• ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ সিরিজ
  • " />

     

    সেই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়...

    সেই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়...    

    যে স্বর্ণালী সন্ধ্যার স্মৃতি রোমন্থন করব বলে আজকের এই আয়োজন, সেই সন্ধ্যা নিশ্চয় ঝুপ করে নামেনি বা টুপ করে পড়েনি কিংবা চুপটি করেও আসেনি। অভূতপূর্ব দৃশ্যপটের সব আনন্দের সাক্ষী যে সন্ধ্যা, তা নামার পূর্বে কিছু সাজসজ্জারও প্রয়োজন আছে বৈকি! সেজন্যেই বোধকরি চাপা উত্তেজনার রাত্রি, আশা-নিরাশার সকাল, দোলাচলের দুপুর আর অবাক উত্তেজনার এক বিকেল পেরিয়ে সেই সুন্দরতম সন্ধ্যার এই ধরাধামে আগমন।

    তারও আগে অধিনায়কের নিঃসংকোচ ও দুঃসাহসী উচ্চারণে বুঝি রচিত হয়েছিল তার ভিত্তিপ্রস্তর। “ম্যাচ তিনদিনে শেষ হয় হোক, আমার স্পিনিং উইকেট চাই” ঘোষণায় দলপতি যে কেবল প্রতিপক্ষের নয়, স্বদলেরও সংহার পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছিলেন, তা কি তাঁর জ্ঞানের চৌকাঠে ছিল না? তিনি কি জানতেন না, প্রস্তুতিহীন পরিকল্পনায় প্রতিপক্ষের জন্য খোঁড়া গর্তে, নিজেই চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকার সমূহ সম্ভাবনা থাকে? রণকৌশল আর প্রস্তুতিতে সমন্বয়হীনতার ফল কি হতে পারে, সেই জ্ঞানও নিশ্চয় তাঁর ছিল। তারপরও অমন সিদ্ধান্ত কেন? দুঃসাহসেরই বা কারণ কি?

    উত্তর একটাই, তিনি ঝুঁকি নিতে চেয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য বাঁক আর ঘূর্ণনের প্রতিউত্তর দেয়ার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও তিনি ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। নিজের দলের প্রতি বিশ্বাসই হয়তো তাঁকে ইন্ধন যুগিয়েছিল অমন সাহসের পরিচয় দিতে!

    চট্টগ্রামের টার্নিং উইকেটে, দারুণ রোমাঞ্চকর সোয়া বারো সেশন শেষে, বাংলাদেশ ললাটে পরাজয়ের তিলক এঁকে ফিরেছিল ঠিকই; তবে নব উদ্যমে লড়াইয়ের জ্বালানীটুকু সঞ্চয় করতে একদমই ভোলেনি যে! লড়াইয়ের সেই সঞ্চিত উৎসাহই ‘অফুরান’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে উপহার দিয়েছিল সুন্দরতম এক স্বর্ণালী সন্ধ্যা।

    সেই অনিন্দ্য সুন্দর সোনালী সন্ধ্যায় আরেকবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবো বলে, করতে হলো এতটা ভূমিকা!

    আশা-নিরাশার সকাল কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে তখন, দোলাচলের দুপুরে ম্যাচ দুলছে দোলকের মতো। ক্ষণে ক্ষণে ম্যাচের রঙ বদল, সংশয় আর উত্তেজনায় অস্থির করে তুলছে চিত্ত, মন ও মানসিকতা। হৃষ্টপুষ্ট লিডের স্বপ্ন ফিকে হওয়ায় মোটামুটি স্বাস্থ্যবান স্কোরেই যে আস্থা, স্বপ্ন ও আশা ছিল; সেটাও ভেঙে পড়া কাঁচের মতো চূর্ণ-বিচূর্ণ তো হয়েছেই, টুকরো কাঁচে যেন রক্তও ঝরছে। এ যন্ত্রণার বুঝি শেষ নেই!

    কুক-ডাকেট নামের দুই ইংলিশ উদ্বোধকই এত যন্ত্রণার কারণ।

    ঝাড়ু নিয়ে (পড়ুন সুইপে) তাঁরা যেভাবে বঙ্গ স্পিনারদের তাড়া করেছেন, তাতে শেষ বিকেলে কোনো নতুন শুরুর সম্ভাবনা যদি কেউ না দেখেন, তাঁকে অন্তত দোষ দেয়া যায় না! কিন্তু দেখা গেল, দোষ হয়ে গেছে সেটাই। শেষ বিকেলের শুরুটা যে কেবল নব সম্ভাবনার দ্বারই উন্মুক্ত করেনি, আদতে তা উন্মোচন করে দিয়েছিল ক্রিকেটের নান্দনিক রোমাঞ্চগাঁথা! ক্রিকেটের অনিশ্চিয়তার সৌন্দর্য্য ভুলে গিয়ে, ফলাফল জরিপ করে ফেলা কিছুটা দোষণীয় হলেও, সে দোষ অবশ্য সন্ধ্যার আঁধারে খুশীর চাদরে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল!

