আর্সেনালের ৯ নম্বর মানেই অপয়া?
নয় নম্বর জার্সিটা যে একজন স্ট্রাইকারের গায়েই শোভা পায়, ফুটবলের অল্পস্বল্প খবর রাখা লোকটাও বোধ হয় তা জানেন। নতুন ক্লাবে যোগ দিয়ে নয় নম্বর জার্সিটা পেতে চান প্রায় সব স্ট্রাইকারই। কিন্তু আর্সেনালে যোগ দেয়া নতুন ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার আলেক্সান্ডার লাকাজেতের জন্য ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। ক্লাব রেকর্ড গড়ে দলে নতুন স্ট্রাইকারকে ভিড়িয়েছে নর্থ লন্ডনের ক্লাবটি। তাঁকে দেয়া হয়েছে আর্সেনালের নয় নম্বর জার্সিও। কিন্তু তারপরও কি একটা খচ খচানি থাকবে লাকাজেতের?
এমন প্রশ্ন উদয়ের কারণও অবশ্য আছে। তাও আবার ওই জার্সি নম্বর সংক্রান্তই। আর্সেনালের ‘নাম্বার নাইন’ যে অপয়া। আর্সেন ওয়েঙ্গার দলের হাল ধরার পর থেকেই একজন সফল নয় নম্বর জার্সিধারীও দেখেনি আর্সেনাল। হাইবুরি থেকে এমিরেটস। ঠিকানা বদলেছে, কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি এই ক্ষেত্রে।
ওয়েঙ্গারের আমলে এই জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন আনেলকা, হোসে আন্তোনিও রেয়েস, হুলিও বাপতিস্তারা। এরপর এদুয়ার্দো থেকে পোডলস্কি- কেউই কাটাতে পারেননি সাফল্যখরা। ব্যর্থতাই যেন একমাত্র ভাগ্য।
যেমন ডেভর সুকারের কথাই ধরা যাক। ১৯৯৯-০০ মৌসুমের শুরুতে নিকোলাস আনেলকার জায়গায় দলে এসেছিলেন ক্রোয়েশিয়ান মহাতারকা। আগের বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জিতেছিলেন যিনি। নতুন ক্লাবে এসেই যেন ভুলে গেলেন গোলের ঠিকানা। হাইবুরিতে সতীর্থদের হাইফাইভ দেয়ার মুহুর্ত পেয়েছেন হাতে গোণা কয়েকবার মাত্র। লিগে খেলতে পেরেছিলেন ২২ ম্যাচ। গোল করেছলেন ৮ টি। ইউয়েফা কাপের ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে বদলী হয়ে নেমেও করতে পারেননি কাজের কাজটা। পেনাল্টি মিস করেছিলেন টাইব্রেকারে। গ্যালেতাসারেইর কাছে হারে ফাইনাল শেষ হয় আর্সেনালের। সাথে বিদায়ঘন্টা বাজে আর্সেনালের নাম্বার নাইনেরও।
ডেভর সুকারের বিদায়ের পর ওই জার্সি গেল ফ্রান্সিস জেফারের কাছে। তাঁকে নিয়ে অবশ্য সুকারের মতো এতো মাতামাতি ছিল না নর্থ লন্ডনে। অনেক ব্যর্থতার ভিড়ে তাঁর কথা মনে রাখেন খুব আর্সেনাল সমর্থকই।
সবসময় যে স্ট্রাইকারদের ব্যর্থতার দায়েই আর্সেনালের নাম্বার নাইনকে অভিশপ্ত বলা হয়- তাও কিন্তু নয়। স্ট্রাইকার বাদে উইঙ্গাররও গায়ে চড়িয়েছেন সেই জার্সি। হোসে আন্তোনিও রেয়েসের সময়কালটা তাই ঠিক অপয়া বলা যায় না সে অর্থে। ছিলেন বিখ্যাত ‘ইনভিন্সিবল’ দলের সদস্যও। কিন্তু আর্সেনালে কাটানো তিন মৌসুমে সেভাবে আলো কাড়তে পেরেছিলেন কমই। অপয়াদের দলে তাই না চাইতেও চলে আসে স্প্যানিশ উইঙ্গারের নাম।
