সে দৌড়ায়, দৌড়াতে থাকে- পেছনে যেন হিংস্র একটা চিতাবাঘ তাকে টেনে ধরে রাখে দাঁত দিয়ে। কিন্তু সে দৌড়ে যায়, চিতাবাঘটার কামড় সঙ্গে নিয়ে। আর আম্পায়ারকে পেরিয়ে গিয়ে ওভারের চতুর্থ ডেলিভারিটা দেয় সে।
বলটা ছুঁড়েই ফাস্ট বোলার বুঝতে পারে, পারফেক্ট একটা কাটার করেছে সে। পুরনো হয়ে আসা বলে কতটুকু কাজ দেবে এই ডেলিভারি, তা সে জানে না। বলটা নতুন হলে এই বলে উইকেট নিশ্চিত ছিলো তার, সে জানে। সে জানে, অফ স্টাম্পের আধহাত বাইরে পিচ করে ভেতরে ঢুকতে থাকা বলটা থরথর কাঁপছে ঘূর্ণিতে। সে জানে উইকেটে কামড় বসাতে হালকা সুইং নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বলটা, যেমন চিতাবাঘের কামড় এই মুহুর্তে তুলে নিচ্ছে তার পায়ের একদলা মাংস।
আর সেই অদৃশ্য জানোয়ারকে অগ্রাহ্য করে ছুঁড়ে দেয়া ফাস্ট বোলারের তুরুপের সেরা তাসটি মেলবোর্নের উপস্থিত শত সহস্র দর্শকের সামনে একটি নাটকীয় মুহুর্ত নিয়ে আসে এরপর।
বোলিং টিমের ক্যাপ্টেনের নিঁখুত, অব্যর্থ কাটারটা ক্রমশ ধেয়ে আসতে থাকে অফ স্টাম্পের বেল লক্ষ করে। কিন্তু ব্যাটসম্যান, যে দীর্ঘক্ষণ উইকেটে থেকে পিচের বাউন্স আর কৃত্রিম আলোতে অভ্যস্ত করে তুলেছে নিজেকে, মাস দেড়েক আগেই এই একই মাঠে স্বাগতিক অজি পেস আক্রমণ তাচ্ছিল্য করে টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিনে যে খেলেছে দেড়শো ছাড়ানো এক মহাকাব্যিক ইনিংস, সে বুঝিয়ে দেয় কেনো মাত্র শ’খানেক ওয়ানডে খেলার পরেই তাকে ডাকা হচ্ছে সর্বকালের সম্ভাব্য সেরা ওডিআই ব্যাটসম্যান বলে।
শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ব্যাটসম্যান। এরপর, প্রায় ঘোর লাগিয়ে দেয়া দেরির পরে উইকেটের আধইঞ্চি সামনে থেকে বলটাকে থার্ডম্যানের দিকে গ্লাইড করে দেয় সে। ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত সৌন্দর্য ফুটে উঠতে থাকে সেই লেটকাটে। কিন্তু সেকেন্ডের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশের জন্যে শেষ রক্ষা হয় না।
খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না, এরকম বাড়তি একটু বাউন্স নষ্ট করে দেয় ব্যাটসম্যানের পারফেকশন। মাঝ ব্যাটের বদলে কানা ছুঁয়ে বলটা চলে যায় ফার্স্ট স্লিপের দিকে। উড়ন্ত উইকেটরক্ষক সেই গতিপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেলে দেয় নিজের সবটুকু শরীর।
মেলবোর্নে উপস্থিত প্রতিটি দর্শক, এমন কি ভিআইপি গ্যালারিতে বসে থাকা প্রয়াত স্যার ডনের ছায়াও, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে দেখে- ঝাঁপ দেয়া কিপারের গ্লাভসের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যায় বলটা। এক মুহুর্তের নীরবতা, কিন্তু পরক্ষণেই নিরেট দেয়ালের মতোই ধাক্কা খেয়ে গ্লাভস থেকে বেরিয়ে আসে সাদা বলটা। পড়ে যায় মাটিতে।
...ক্যাচ ড্রপ ! ম্যাচের এমন মুহুর্তে !