    যাক সেসব, আসুন আমরা ফিরি অবাক উত্তেজনার সেই বিকেলে।

    চা-টা পান করে যেন আড়মোড়া ভেঙে নব উদ্যমে খেলতে নেমেছিলেন বাংলাদেশী ক্রিকেটাররা। সেজন্য বোধহয় উইকেট না খুঁইয়ে শতরান হয়ে গেছে বলে একটু যে আয়েশ করবেন ডাকেট, তাঁকে আর সে সুযোগটুকুও দিলেন না মেহেদী মিরাজ। চা-পান বিরতির পর প্রথম বলেই বোল্ড ডাকেট। তখন কে জানতো, পড়ন্ত বেলায় দুরন্ত এক উচ্ছ্বাস অধ্যায়ের সূচনা হলো মাত্র!

    বঙ্গদেশীয় স্পিনারদের ঘূর্ণনের কোনো ব্যখ্যা বুঝি জানা নেই, ইংলিশ ভদ্রলোকদের। ঘূর্ণনে কেবল নাকালই হলেন না তাঁরা, চূড়ান্ত অপদস্থ হয়ে ফিরতে লাগলেন মাঠের লাগোয়া সাজঘরে। ডাকেট, রুট, ব্যালেন্স... যেন সারিবদ্ধভাবে শুরু হয়ে গেছে উইকেট-মিছিল। উচ্ছ্বসিত গ্যালারীকে একপাশে রেখে নত মস্তকে সাজঘরে ফিরছেন, ক্রিকেটের কূলীন বংশধরেরা। ক্রিকেটের অভিজাত আঙিনায় এ এক অভাবনীয় দৃশ্য বটে!  

    কুকের ক্যাচটা সিলিপয়েন্টে পড়িমরি করে বুকের সাথে যেভাবে জাপটে ধরলেন মুমিনুল, অনেক অনেক দিন পর দেখা হওয়া প্রিয়তমাকেও বুঝি মানুষ ওভাবে জাপটে ধরে না।        

    গ্যালারীর কান ফাটানো উল্লাসে হয়তো আরো বেশী ভীত হয়ে পড়েছিলেন একসময়ের ঔপনিবেশিকেরা। নইলে অমন অসহায় আত্মসমর্পণের ইতিহাস লিখতে অত আগ্রহী হবেন কেন? ব্যাটিংটাই বা হঠাৎ ওরকম ভুলে বসবেন কেন?

    সাকিবের বলে স্টোকস যেভাবে বোল্ড হলেন, সেখানটাতেই যেন পুরো ম্যাচের চিত্র ফুটে উঠে। নোয়ানো মস্তকের অসহায় অভিযাত্রীকে স্যালুটের বাহবা! নাকি অভিবাদন? কে জানে! উচ্ছ্বাসের নেশা দারুণ সংক্রামক। সাকিব থেকে স্টেডিয়াম হয়ে পুরো দেশে সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে তা। স্যালুট কিংবা অভিবাদন আর জয়োল্লাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

    গোধুলী বেলায় সূর্য ঢলে পড়ার অনেকটা আগে ইংলিশ ব্যাটিং লাইন আপ ঢলে পড়ে। তবে সূর্যটা পশ্চিমকাশে পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সাক্ষী হয়, মিরপুরের সোনালী বিকেলে মঞ্চস্থ হওয়া অভাবনীয় এক ইতিহাসের। কালের গর্ভে একটি দিনের সমাপ্তি ঘোষণার পূর্বে সূচিত করে দিয়ে যায় ক্রিকেট ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়। 

    সোনারঙা লগ্নে সূর্যটা যেন আরো বেশী করে সোনা ছড়ায় ইতিহাস রচয়িতাদের হাসি হাসি মুখগুলোয়। দন্ত বিকশিত হাসিতে ঠিকরে বেরোয় ক্রিকেট-কৌলিন্যের ধ্বজাধারীদের ভূপাতিত করার সাফল্য ও সার্থকতা। যদিও শ্বেত-মুখাবয়বের জমাট লালিমা কিছুটা হলেও সমব্যথী করে তোলে। তারপরও পরম তৃপ্তিদায়ক যে, দিনান্তের বাঁকে ওই দুঃখী শ্বেত মুখগুলোই সাক্ষ্য দেয়, এই সন্ধ্যাটা আর দশটা ‘সাধারণ’ সন্ধ্যার মতো নয়।

    সেদিনের সেই সন্ধ্যা সত্যিই ছিল অসাধারণ, সেই সন্ধ্যা ছিল এক অভূতপূর্ব সুন্দরের মঞ্চায়ন, সেই সন্ধ্যার সব কিছুই যেন ছিল সোনায় মোড়ানো, বলা যায় সোনালী রুপায়ন। ফিরে দেখলে এখনও তা-ই মনে হয়। হয় না?