• বুন্দেসলিগা
  • " />

     

    যে জীবন 'শিল্পী' লামের...

    যে জীবন 'শিল্পী' লামের...    


    ২০০৩ সালের কথা। বয়স তখন তাঁর ১৯ বছর। বায়ার্নে তখন দুই ফরাসী ফুলব্যাকের রাজত্ব। বিজেন্তে লিজারাজু, উইলি সানিওলের সঙ্গে দলের তাঁর জায়গাই হচ্ছিল না। বায়ার্নের রিজার্ভ দলের কোচ হারমান গারল্যান্ড বুঝতে পারলেন, এই ছেলেটাকে এভাবে বসিয়ে রাখলে সোনায় মোড়ানো বুট জোড়ায় মরচে ধরে যাবে। কিন্তু শুরুতে কেউ তেমন একটা আগ্রহ দেখালো না। তবে হীরা চিনতে ভুল করেননি স্টুটগার্ট কোচ ফেলিক্স ম্যাগাথ। গারল্যান্ড ওই তরুণকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন, 'ওকে দেখতে মনে হবে ১৫ বছর, কিন্তু খেলে ৩০ বছর বয়সীর মতো।' তবে ম্যাগাথকে তো আরও কিছু জানতে হবে। গারল্যান্ড তখন বললেন, 'এই ছেলেকে ডিফেন্সের ডানে, বাঁয়ে, মধ্যমাঠে যেখানে ইচ্ছা খেলানো যাবে।'


    গারল্যান্ড কি তখন বুঝতে পেরেছিলেন, বছর দশেক পর তাঁর কথাটা এভাবে ফলে যাবে? 

     

    ২ 

    দশ বছর পরের কথা। ছেলেটাকে সবাই তখন একনামে চেনে। ক্যারিয়ারের শুরুতে লেফটব্যাক ছিল, ততদিনে সেটা বদলে হয়ে গেছে রাইটব্যাক। বায়ার্ন মিউনিখ আর তাঁর নাম মোটামুটি সমার্থকই হয়ে গেছে। ম্যাচটা ছিল উয়েফা সুপার কাপের ফাইনালে। তখন কেবল দায়িত্ব নিয়েছেন পেপ গার্দিওলা। চেলসির বিপক্ষে ১-০ গোলে পিছিয়ে বায়ার্ন মিউনিখ। গার্দিওলার কপালে চিন্তার ভাঁজ, কিছু একটা করা দরকার। ম্যাচ তো ফসকে যাচ্ছে! 'পেপ কনফিডেনশিয়াল' বইতে পরে গার্দিওলা জানিয়েছেন, বুদ্ধিটা ছিল তাঁর ওই সময়ের সহকারী কোচ ডমেনেক তরেতের। তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন, ফুটবলারটিকে সরিয়ে মিডফিল্ডে নিয়ে আসার। ব্যস, গার্দিওলা সেটাই করলেন। এরপর থেকে তাঁর পজিশন বদলে হয়ে গেল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। কিন্তু ধার, ম্যাচ বুঝতে পারার ক্ষমতা কমল না এতটুকু। 

     

     

                                              যখন ছোট ছিলেন...

                           

     


    গার্দিওলা অবশ্য তাঁকে চিনতে শুরু করেছেন আরও পরে। বার্সেলোনায় থাকতে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের একদম কাছ থেকে দেখেছেন। বায়ার্নেও তো রিবেরি, মুলার, রোবেন, নয়্যারদের মতো খেলোয়াড়দের সামলাতে হয়েছে। কিন্তু তাঁকে যে সার্টিফিকেট গার্দিওলা দিয়েছেন, সেটা একজন ফুটবলারের জন্য জিপিএ-ফাইভ পূর্ববর্তী যুগের স্ট্যান্ড করার নম্বরপত্রের মতো মূল্যবান, 'আমি অনেক ফুটবলার দেখেছি, তবে আমার দেখা ও-ই সবচেয়ে বুদ্ধিমান ফুটবলার।' সেই সঙ্গে তিনি বাঁধাই করে রাখতে পারেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার কার্লোস আলবার্তোর দেওয়া আরেকটি সার্টিফিকেটও, 'আমার মাঝে মাঝে ওকে দেখলে অবাক লাগে। ও তো ভুল করেই না বলতে গেলে। আমাদের সময়ে ওয়েবার, শুলস, হোলজদের মতো রাইটব্যাক দেখেছি। ওরা ছিল মেশিন। কিন্তু ও তো একজন শিল্পী। 