জীবন্ত হয়ে ওঠা স্টেডিয়ামটা কানে তালা লাগিয়ে দেয় আবার গর্জনে, উইকেট কিপার সামলে নিয়ে শুন্য দৃষ্টিতে কুড়িয়ে নেয় বলটা। প্রথমে হতচকিত হয়ে থাকা ব্যাটসম্যান খানিক সম্বিত ফিরে পেয়ে ক্যাচ তোলার জন্যে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেকেই বারংবার বিদ্ধ করে মাথা নাড়ানো তিরস্কারে। ওপ্রান্তের পার্টনার এগিয়ে আসে তাকে কিছু বলতে, বোধহয় কথা বলে হালকা করতে চায় চাপের বোঝা।
আর সে, ফলো থ্রু’রঅবসরেই পলকের মাঝে এতোগুলা ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। সোজা হয়ে দাঁড়াবার পরেও কেনো জানি বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর অপেক্ষা করে না সে, কিংবা করতে চায় না। সে ঘুরে দাঁড়ায় আবারো। একটা কালবৈশাখীর মতো ছুটে আসা হঠাৎ হতাশা ঢেকে ফেলতে চায় তাকে, সে ফিরে যায় পা টেনে টেনে।
ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস, পুরোনো ক্রিকেটিয় প্রবাদ। কিন্তু সেই প্রবাদ স্মরণ করে সে হতাশ বা ক্যাচ মিসের জন্যে কিপারের উপর ক্ষেপে ওঠা, কোনোটাই হয়ে ওঠে না তার। অব্যাখ্যনীয় কোনো কারণে তার বরং মনে পড়ে ন্যুট হামসুনের সেই গল্পটা, বাবার মুখে যা সে শুনেছিলো কৈশোরে। সেই যুদ্ধাহত সৈনিকের গল্প- যার মাত্র একজোড়া পা বাঁচিয়ে দিয়েছিলো পুরো এক প্লাটুন সৈন্যকে। সে ভাবে, এই আহত পা জোড়া ছাড়া দেশকে আর কখনো কিছু দেয়ার ভাগ্য হয় নি তার, এমন কি একটা ব্রেক থ্রু’ও নয়।...
রানিং মার্কে ফিরে গিয়ে গিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায় আবার। ফিল্ডারদের হাতে হাতে আলোর নিচে কিছু ছোট ছোট বৃত্ত তৈরি করে বলটা ফেরত আসে তার হাতে। ব্যাটসম্যান দুজন নিজেদের মাঝে আলোচনা শেষ করে আরো সেকেন্ড দশেক পরে। আর এই ছোট্টো বিরতিটা কাজে লাগাতে সে বসে পড়ে পা ছড়িয়ে। পায়ের পাতার আঙুলগুলো টেনে নিয়ে চেষ্টা করে চিৎকার করতে থাকা হাঁটুটাকে খানিক আরাম দিতে। ব্যাটসম্যান ক্রিজে পৌঁছে যাবার পরেই শেষ হয় তার এই ব্রেক। উঠে দাঁড়িয়ে সে প্রস্তুত হয় আবারো। কিন্ত হাঁটুর নিচ থেকে হঠাৎ করে কোনো রকম সাড়া না আসায় তার কেনো যেন ভয় হয়, অবশ হয়ে যাচ্ছে তার পা।
