বিশ্বকাপের টুকরো ছবি
শেষ হয়ে গেল আরও একটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। অনেক ঘটন-অঘটনের বিশ্বকাপের স্মৃতিচারণ পর্ব চলছে এখন, চলবে হয়তো আরও কিছুদিন। আমেজটুকু মিলিয়ে যাওয়ার আগে চলুন এক নজর চোখ বুলিয়ে আসা যাক কিছু টুকরো ঘটনায়।
১৬ সদস্যের অস্ট্রেলিয়া দল
ব্যাপারটা পূর্বানুমিতই ছিল, পঞ্চমবারের মতো জেতা বিশ্বকাপটা অস্ট্রেলিয়া দল অকাল প্রয়াত অজি ক্রিকেটার ফিলিপ হিউজকে উৎসর্গ করবে। কাল ট্রফি গ্রহণের মঞ্চে অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের তরফে সে ঘোষণাটাই এলো একটু ভিন্নভাবে, “আমি নিশ্চিত এই মঞ্চে উপস্থিত প্রত্যেকেই বলবে এবার বিশ্বকাপ আমরা খেলেছি ১৬ জনের দল নিয়ে। এই বিজয় আমাদের অনুজপ্রতিম ফিলিপ হিউজকেই উৎসর্গ করলাম।”
টুইটারে খোঁচা, মাঠে জবাব গেইলের
পাক্কা দু’ বছর ব্যাটে রান নেই। ক্রিস গেইলের উপর বিরক্তদের তালিকাটা দিনকে দিন লম্বাই হচ্ছিল। বিশ্বকাপের মাঠেও যখন তাঁর ব্যাট জ্বলে উঠলো না তখন আর বিরক্তিটা চেপে রাখতে পারলেন না খোদ ক্যারিবিয় ক্রিকেট বোর্ড প্রধান ডেভিড ক্যামেরনও। জনৈক দর্শকের এক মন্তব্য ‘রি-টুইট’ করলেন ক্যামেরন যাতে লেখা ছিল, “গেইল মাঠে যায়-আসে, রান করতে পারে না...তাঁকে এবার অবসরে পাঠানো হোক!”
এ ঘটনার ঠিক পরের ম্যাচটাতেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম দ্বিশতক হাঁকিয়ে বসেন ক্যারিবিয়ান তারকা! ক্যামেরন অবশ্য পরবর্তীতে তাঁর অমন বোকামির জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
গাপ্টিলের গর্জন
গেইলেই রেকর্ডের স্থায়িত্বটা খুব লম্বা হল না। কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই সেটা ভেঙে দিলেন কিউই ওপেনার মার্টিন গাপ্টিল। ওই অপরাজিত ২৩৭ রানই এখন বিশ্বকাপের মাঠে সর্বোচ্চ। একই দিনে তিনি ভাঙেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ওডিআই ইনিংসের তাঁরই এক পুরনো রেকর্ড, যেটা ছিল ১৭৯ রানের।
ম্যাক্সওয়েলের বুমেরাং
অকল্যান্ডের মাঠে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ চলছে। অস্ট্রেলিয়ার করা ১৫১ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ১৪৬ রানের মাথায় নবম উইকেট খুইয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। গ্যালারিতে তখন নখ কামড়ানো উত্তেজনা। আগুনে ঘি ঢেলে দিতেই বুঝি দর্শকদের দিকে ফিরে হাত দিয়ে কিউইদের গলা কাটার ইঙ্গিত করলেন অজি ফিল্ডার ম্যাক্সওয়েল। খানিকবাদে সেই ম্যাক্সওয়েলের মাথার উপর দিয়েই ছয় হাঁকিয়ে নিউজিল্যান্ডকে জিতিয়ে দেন উইলিয়ামসন। দর্শকদের উল্লাসের ভিড়ে ম্যাক্সওয়েলের উদ্দেশ্যে দুয়োটা হয়তো তিনি ঠিকই টের পেয়েছিলেন!