    সারাজীবন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তপস্যাই করে এসেছেন। রাইট বা লেফটব্যাক হয়ে আক্রমণ-রক্ষণের এমন নিখুঁত সমন্বয় তাঁর আগে কজনের পায়ে ছিল? ২০১৩ সালে যেবার ইয়ুপ হেইঙ্কেসের বায়ার্ন রেকর্ড গড়ে ট্রেবল জিতেছিল, সেবার তাঁর-রোবেনের জুটিটা বলতে গেলে অপ্রতিরোধ্যই হয়ে গিয়েছিল। একাই করিয়েছিলেন ১১টি গোল, বুন্দেসলিগার তার আগের ৩০ বছরের ইতিহাসে কোনো ডিফেন্ডারের যে কীর্তি নেই। ক্যারিয়ারে ১৮টি শিরোপা জিতেছেন, সব ফুটবলারের আরাধ্য বিশ্বকাপেও চুমু খাওয়া হয়েছে। এক ইউরোই শুধু অধরা থেকে গেছে, ক্যারিয়ারে বলতে গেলে এই শুধু আফসোস। 



    তবে আফসোস নয়, একটা সময় ক্ষোভের রীতিমতো বিস্ফোরণ হয়েছিল। সেটা সেই ২০০৯ সালের কথা। বায়ার্ন মিউনিখ তখন আজকের বায়ার্ন ছিল না। অবশ্য ততদিনে দলে নিজের অবস্থান পাকা করে ফেলেছেন। ওটমার হিজফেল্ডের বদলে দলে এসেছেন লুই ফন গাল। কিন্তু নতুন মৌসুমেও বায়ার্ন যেন ব্যর্থতার খোলসেই বন্দি। রোবেন, গোমেজরা দলে এসেছেন, কিন্তু তারপরও আজকের বায়ার্নের মতো দলটা অমন সর্বজয়ী ছিল না। প্রথম ১২ ম্যাচ শেষে বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন পড়ে রইল আটে। মনে মনে ঠিক করলেন, এবার কিছু কথা বলার সময় হয়েছে। 


    এক জার্মান পত্রিকাকে তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকারে সবাই দেখল অন্য একজনকে, 'চ্যাম্পিয়নস লিগে অন্য সব বড় দলের অন্তত ছয়-সাতটি পজিশনে বিশ্বমানের খেলোয়াড় আছে। আমাদের সেটি নেই। অন্য সবার খেলোয়াড় কেনাবেচার একটা দর্শন আছে, আমাদের সেটা নেই। শুধু ভালো খেলোয়াড় কেনাই যথেষ্ট নয়, ক্লাবের একটা দর্শনও থাকতে হবে।'


     মন্তব্যটা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল আলিয়াঞ্জ এরেনায়। ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে ১০ হাজার ইউরো জরিমানা করলেন। কিন্তু আপাত স্থিতধী তাঁর সেই ঠোঁটকাটা কথার কল্যাণেই হোক আর যে কারণেই হোক, এরপর থেকে বায়ার্ন বদলে গেল। সেই মৌসুমেই ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতল বুন্দেসলিগা, পেল জার্মান কাপও। একটুর জন্য পাওয়া হয়নি চ্যাম্পিয়নস লিগ। 


    ৬ 
    কম ক্লাব তো চায়নি লোকটাকে। সেই ২০০৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের নজর পড়েছিল তাঁর ওপর। পাকা জহুরি ফার্গি, হীরে চিনতে ভুল করেন না। এই ছেলেকে আমার চাই, বলে রেখেছিলেন। কিন্তু বায়ার্ন তাঁকে ছাড়েনি। এরপর রিয়াল মাদ্রিদ, চেলসি কত ক্লাবই তো তাঁকে চেয়েছিল। যাননি। বায়ার্ন ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তাও আনেননি। স্টুটগার্টের ওই ধারের দুই বছরও তো আসলে বায়ার্ন থেকে বেরিয়ে আসার মতোই। ক্যারিয়ারের শেষেও তো চাইলে অন্য অনেক বড় ক্লাবে যেতে পারতেন। এখনকার প্রায় অকেজো হয়ে যাওয়া ফুটবলারদের মতো চীন বা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো তো অনেক দূরের কথা। বয়স তো মাত্র ৩৩। চাইলেই আরও কয়েকটা বছর স্বাচ্ছন্দ্যেই অন্য কোনো বড় ক্লাবে খেলে আসা যেত। কিন্তু তাঁর পেশাদারিত্ব যে আর সবার মতো নয়। নিজের সামর্থ্যের সেরাটা যখন দেওয়ার ক্ষমতা কমে আসছে, কেন শুধু শুধু নিজের সঙ্গে আপোস করবেন? 'ও তো এখন বোঝা হয়ে যাচ্ছে' - আর যাই হোক, এই কথা তো কাউকে বলতে দিতে পারেন না! 