সুদূর কৈশোরে অ্যান্ডি রবার্টসের মুখে শোনা কথাগুলো এবার মাথায় ধাক্কা মারে তার। জোরে বল করতে প্রায়শই দম ফুরিয়ে সে যখন হাঁপাতো মাটিতে বসে পড়ে, নেটের পাশ থেকে রবার্টস এসে কাঠ কাঠ গলায় বলতেন, ‘এমন কি শেষ দমটাও যখন বেরিয়ে যাবে তোমার ফুসফুস থেকে, সেই তখনও যদি তোমার মাথায় একটা পিস্তল ঠেকানো হয়, দেখবে- তুমি আরো এক মাইল দৌড়াতে পারছো। ... ফাস্ট বোলারদের এই কথাটা ভুলে গেলে চলবে না। কখনোই না। পাঁচ নাম্বার দিনের শেষ সেশনে দেখবে, ওই এক মাইলের ঘাটতিই তোমাকে পুরো সিরিজ হারাবে। ... উঠে পড়ো। দৌড়াও। দৌড়াও আর মাথা খাটাও।’
অতএব সে দৌড়ানো শুরু করে মাথায় ঠেকানো একটা অদৃশ্য পিস্তল নিয়ে। ছুটতে ছুটতেই সে দেখতে পায়, ব্যাটসম্যান লেগ স্টাম্পের বাইরে এক হাতের মতো সরে গিয়ে রুম করে নিয়েছে বলকে পেটানোর জন্যে। সে দেখে এটা। সে দৌড়ায়, সে মাথা খাটায়।
লেগ স্টাম্পের বাইরে জায়গা নিয়ে সজোরে ব্যাট চালায় ব্যাটসম্যান। অথচ কী আশ্চর্য, স্পিডোমিটার একশো ত্রিশের ঘর থেকে নেমে যায় পঁচানব্বইয়ে, প্রায় দেড়শো করে ফেলা অপরাজেয় ব্যাটারকেও হতবুদ্ধি করে ওয়াইডিশ স্লোয়ারটা উইকেটকিপারের হাতে চলে যায় ব্যাট চালানোর প্রায় এক সেকেন্ড পর। ডট বল, এক বলে তিন দরকার এখন !
উত্তেজনায় বসে থেকেই ডান হাঁটুতে চাপড় মেরে বসেন স্যার ডন, ভিনদেশি ধারাভাষ্যকারেরা উচ্চকিত গলার স্বরে প্রশংসা করতে থাকেন ফাস্ট বোলারের, মেলবোর্নের গ্যালারি আশা আশঙ্কায় প্রতিযোগিতায় কী করতে হবে না বুঝতে পেরে কেবল শব্দ উদগীরণ করে যায় অনেকক্ষণ ধরে।
...এবং এইবার, দীর্ঘক্ষণ পরে প্রথমবারের মতো, মাঝ পিচে দাঁড়িয়ে ব্যাটসম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মন পড়ার চেষ্টা করে ফাস্ট বোলার। সেখানে কিছুটা অস্থিরতা দেখা যায় যেন, প্রথমবারের মতো মনে হয়- ব্যাটসম্যান নার্ভাস। এই স্নায়ূক্ষয়ী মুহুর্তে তার আত্মবিশ্বাসের সলতেয় অনেকখানি আগুন ধরায় এই স্নায়ু লড়াইয়ের বিজয়।
আর বুকপকেটে ফাইনালে যাবার একটা আবছা স্বপ্ন, তিন রানের দেয়ালকে সাথে করে সাক্ষী থাকা উন্মাতাল মেলবোর্নের গ্যালারির দিকে সে ফিরে চায় এবার। অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সে প্রস্তুত হয় শেষ বারের মতো রানিং মার্কে পৌঁছাতে। সে হাঁটে, সে খোঁড়ায়, যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো।
আর যুদ্ধের কথা মনে হতে তার মন চলে যায় ঝা চকচকে মেলবোর্ন থেকে রঙচটা মিরপুরের মাঠ। ‘তুই দেশের জন্যে খেলছিস, তুই বিশ্বকাপে খেলছিস!’
