গর্ব নিয়েই ফিরেছে বাংলাদেশ
বিশ্বকাপ শুরুর আগেও যদি বলা হতো- বাংলাদেশ দল কোয়ার্টার ফাইনাল যাবে, কয়জন সেটা বিশ্বাস করতেন? বিশেষ করে, প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের কাছে হারের পর তো অনেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। স্কটল্যান্ড ও আফগানিস্তানের সঙ্গে জয় পেলেই সেটাকে তখন মহার্ঘ্য ভাবা হচ্ছিল। বড় দলগুলোর সঙ্গে জয় তো দিল্লি দূর অস্ত। এমনকি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড কতগুলো রেকর্ড ভেঙে ফেলবে সেটা নিয়েও ছিল আশঙ্কার কালো মেঘ। এখন, এই প্রলম্বিত বিশ্বকাপ শেষে বাংলাদেশ দল যখন দেশে ফিরছে, সব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে দেওয়ার গৌরব তাদের মুখে থাকতেই পারে। প্রথমবারের মতো, বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ওঠাই শুধু নয়, এবারের আসর থেকে প্রাপ্তির ডালি অনেকটা পূর্ণ করেই বাংলাদেশ দল দেশে ফিরছে।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনটাই বাংলাদেশকে ভীষণভাবে চোখ রাঙাচ্ছিল। ড্রপ ইন উইকেট ব্যাটিং বান্ধব হবে সেটা জানা কথাই ছিল, কিন্তু বল সহজে ব্যাটে আসে এমন উইকেটে তো বাংলাদেশ আগেও বিস্তর খাবি খেয়েছে। আর নিউজিল্যান্ডের উইকেটে সুইং সামলাতে না পারার সংশয় তো ছিলই। সবচেয়ে বড় কথাই, এই দলের খুব কম খেলোয়াড়েরই অস্ট্রেলিয়া সফরের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। নতুন কন্ডিশনে অনভ্যস্ততার সব শঙ্কা শেষ পর্যন্ত অলীক প্রমাণ করেছেন মাশরাফিরা।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি ? জিভের গোড়ায় শুরুতেই চলে আসবে মাহমুদউল্লাহর নাম। এই ব্যাটসম্যানকে নতুন করে আবিষ্কারটাই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। বরাবরই পাদপ্রদীপের বাইরে থাকা মাহমুদউল্লাহ-ই এবার আলো ছড়িয়েছেন সবচেয়ে বেশি। বিশ্বকাপে একটা সেঞ্চুরির জন্য তৃষিত বাংলাদেশের আক্ষেপ দূর করেছেন, তাও ইংল্যান্ডের সঙ্গে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। সেখানেই শুধু থামেননি,নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পরের ম্যাচে করেছেন সেঞ্চুরি। শাহরিয়ার নাফীসের পর টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি আর কোনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের নেই। কে ভাবতে পেরেছিল এই বিশ্বকাপের প্রথম সাতজন ব্যাটসম্যানের মধ্যেও বাংলাদেশের একজনের নাম জ্বলজ্বল করবে ? একসময় সাত-আটে ব্যাট করাটাই ছিল যার নিয়তি, সেই মাহমুদউল্ললাহ চার নম্বরে এখন বাংলাদেশের অটোমেটিক চয়েস।
ব্যাটিংয়ে মাহমুদউল্লাহর পর সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন আবিষ্কার সৌম্য সরকার। এই বিশ্বকাপের আগে মাত্র একটি ওয়ানডে খেলেছিলেন এই অলরাউন্ডার। ছোট্ট পুকুর থেকে ঝট করে মহাসমুদ্রে এসে কতটা কী পারবেন সেটা নিয়ে সংশয় ছিল। সৌম্য হয়তো খুব বড় কিছু করতে পারেননি, তবে নিজের অমিত সম্ভাবনা জানান দিয়েছেন প্রায় সব ম্যাচেই। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৪০ রান বা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৫১ রানের ইনিংস দুইটি দলের ওপর থেকে চাপ যেমন কমিয়েছে, তেমনি চোখের জন্যও ছিল দারুণ আনন্দদায়ী। একটু ঝুঁকি নিয়েই বলে ফেলা যায়, বাংলাদেশ ভবিষ্যতের ব্যাটিং নির্ভরতাকে বোধহয় পেয়েই গেছে।
মুশফিকের জন্য ব্যাপারটা অন্যরকম, নিজেকে প্রমাণ করার কিছুই নেই। গত কয়েক বছর ধরে যেটা সবাই জানত, বিশ্বকাপেও প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের নিউক্লিয়াস মুশফিকই। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৮৯ রানের ওই ইনিংসটা বাংলাদেশের ইতিহাসেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলোর একটি। মাত্র ২ রানের জন্য এই বিশ্বকাপে ৩০০ রান হয়নি, তবে মুশফিক বিশ্বকাপে আরও একবার প্রমাণ করেছেন, দল বিপদে পড়লে তাঁর ব্যাটটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে চওড়া।
বোলিংয়ে সেই কাজটা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন তিন পেসার। শেষ কবে বাংলাদেশের তিনজন পেসার একসঙ্গে এমন খেলেছেন সেটা মনে করা দূরহ একটা ব্যাপার। বিশ্বকাপে কোনো বাংলাদেশি পেসারের সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার কীর্তি ছিল মাশরাফির, ২০০৭ সালে। এবার সেই রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন মাশরাফির যোগ্য উত্তরসূরি হতে যাওয়া তাসকিন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে খেই হারিয়ে ফেলবেন কিনা সেটা নিয়েও তো সংশয় ছিল। তাসকিন দেখিয়েছেন, সিনিয়র দুই বোলারকে যোগ্য সঙ্গ তো বটেই, তাদেরকেও ছাড়িয়েও যেতে পারেন। মাশরাফি গতি হারিয়েও তুলে নিতে পারেন ব্রেক থ্রু, আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে ওই স্পেলের জন্য রুবেল তো স্মরণীয়ই হয়ে থাকবেন। সব মিলে বাংলাদেশের তিন পেসার তুলে জনিয়েছেন ২৪ উইকেট, আর কোনো বিশ্বকাপ এর ধারেকাছেও নেই। কে-ই বা ভেবেছিল, স্পিনভারাতুর দলে পেসাররাই এমন মধ্যমণি হয়ে উঠবেন ?
হয়তো অনেকের আড়ালে চলে যাবে, সাত নম্বরে সাব্বিরও বিশ্বকাপের আরেকটি প্রাপ্তি বটে। সাত নম্বর ব্যাটসম্যানের জায়গাটা বহুদিন বাংলাদেশ দলের জন্য একিলিস হয়ে ছিল। এই বিশ্বকাপে সাব্বির জানান দিয়েছেন, বাংলাদেশ তাঁর ওপর ভরসা করতে পারে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৪০ রানের ইনিংসটা ছিল দারুণভাবে পরিস্থিতির দাবি মেটানো।
সব মিলে এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশ দলকে দুই হাত ভরেই দিয়েছে। প্রাপ্তির পাশাপাশি কিছু আক্ষেপও যে নেই, তা নয়। কিন্তু সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে...