বদলে যাওয়া মাহমুদউল্লাহ
বসুন্ধরা বীরভোগ্যা, এখানে বীরেরই জয়জয়কার। ক্রিকেট সম্ভবত সেটির সবচেয়ে আদর্শ বিজ্ঞাপন। ম্যাচ জেতানো বা চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং-বোলিংয়ের জন্য এখানে প্রশংসা সহজলভ্য, চারদিকে তখন জড়ো হতে শুরু করে স্তাবকেরা। কেউ কেউ এসবে অভ্যস্তই, প্রশংসা তাদের কাছে একেবারেই আটপৌরে। আবার কেউ কেউ প্রচারের কথা না ভেবেই নিজের কাজটা করে যান নিভৃতে। তাঁদের নিয়ে প্রচারমাধ্যমের আতিশায্য নেই, বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস নেই। ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ইনিংস খেলেও তাঁদের কথা অনেকেই ভুলে যান। মাহমুদউল্লাহ এতোদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের "আনসাং হিরো" হয়েই ছিলেন। তারকাসুলভ "এক্স ফ্যাক্টর" নেই, হাবেভাবেও নেই আগ্রাসন বা দর্শকরঞ্জনের বাড়তি চেষ্টা। কিন্তু কখনও কখনও অন্তরালের মানুষটিই চলে আসেন পাদপ্রদীপে ! পার্শ্বচরিত্র থেকে নায়ক হয়ে ওঠার জন্য মাহমুদউল্লাহ বেছে নিলেন সবচেয়ে বড় মঞ্চটাকেই। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে যে দেখা যাচ্ছে অন্য এক মাহমুদউল্লাহকে।
অথচ ছয় মাস আগেও পরিস্থিতিটা ছিল অন্যরকম। রানের জন্য তখন সংগ্রাম করছেন মাহমুদউল্লাহ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলহে তাঁর তুমুল মুন্ডুপাত। "ভায়রা ভাই" কোটায় দলে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন, মূলধারার প্রচারমাধ্যমে পর্যন্ত এমন কথা লেখা হচ্ছিল। সংবাদ সম্মেলনে মুশফিককে পর্যন্ত অযাচিত এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। তা ছয় মাস আগে তো মাহমুদউল্লাহ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন সময়টাই কাটাচ্ছিলেন। ২০১৩ সালের ৮ মে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে বুলাওয়েতে খেলেছিলেন ৭৫ রানের ইনিংস। এরপর টানা ১৫ ইনিংসে কোনো ফিফটি পাননি। টেস্টেও ছিল একই অবস্থা। ২০১২ সালের নভেম্বরে খুলনা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৭৬ রান করেছিলেন। এরপর ফিফটি নেই আট ইনিংসে। মাহমুদউল্লাহ চুপচার সব সয়ে গেছেন, যেন পণ করে রেখেছিলেন জবাবটা দেবেন ব্যাট হাতেই।
সেই জবাবটা এমনভাবেই দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্বপ্নসারথীই হয়ে গেলেন। যে অর্জনের জন্য এতোদিন হাপিত্যেশ করে মরছিল বাংলাদেশ, সেই পরম আরাধ্য সেঞ্চুরি পেয়েছেন ইংল্যান্ডের সাথে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আবারও খাপখোলা তরবারির মতো ঝলসে উঠল ব্যাট, শাহরিয়ার নাফীসের পর প্রথম বাংলাদেশ ব্যাটসম্যান হিসেবে পেলেন টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তাঁর চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল চারজন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবটুকু আলো এখন তাঁর ওপর, ক্রিকেট বিশ্লেষকরা পর্যন্ত প্রশ্ন করছেন, এই মাহমুদুল্লাহ কে ? "মামাডলা" নামের অদ্ভুতুড়ে ভিনদেশি উচ্চারণ এখন গুঞ্জরিত হয়ে বেড়াচ্ছে মেলবোর্ন- হ্যামিল্টনের আকাশে-বাতাসে।
অথচ এর আগেও অনেকবার দলের হাল ধরেও চাপা পড়ে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালে। ২০১১ সালের ২১ আগস্ট জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওই ম্যাচের কথাই ধরুন। সাকিবের সঙ্গে মিলে দলকে টেনে তুলেছিলেন বিপদ থেকে, শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৬৭ বলে ৬০ রান করে। পরে বল হাতেও মাত্র ১৩ রান নিয়ে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৭১ রান ও ২ উইকেট নিয়ে ওই ম্যাচের নায়ক সাকিবই, মাহমুদউল্লাহ এবারও শুরু দোসর হয়েই ছিলেন।