তার মনে পড়ে, অভিষেকের বছর দুয়েক পরও সে যখন বিশ্বকাপে খেলতে গেলো প্রথমবার, আমার সোনার বাংলা শুনে আসলেই শরীরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেছিলো তার। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে প্রথম বলটা তো সে প্রায় ওয়াইড-ই করে বসেছিলো ! তার স্মরণ হয়, ইনজুরির কারণে গতবার দেশের মাটিতেই বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তার। সেই ঘোষণা দিতে সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে হঠাৎ করে কেঁদে দিয়েছিলো সে, তার মনে পড়ে। বলেছিলো, ‘সামনের বিশ্বকাপ খেলতে পারবো কি না, তা তো জানি না।’
এখন, এই মুহুর্তে প্রায় অবশ হতে যাওয়া পা’টা টেনে টেনে সে সামনে এগোয়। আরো একটা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছে সে ওপরওয়ালার অনুগ্রহে, পা চলে যায় যাক- শেষ ওভারে এসে দলকে সে ডোবাতে পারবে না। প্রতি বিজয় দিবসে শহীদ মুশতাক একাদশ আর শহীদ জুয়েল একাদশে ভাগ হয়ে খেলা প্রীতি ম্যাচগুলোর কথাও মনে হয় তার। সে শুনেছে, আজাদ বয়েজ ক্লাবের মুশতাককে গুলি করে ক্লাবের তাঁবুতেই মেরেছিলো পাকিস্তানিরা। শুনেছে, খবর বের করার জন্যে আজাদ ক্লাবের ওপেনার জুয়েলের আঙুলই ভেঙে ফেলেছিলো আর্মি। প্রতিবার অনুপ্রেরণা দেবার নিজেকে যা শোনায়, সেই কথাটাই আবারো নিজেকে মনে করিয়ে দেয় সে। ‘ভাঙ্গা আঙুলের ব্যথা সহ্য করে জুয়েল যদি একটা পতাকা দিয়ে যেতে পারেন দেশকে, সেই পতাকার জন্যে একটা মাত্র লিগামেন্ট ছেঁড়ার বেদনা সে নিতে পারবে না কেনো ? ... দৌড়া, দৌড়া তুই।’
... রানিং স্পটে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়ায় সে, শেষবারের মতো। সবাই প্রস্তুত কি না একটু খুঁটিয়ে দেখতে চায় সে। ফাইন লেগ আর মিড উইকেট, থার্ডম্যান আর মিড অফ- বৃত্তের বাইরের চার ফিল্ডার। পয়েন্টের ফিল্ডারকে আরেকটু তেরচা করে সরে যেতে ইশারা দেয় সে। খানিক পিছিয়ে দেয় এক্সট্রা কভারকে। এরপর, সে দৌড় শুরু করে।
দেড়শো বছরের স্মৃতিঘেরা এই স্টেডিয়াম তখন সাক্ষী হতে থাকে ইতিহাসের আরো একটা স্মরণীয় লড়াইয়ের শেষ দৃশ্যের।
সে দৌড়ায়, ধীরে ধীরে গতি তুলে সে এগিয়ে যায় লড়তে। সুউচ্চ ফ্লাডলাইটের আলোয় তার দৌড়ের দৃশ্যটা কেমন যেন অতিপ্রাকৃত দেখায়। মেলবোর্নের ভিআইপি গ্যালারিতে প্রয়াত স্যার ডনের পাশে তখন এসে দাঁড়ায় আরো একটি ছায়া। সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে জীবনের ওপারে চলে যাওয়া হালকা পাতলা গড়নের এই তরুণটিকে স্যার ডনের চেয়েও উৎসুক দেখায় যেন। মানজারুল ইসলাম রানা ফিসফিস করে বলেন, ‘যা পাগলা, যা। দেখায় দে।’
আর ফাস্ট বোলার ওদিকে ছোটে, ছুটতে থাকে। ভার্চুয়াল দুনিয়ার ফেসবুক আর টুইটারে অজস্র শুভকামনা জমতে থাকে তার নামে। আবার টিভি আর অনলাইন স্ট্রিমিং পর্দায় অগণিত মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে সেট ব্যাটসম্যানটি দেড়শোর ল্যান্ডমার্ক ছুঁয়ে ফেলবে- সেই প্রত্যাশায়। এই দুই পরস্পর বিরোধিতার হার্ডল টেনেও ছুটতে থাকে ফাস্ট বোলার, গতি এতোটুকু না কমিয়েই।
আর, মেলবোর্নের লাখো দর্শক হতবাক হয়ে দেখে, ছুটতে থাকা ফাস্ট বোলারের ছন্দোবদ্ধ রানআপের মাঝ দিয়েই পৃথিবীর সমস্ত জাদুবাস্তব গল্পকে হার মানিয়ে, লড়তে থাকা মানুষের সৌন্দর্য আর নাইট ফিউরির ক্ষিপ্রতা নিয়ে বেরিয়ে আসে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
সে হারতে পারে হয়তো। কিন্তু সে পরাজিত হয় না।