• বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ ২০১৫
  • " />

     

    ১৬ বছর অপেক্ষার পর...

    ১৬ বছর অপেক্ষার পর...    

    ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নর্দাম্পটনে সেই জয়ের পর কেটে গেছে ১৬ বছর। এরপর অনেকবারই পাকিস্তানের সঙ্গে জয়টা দিগন্তে উঁকি দিয়েও মিলিয়ে গেছে। অবশেষে মিরপুরে হয়েছে শাপমোচন। ঐতিহাসিক এই জয়টাকে আতশ কাচের নিচে দেখলে বেরিয়ে আসবে অনেক মণি-মাণিক্য। লিখেছেন শেখ মিনহাজ হোসেন... 

     

    ১/ তামিমের প্রতি অনেক ভরসা ছিল। প্যাভিলিয়নেই তামিমের দুঃসময়ে তাকে সমর্থন করে সমর্থকদের মনে করিয়ে দেয়া হয়েছিলো জাতীয় দলে তামিমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। রীতিমতো পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে তামিম নৈপুণ্যে অন্যদের তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে নেই। তবু তার থেকে প্রত্যাশা মনে হয় একটু বেশিই থাকে। এজন্যে সমালোচনা বেশি হয়। সমালোচনার জবাব তিনি দিলেন সেঞ্চুরি করে। হয়তো পরের কিছু ম্যাচে তারা আশানুরূপ ব্যাটিং নাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু তামিম, জয়াসুরিয়া, শেহওয়াগেরা ম্যাচ উইনার। তারা এতোটা ধারাবাহিক না হলেও যেদিন খেলবে সেদিন জয়টার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যাবেই।

     

     

    ২/ ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ ঘোষণা করার আগেই নিশ্চিত ছিলাম মুশফিক সেটা পেতে যাচ্ছে। তামিমের ভিত্তির পরেও মুশফিকের ৭৭ বলে ১০৬ রানই আসলে ম্যাচের মোমেন্টাম ঘুরিয়ে দিয়েছে।

     

     

    ৩/ ম্যাচ শুরুর আগে নিজের স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম এই দলটাই প্রায় নিখুঁত লেগেছে। ব্যাটিং অর্ডারের কথা বললে এই অর্ডারটার জন্যই অপেক্ষা ছিল বিশ্বকাপে। মুশফিক-রিয়াদের ব্যাটিং অর্ডারটা ৩-৪ এ অদল বদল হতে পারে। সেটা খুব একটা ফ্যাক্টর হবে না। কিন্তু মুশফিক কখনোই ৬-৭ এ ব্যাটিং করার খেলোয়াড় নয়। ৫-৬-৭ এও সাকিব, সাব্বির, নাসিরই সেরা। পরের ম্যাচে আবুল হাসানের বদলে মাশরাফি আসলে দলটিকে বর্তমান সময়ের সেরা দলই বলতে হবে। রনি তালুকদার, লিটন দাসকে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে।

     

     

    ৪/ বোলিং-ফিল্ডিং আরেকটু প্রফেশনালিজমের অবশ্যই দরকার আছে। রুবেল-তাসকিন অসাধারণ ছিল। বিশেষ করে তাসকিন। ইনজুরিতে না পড়লে আর ৩-৪ বছর পরে ছেলেটা বিশ্বের সেরা পেসারদের কাতারেই থাকবে। ওর সবচেয়ে বড় ব্যাপার গতির সাথে মাথার ব্যবহারটা করতে পারে নিয়মিতই। সাকিবের বোলিং পরিবর্তন বেশ ভালো লেগেছে। মিডল ওভারে দলের গ্রাউন্ড ফিল্ডিং এর মধ্যে কিছুটা গা ছাড়া ব্যাপার ছিল। কিন্তু সানি-সাকিব ম্যাচটা লাগামছাড়া হতে দেয়নি। ক্যাচিং-থ্রোয়িং ম্যাচটার জন্য এক বড় নির্ণায়ক ছিল।

     

     

    ৫/ পাকিস্তানের দিক থেকে বলি। অনভিজ্ঞতা অবশ্যই ওদের ডুবিয়েছে। গত এশিয়া কাপে ১০ ওভারে ১০০+ রান লাগে, এমন অবস্থা থেকেও আফ্রিদি ম্যাচটা বের করে নিয়েছিলো। সত্যি করে বলতেই হবে, পাকিস্তানের ৪-৫ উইকেট পড়ার পরে ম্যাচটা আমরা জিতছি সেটা নিয়ে ন্যূনতম সন্দেহই ছিল না। ব্যাটিংয়ের সময় চাপের মুখে রান আউট, ফুলটসে ক্যাচ দেয়া ছিল, আর বোলিং-ফিল্ডিং এর সময় নতুন ক্যাপ্টেনের একেবারেই আনকোড়া সিদ্ধান্তগুলো ডুবিয়েছে তাদের।