বা জিম্বাবুয়ের সঙ্গে গত সিরিজের পঞ্চম ওয়ানডের কথাই চিন্তা করুন। মাত্র ১৩০ রান তাড়া করে উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশ। একপ্রান্তে মাহমুদউল্লাহ আগলে ছিলেন , ৫১ রান করে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। ওই ম্যাচেও বোলারদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই, মাহমুদউল্লাহর কথা মনে রেখেছে কয়জন ? কিংবা ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওই ম্যাচটাও তো একই ঘটনার সাক্ষী। এবার সেবার জিম্বাবুইয়ের ২২১ রান তাড়া করতে নেমে ১২৫ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। সেখান থেকে পর নাঈম আর মাহমুদউল্লাহ মিলে ম্যাচটা বের করে এনেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৭০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসে নায়ক নাঈমই। তবে ব্যাটে ৩৩ রান করার আগে বল হাতেও যে মাহমুদউল্লাহ ৩ উইকেট নিয়েছিলেন, সেটা ওই ম্যাচের পরেই হয়তো অনেকে ভুলে গিয়েছিলেন।
অথচ এইসব কীর্তি করতে হয়েছে ৭ বা আট নম্বরে ব্যাট করেই। একসময় গাভাস্কার যাকে "বিশ্বের সেরা আট নম্বর ব্যাটসম্যান" বলেছিলেন, সেই প্রশংসার মণিহার অনেকদিন কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল মাহমুদউল্লাহর গলায়। সাত বা আট নম্বর কি তাঁর সামর্থ্যের জানান দেওয়ার জায়গা ? নিজেও হয়তো সবসময় বিশ্বাস করে ছিলেন তাঁর আরও ওপরেই ব্যাট করা উচিত। সেটা বোঝাতে একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছেন। ৬৩ ইনিংস তো খেলে ফেললেন সাতে ব্যাট করে, গড় ৩৩.৩৫। অথচ গত নভেম্বর থেকে তিন-চারে খেলার পর যেন নিজেকে ফিরে পেয়েছেন নতুন করে। চারে নেমে এর মধ্যেই দুইটি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন, গড় ১৫২!
কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, বল হাতে মাহমুদউল্লাহ যতবার জ্বলে উঠেছেন, প্রতিবারই ব্যাট হাতে কিছু না কিছু করেছেন। ক্যারিয়ারে তিন উইকেট পেয়েছেন চারবার, এই চার ম্যাচে রান করেছেন ৩৩, ৬০*,৩৫, ৫৬*। মজার ব্যাপার, এই চার ম্যাচের একবারও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হননি। এই বিশ্বকাপের আগে ম্যাচসেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনবার, একবার জিম্বাবুয়ের সঙ্গে গত সিরিজে ৮২ রানের ইনিংসের জন্য। তার আগে ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ২ উইকেট নেওয়ার পর করেছিলেন ৪৮ রান। আর প্রথমবারের স্মৃতিও জড়িয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে, ২০০৯ সালে ২ উইকেট ও ৫১ রান নিয়ে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
তবে এই বছর বাদ দিলে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়টা গেছে ২০১২ সালেই। ওই বছর ৯ ম্যাচে ৭০.৬৬ গড়ে করেছিলেন ২১২ রান, তবে তখনও ব্যাট করতে হতো সাত-আটে নেমেই। মাহমুদউল্লাহ যে ব্যাটিংয়ের বড় ভরসা হতে পারেন, বিশেষ করে ওয়ানডেতে, সেটা তো গত জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকেই দেখানো শুরু করেছেন!
ভারতের সঙ্গে রেকর্ডটাও মন্দ নয়, ১০ ম্যাচে ৪৯.৬০ গড়ে করেছেন ২৪৮ রান। কিন্তু ম্যাচ জেতানো ইনিংস যেটাকে বলে, সেরকম কিছু এখনও পাওয়া হয়নি। কিন্তু এই বিশ্বকাপ দেখিয়েছে, এমন অনেক কিছুই হবে, যা হয়নি আগে । কাল মেলবোর্নের মঞ্চ সাজানোই আছে, মাহমুদউল্লাহর এখন কেবল সেটিকে নিজের করে নেওয়ার পালা।