ঝুলেই থাকল আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ভাগ্য
লা বোম্বোনেরায় সমর্থকদের গানের সুর তখন মিলিয়ে এসেছে। বিশ্বকাপ না খেলার দুঃস্বপ্নটা যে সত্যি হতে পারে সেটার বাস্তব রূপ যেন দেখে ফেলেছেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা। পিন পতন নীরবতা তখন স্টেডিয়াম জুড়ে। অথচ নেচে গেয়ে নিজেদের দলকে প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই সমর্থন দিয়ে গেছেন তারা। ম্যাচ শেষে তাদের চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। ঘরের মাঠে সমর্থকদের ‘ভালোবাসার’ প্রতিদানটা দিতে পারেনি আর্জেন্টিনা। পেরুর সাথে গোলশূন্য ড্র করে খাদের কিনারায় চলে গেছে তারা। সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা প্রায় নেই, প্লে-অফের জায়গাটাও নিয়েও আছে সংশয়। আজকের ম্যাচের পর বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের পয়েন্ট তালিকায় আর্জেন্টিনা নেমে গেছে ৬ নম্বরে।
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ভাগ্যটা ঝুলে থাকল অনেকগুলো ‘যদি’, ‘কিন্তুর’ উপর। শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরকে হারাতে পারলে সরাসরি বা প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে আর্জেন্টিনার সামনে। বিশ্বকাপে খেলার জন্য অন্য কারও উপর নির্ভর না করলেও, সমীকরণটা 'সহজই' আর্জেন্টিনার জন্য। শেষ ম্যাচে হারাতে হবে ইকুয়েডরকে। কিন্তু কাজটা ঠিক ততোটাই কঠিন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত ইকুয়েডরের রাজধানী কিটোতে গিয়ে খুব কম দলই ম্যাচ জিতে আসতে পারে!
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনাটা এখনও টিকে আছে আসলে প্যারাগুয়ের জন্য। কলম্বিয়াকে তারা ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে না দিলে সেই সম্ভাবনাটা আরও ফিকে হয়ে যেত আকাশি-সাদাদের। অন্য ম্যাচে ৮৬ মিনিটে অ্যালেক্সিস সানচেজের গোলে ম্যাচ জেতা চিলি পেরু আর্জেন্টিনাকে সরিয়ে উঠে গেছে তিন নম্বরে।
মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামেই সাধারণত ঘরের ম্যাচগুলো খেলে আর্জেন্টিনা। গ্যালারি থেকে মাঠের দূরত্ব বেশি হওয়ায় এবার সেখান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল বোকা জুনিয়র্সের মাঠে। দর্শকদের সমর্থনটা যে বড় দরকার ছিল আর্জেন্টিনার! কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরও একবার তাদের হতাশ করেই বাড়ি ফেরত পাঠিয়েছে লিওনেল মেসির দল।
অথচ শুরুটা অন্যরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছিল আর্জেন্টিনার জন্য। বল দখলের সাথে পাসিং ফুটবলটাও ভালোই খেলছিল আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধে হাতে গোণা কয়েকটি সুযোগ পেলেও, সেখান থেকে গোল করার সুযোগ ছিল। সত্যিকার গোলের প্রথম সুযোগটা পেয়েছিলেন মেসিই। কর্নার থেকে বল পেয়ে তার নেয়া শট জালের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু পেরুর ডিফেন্ডার ট্রাকোর গায়ে লেগে বল চলে যায় বাইরে দিয়ে। দারুণ কিছু ব্লক করে এই ডিফেন্ডারই আসলে বনে গেছেন ম্যাচের নায়ক। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আরও একবার মেসিকে গোলবঞ্চিত করেন ট্রাকোই। স্ট্রাইকার দারিও বেনেদেত্তোর নেয়া শট গোলরক্ষক ফিরিয়ে দিলে ফিরতি বলে শট করেছিলেন মেসি। শেষ মুহুর্তে ট্রাকোর পায়ে লেগে বারপোস্টে বাধা পায় সেই শট। সবরকম চেষ্টা করেও তাই মেসি থেকে গেছেন গোলশুন্যই, আর তার দলও তাই। নিজে গোল করার পাশাপাশি গোলের ভালো সুযোগও তৈরি করেছিলেন বার্সা ফরোয়ার্ড। কিন্তু সতীর্থদের ভুলে সেগুলো আর গোলে পরিণত হয়নি।
বিশেষ করে স্ট্রাইকার বেনেদেত্তো হতাশ করেছেন দলকে। প্রথমার্ধের শেষ দিকে তিনিই এনে দিতে পারতেন আর্জেন্টিনার কাঙ্ক্ষিত গোল। কিন্তু সহজ হেডও মেরেছেন বারপোস্টের উপর দিয়ে।
দ্বিতীয়ার্ধে হোর্হে সাম্পাওলির বেনেদেত্তোকে না বদলানোর সিদ্ধান্ত অবাক করেছে অনেককেই। চাপে থাকা অবস্থায় উলটো ডি মারিয়াকে বসিয়ে নতুন এক খেলোয়াড়ের অভিষেক করিয়ে দেন সাম্পাওলি। আরিয়েল রিগোনিকে বিরতির ঠিক পরপরই নামান আর্জেন্টাইন কোচ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুটা দারুণ হলেও সময়ের সাথেই খেই হারায় আর্জেন্টিনা। সাথে বাড়তে থাকে সমর্থকদের চাপও। ‘জীবন-মরণ’ লড়াইয়ে আরও বড় দুঃসংবাদ হয়ে আসে ফার্নান্দো গ্যাগোর ইনজুরির খবর। ৬১ মিনিটে মাঠে নামার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ইনজুরিতে পড়ে আবারও বদলি হতে হয় গ্যাগোকে। তার জায়গায় নামেন এনজো পেরেজ। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তাই শেষ পর্যন্ত নামতেই পারেননি পাউলো দিবালা।
৭০ মিনিটের পর আর্জেন্টিনা একরকম ম্যাচের হাল ছেড়েই দিয়েছিল। খেলোয়াড়দের শরীরীভঙ্গিই সেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। শেষদিকে মেসিও কয়েকটি শট নিয়েছিল, সবগুলোই পেরুর খেলয়াড়ের গায়ে লেগে ফেরত এসেছে। ম্যাচজুড়ে অসাধরণ খেলা পেরুর গোলরক্ষক পেদ্রো গালাসেও বেশ কয়েকবার গোলবঞ্চিত করেছেন আর্জেন্টিনাকে। সার্জিও রোমেরোকে পরীক্ষা দিতে হয় একেবারে শেষদিকে এসে। স্ট্রাইকার গুরেরোর দারুণ এক শট ঠেকিয়ে দিয়ে আর্জেন্টিনাকে আরও বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচান রোমেরো। এর আগে মেসি দুইবার ভালো জায়গায় ফ্রি কিক পেলেও কিছুই করতে পারেননি।
আরও একটি ড্র তাই হারের মতোই অনুভূতি যুগিয়েছে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মনে। ১৯৭০ সালের পর প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার শঙ্কাটা যারা এতোদিন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন, তাদেরও আর স্বস্তিতে থাকার কথা নয় এতোক্ষণে!