মাশরাফি-তাসকিনের উদযাপন
বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনালের গল্প। ভারতের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আজিঙ্কা রাহানে তাসকিনের বলে সাকিবের তালুবন্দী হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ক্যামেরা ঘুরে গেলো তাসকিন আর অধিনায়ক মাশরাফির দিকে, দুই সতীর্থ তখন বুকে বুক মিলিয়ে উদযাপন করছেন রাহানের উইকেট। যুক্তরাষ্ট্রের টেনিস তারকা ব্রায়ান ভ্রাতৃদ্বয়ের বিখ্যাত উদযাপনটা ক্রিকেট মাঠে নিয়ে এলেন দুই বাঘ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তোলা দৃশ্যটা হয়ে গেছে ক্রিকেটীয় উদযাপনেরই বিরলতম ছবিগুলোরই একটি।
ওয়াহাব-ওয়াটসন স্নায়ুযুদ্ধ
চলতি বিশ্বকাপ তো বটেই, গোটা ওয়ানডে ইতিহাসেরই সেরাগুলোর একটি বলে ওয়াহাবের ওই স্পেলটাকে মানছেন খোদ অজি অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক। অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান কোয়ার্টার ফাইনালের ঘটনা। ওয়াটসনের উদ্দেশ্যে একেকটা শর্ট বল ছুড়েই তাঁকে বিভিন্নভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছিলেন পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজ।
কখনও বাক্যবানে, কখনও উড়ন্ত চুমু দিয়ে, কখনও চোখের আগুনে, আবার কখনও হাতে তালি বাজিয়ে। মাঝেমধ্যে পাল্টা জবাব দেন ওয়াটসনও। ওয়াটসন-ওয়াহাবের ওই দ্বৈরথ সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে নজর কাড়ে বহু রথী-মহারথীরও। ম্যাচশেষে অবশ্য দু’জনকেই জরিমানার মুখোমুখিও হতে হয়। তবে ব্যাপারটা কতোটা উপভোগ্য ছিল তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকেই; ম্যাচের পর ক্যারিবিয় কিংবদন্তী ব্রায়ান লারা ওয়াহাবের জরিমানার টাকা পরিশোধের আগ্রহ দেখিয়ে টুইট করেন!
জন্মভূমিকে কাঁদালেন এলিয়ট
প্রথমবারের মতো নক-আউট লড়াই জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা উঠে যায় সেমিফাইনালে। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বেশ সংগ্রহের পথেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্স। মাঝপথে বৃষ্টি বাগড়া দেয়ায় শেষপর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৯৭ রানের। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট খুইয়ে প্রায় হেরেই বসেছিল ব্ল্যাকক্যাপরা। অনেক নাটকের সেই ম্যাচ শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড জিতে যায় গ্র্যান্ট এলিয়টের অনবদ্য ৮৪ রানের সুবাদে।
এই এলিয়ট যে দক্ষিণ আফ্রিকারই ছেলে, জোহানেসবার্গে যার জন্ম। শেষ ওভারের রোমাঞ্চে হেরে যাওয়া ম্যাচটার পর মাঠেই কেঁদে ফেলেন ভিলিয়ার্স-মরকেলরা। হতাশায় পিচে শুয়ে পড়া ডেল স্টেইনকে টেনে তুলে সান্ত্বনা দেন এলিয়টই। কিন্তু শোকাহত পাঁচ কোটি দক্ষিণ আফ্রিকানকে সান্ত্বনা দেবে কে?
র্যাম্বো ভক্ত হামিদ হাসান
২৭ বছর বয়সী আফগান পেসার স্বীকার করেছেন, র্যাম্বো তাঁর প্রিয় চরিত্রগুলোর একটি। সেই ভালোলাগা থেকেই কিনা, রুপালী পর্দার র্যাম্বোর মতোই মাথায় একটা ব্যান্ড পরে মাঠে নামেন সবসময়, সেটা আবার আফগানিস্তানের জাতিয় পতাকা খচিত।
শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচে সাঙ্গাকারাকে বোল্ড করে যে ডিগবাজিটা দিলেন, সেটা অবশ্য র্যাম্বো চরিত্রের কোন অনুকরণ নয়! তবে ওই মুহূর্তের ক্যামেরাবন্দী হামিদ হাসান অংশ হয়ে গেছেন ক্রিকেট পুরাণের।
লাকি সিক্সটিন!
আরব আমিরাতের বিপক্ষে ব্যাট করছিলেন আয়ারল্যান্ডের ইডি জয়েস। আমজাদ জাভেদের ইয়র্কার জয়েসের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে আঘাত হানে অফষ্ট্যাম্পে। উল্লাসে ফেটে পড়ার আগে অবাক হয়ে জাভেদ দেখলেন বেল পরে নি জয়েসের! ষ্ট্যাম্পে বল লেগেও বেঁচে যান আইরিশ ব্যাটসম্যান! শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই জাভেদের বলেই উইকেটের পিছনে ক্যাচ তুলে ফিরে যান জয়েস, আরও ২১ রান যোগ করে।
একইরকম আরেকটি ঘটনা ঘটে ফাইনালেও। নিউজিল্যান্ডের ম্যাট হেনরির বল অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথের প্যাড ছুঁয়ে আঘাত হানে স্ট্যাম্পে, কিন্তু আঘাতটা খুব জোরালো হল না বলেই হয়তো বেল বাবাজির স্থানচ্যুত হতে মন চাইলো না! ইনিংসের শুরুর দিকে পাওয়া জীবন নিয়ে শেষ পর্যন্ত স্মিথ মাঠ ছাড়েন দলকে পঞ্চম শিরোপা জিতিয়েই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুটো ঘটনার সময়ই ব্যাটসম্যানদ্বয়ের রান ছিল ১৬!