     

     

    ৬/ বাংলাদেশের একটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল নিজেদের অ্যাটিচিউড! ম্যাচটা তো জিতছিই। এই মানসিকতাটা ম্যাচ জয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। শেষ উইকেট পড়বার পরে পুরো দল যেভাবে উল্লাস ছাড়া একেবারেই সাধারণ মুখে হ্যান্ডশেক করলো সেটা বড় দল হবার পথে এক বড় ধাপ। কঠিন ক্যাচগুলো ধরেও একেবারেই সাধারণ ছিল উদযাপন। এমনকি ম্যাচ শেষে শামীম চৌধুরী যখন সাকিবকে বললেন, "এই ম্যাচে ফাস্টেস্ট সেঞ্চুরি হয়েছে।" তখন সাকিব ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলল যে, "ফাস্টেস্ট সেঞ্চুরি হয়নি!" সেটা যে সাকিবের অধিকারে (৬৩ বলে বনাম জিম্বাবুয়ে) সেটা আর বলেনি। কিছুটা ক্ষোভের সাথে সাকিব দর্শকদের এও জানান দিলেন যে, শুধু জেতার সময় না, হারের সময়েও পাশে থাকবেন প্লিজ। মুশফিককে যখন ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের টাকা ভাগ করবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলো তখন মুশি জবাব দিলো "তামিম পরের ম্যাচে নিজে পাবে। এটা আমি দিব না!" এমন আত্মবিশ্বাসী মানসিকতা দেখাটা খুবই তৃপ্তিদায়ক।

     

     

    যাই হোক, অপেক্ষাটা ১৬ বছরের ছিল। পাকিস্তানের সাথে ১৯৯৯ এর সেই জয়ের কারণেই আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিলাম। সেই একটা জয়ের উপর ভিত্তি করে। সেজন্যেই হয়তো ওই একটা জয় ১৬ বছরের দাম নিয়ে নিলো। শুধু ক্রিকেট নিয়ে বলি। ১৬ বছরের মধ্যে আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম। তিনটা ওয়ানডে বিশ্বকাপ পার হয়েছে। আমরা নিজেরাও ৩টা বিশ্বকাপ নিজেদের দেশে আয়োজন করেছি (২০০৪ অনুর্ধ্ব ১৯, ২০১১, ২০১৪ টি-টুয়েন্টি)। ক্রিকেটে টি-টুয়েন্টি নামে সম্পূর্ণ নতুন এক ফরম্যাটের ক্রিকেটের আবিষ্কার হয়েছে। ক্রিকেটের পুরো একটা প্রজন্ম পার হয়েছে। সেই সময়ে যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতো তাদের মধ্যে শুধুমাত্র, শুধুমাত্র শিবনারায়ণ চন্দরপল টেস্টে টিকে আছেন। আফ্রিদি টিকে আছে টি-টুয়েন্টিতে। আর সবাই অবসরে গেছেন। বাংলাদেশ পেয়েছে বিশ্বের এক নাম্বার অল রাউন্ডার। টেস্ট খেলুড়ে প্রত্যেকটা দলকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। আবিষ্কার করেছে ক্রিকেটে বাংলাওয়াশ শব্দের! মুলতান এসেছে, ২০০৩ এই রাওয়ালপিন্ডিও এসেছিলো, ২০১১ তে চট্টগ্রামে ফ্লাডলাইট জটিলতায় হারতে হয়েছিলো। ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালে কেঁদেছে পুরো দেশ, ২০১৪ এশিয়া কাপ দেখিয়েছে গ্যালারিতে পাঁচ তরুণীর কান্না। এতো কাছে তবু এতো দূর! অনেক অনেক জল গড়িয়েছে। হারানো যায়নি শুধু পাকিস্তানকে।

     

    অবশেষে অপেক্ষা ফুরলো। সুনীল পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় ছিলেন, তেত্রিশ বছরেও তার কথা কেউ রাখেনি। সাকিব এই সিরিজের শুরুতে বলেছিলেন ১৬ বছরের প্রতীক্ষা ফুরোবে। কথা রাখলেন সাকিব আল হাসান, কথা রাখলো বাংলাদেশ দল। ১৫ বছর ১০ মাস ১৭ দিন পরে, ঠিক ৫৮০০ দিন পরে বাংলাদেশ জিতলো পাকিস্তানের সাথে। এখন পরের ওয়ানডেতে জিতে সিরিজ জয়ের আশা।