যে জার্সির নম্বর নিয়ে এতো কথা, তার ব্যর্থতাটা কিন্তু নেহায়েত কম নয়। এই শতাব্দীতে আর্সেনালের নয় নম্বর জার্সি গায়ে খেলোয়াড়দের ব্যর্থতা আঁচ করা যায় ছোট এক পরিসংখ্যান দিয়ে। লিগ জিততে চাওয়া দলের স্ট্রাইকারদের কাছ থেকে সাধারণত ১৫/২০ গোল দাবি করেন ম্যানেজাররা। অথচ নিকোলাস আনেলকার পর আর্সেনালের নয় নম্বরধারী কোনো স্ট্রাইকারই লিগে তাঁদের গোলের সংখ্যা নিয়ে যেতে পারেননি দুই অংকের ঘরে। একমাত্র লুকাস পোডলস্কি ছাড়া। ২০১২-১৩ মৌসুমে আর্সেনালে যোগ দিয়ে লিগে ১১ গোল করেছিলেন জার্মান এই স্ট্রাইকার। এরপর বাকি দুই মৌসুম মিলিয়েও দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেনি পোডলস্কির গোলের সংখ্যা।
পোডলস্কি দলে আসার আগের মৌসুমে অবশ্য ঘটেছিল অদ্ভূত এক ঘটনা। সাউথ কোরিয়ান স্ট্রাইকার পার্ক চু-ইয়াং পরেছিলেন আর্সেনালের নয় নম্বর। ইংলিশ ক্লাবে যোগ দেয়ার আগে খুব কম মানুষই জানতেন তাঁর নাম। লন্ডন ছেড়েছেন নিভৃতেই। মাঝে কাটানো এক মৌসুমে একবার মাত্র নামতে পেরেছিলেন প্রিমিয়ার লিগের আলোঝলমলে এমিরেটেসের মাঠে।
বোঝাই যাচ্ছে আর্সেনালের নাম্বার নাইন কপালটা পুড়ে গেছে বহু আগেই! কিন্তু ব্যর্থতাঁর গল্প কিন্তু এখানেই শেষ না। আশা দেখিয়েও অনেককেই ব্যর্থ হয়ে ধরতে হয়েছে প্যাভিলিয়নের পথ। সবচেয়ে বড় উদাহরণ, এদুয়ার্দো। ক্রোয়েশিয়ান এই স্ট্রাইকার শুরুটা করেছিলেন ভালোই। কিন্তু ইনজুরি জর্জরিত আর্সেনাল ক্যারিয়ারে সাফল্যের দেখা পাননি। ইনজুরিতে একসময় হারাতে বসেছিলেন নিজের ক্যারিয়ারটাই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ফিরেছিলেন। তবে আর্সেনালের হয়ে নয়।
প্রিমিয়ার লিগের গতিময় ফুটবলে তাল মেলাতে না পেরেও ব্যর্থ হয়েছেন অনেকে। তাঁদের দলে রেয়েসের সাথে আসে হুলিও বাপতিস্তার নামটাও। ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ধারে এসে এক মৌসুম শেষেই বাক্সপেটরা গুছিয়ে খুঁজেছেন নতুন ঠিকানা। তাঁর গল্পেও নেই সাফল্য।
সব ব্যর্থতার গল্পে অবশ্য একটুখানি স্বস্তি খুঁজতে পারেন লাকাজেত। নিকোলাস আনেলকার আর্সেনাল ক্যারিয়ারে। ওয়েঙ্গার তখনও নতুন আর্সেনালে। টিনএজ এক কিশোরকে কিনে আনলেন পিএসজি থেকে। প্রথম মৌসুমে অবশ্য দলে জায়গায় পেলেন না তিনি। কিন্তু পরের মৌসুমে জার্সির নয় নম্বরসহ জুটল প্রথম একাদশে খেলার নিয়মিত সুযোগটাও। সেবারই আলো কেড়েছিলেন। পিএফএ ইয়াং প্লেয়ারের পুরষ্কারটা পেয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সী আনেলকা। লিগ, এফএকাপ মিলিয়ে ডাবলস জিতেছিল আর্সেনালও। এরপর অবশ্য তাঁর শেষটাও মধুর হয়নি। পরের মৌসুম শেষেই ক্লাবের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে ক্লাব ছাড়তে হয়েছিল তাঁকেও।
কিন্তু আনেলকাকে সমর্থকেরা মনে রেখেছিল ওই এক মৌসুমের জন্যই। আপাতত সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে পারলেই নয় নম্বরের অভিশাপটা ভুলিয়ে দিতে পারবেন লাকাজেত। ক্লাবের রেকর্ড সাইনিং খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এটুকু চাইতেই পারেন আর্সেনাল সমর্থকেরা। কিন্তু শুধুমাত্র নতুন একটা জার্সি নম্বর নিয়েই প্রত্যাশার যে চাপে পড়ে গেলেন সেখান থেকে উঠতে পারবেন তো লাকাজেত? নাকি আর্সেনালের পুরোনো গ্লানিটাই বাড়াবেন আরও?