    বায়ার্নকেই সারাজীবন করেছেন ধ্রুবতারা। একটা সময় ক্লাবের বলবয় ছিলেন। কান, ম্যাথাউসদের দেখে ভেবেছেন এক দিন হতে হবে তাঁদের মতো। তাই অন্য ক্লাব থেকে লোভনীয় সব প্রস্তাব এলেও  সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, 'বায়ার্ন আমার শৈশবের ক্লাব। আমি সব সময়ই এখানে খেলতে চেয়েছি। আর দিন শেষে সেটাই ঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই না? আমার মনে হয়েছে আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতব, এবং সেটা আমরা করে দেখিয়েছি। ইংল্যান্ড হয়তো দারুণ একটা জায়গা, কিন্তু আমি জার্মানিতেই থাকতে চেয়েছি।'
     


    সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়টা অবশ্য আরও আগেই আসতে পারত। ২০১৩ সালে ডর্টমুন্ডকে হারানোর আগের বছরেই তো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছিল বায়ার্ন। নিজের দেশে, নিজের ক্লাব আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতেই পাকেচক্রে পড়ে গিয়েছিল ফাইনাল। অধিনায়ক তিনি, মঞ্চটা সাজানো ছিল তাঁর ট্রফি হাতে তোলার। কিন্তু দিদিয়ের দ্রগবা এসে সব ভজকট পাকিয়ে দিলেন। অতিরিক্ত সময়ের গোলে সমতা ফেরানোর পর টাইব্রেকারে জিতে গেল চেলসি। এক বছর পরেই সেই দুঃখটা ভুলেছিলেন। কিন্তু নিজের মাঠে এমন একটা অর্জন হাতছাড়া হওয়ার হতাশা কি সহজে ভোলা যায়? 

     

     

                                                             চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি হাতে



    আক্ষেপ তো ক্যারিয়ারে কম নেই। দেশের মাটিতে জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের সুবর্ণ সুযোগও তো এসেছিল। ২০০৬ বিশ্বকাপে লম্বা চোট কাটিয়ে ফিরেছিলেন মাঠে, দলে জায়গাটাও ঠিক থিতু ছিল না। ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই প্রথম একাদশে নামিয়েছিলেন। কোচকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য সময় নিলেন মাত্র ছয় মিনিট। বিশ্বকাপের প্রথম গোলটা এলো তাঁর পা থেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে ইতালির কাছে হেরে শেষ হয়ে যায় যাত্রা। দুই বছর পর তো আরও কাছাকাছি, এবার হাতছানি দিচ্ছিল ইউরোর শিরোপা। কিন্তু ফাইনালে এক তোরেসের কাছেই হেরে গেল জার্মানি। চার বছর পর আবার হন্তারক ইতালি। ইউরোর শিরোপাটা না পেয়েই জার্মানির জার্সি উঠিয়ে রাখতে হয়েছিল। এই আক্ষেপ তো সহজে যাওয়ার নয়। 

     


    তবে ক্যারিয়ার শেষে এসব আর মনে রাখতে চাইবেন না। বায়ার্ন কোচ কার্লো আনচেলত্তি তো অনুনয় করেই বলেছেন, আরও কিছুদিন থেকে যেতে। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। ইয়ুপ হেইঙ্কেস বলেছেন, এবার তাঁকেই জার্মান বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাবটা দেওয়া উচিত। সেটা তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু তিনি এসব নিয়ে ভাবেননি কখনোই। অবসরের পর প্রথম কাজ হবে ছেলেকে নিয়মিত কিন্ডারগার্টেনে নিয়ে যাওয়া- নিজেকে নিয়ে এমনই নির্লিপ্ত। কোচিং বা এসব কিছুর কথা তো ভাবছেনই না। রসিকতা করে অবশ্য বলেছেন, পরের মৌসুমে রিবেরি তাঁকে বায়ার্নের কিছু ম্যাচের টিকিট কিনে দেবেন। 


    ফিলিপ লাম বোধ হয় এমনই। রক্ষণকে যিনি শিল্প করে তুলেছেন, নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। ব্যালন ডি অর বা অন্য অনেক স্বীকৃতি হয়তো পাননি, তাতে তাঁর বোধ হয় কিছু আসে যায় না। নিজের কাজটা ঠিকমতো করেছেন, এটাই তো তাঁর তৃপ্তি!