• " />

     

    অবাক বসন্তের সেই স্বপ্ন!

    অবাক বসন্তের সেই স্বপ্ন!    

    ১৯৯৭ সালের বসন্ত। চট্টগ্রামের আমাদের বাড়িতে তখন হাঁটুসমান পানি। রঙিন পানি! মালয়েশিয়ার কিলাত কিলাব ক্লাব মাঠের ইতিহাস-গড়া সাফল্যের রঙ ছুঁয়ে গেল গোটা দেশকে। আমাদের বাড়ি যেন সেই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসছে প্রতিদিন, প্রতিরাতে! আকরাম খানের বাড়ি বলে কথা। বাংলাদেশকে নতুন এক স্বপ্নের ভোর এনে দেওয়া নায়কদের নেতা তিনি! উৎসবের রঙ যে বাড়তি ছোঁয়া পাবে সেখানে, তাতে আর আশ্চর্য কি! তখন কিন্তু এতো বুঝতাম না। তবে কেবল বুঝেছিলাম একটি বিষয়। আমাকেও ক্রিকেটার হতে হবে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার মতো ক্রিকেটার।

    স্বপ্নের ডালপালা গজালো তখনোই। সেই বসন্তে। ১৯৯৭ সালের অবাক এক বসন্তে।

    বাড়ির সামনের গলিতে তখন মেলতো রাজ্যের স্বপ্নডানা। বাড়ির পাশেই এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, সকাল বেলা গিয়ে সেরা পিচটা ঠিক করে স্ট্যাম্প রেখে আসতাম! রাতভর আশঙ্কা, যদি বৃষ্টি হয়! রাত দুই-তিনটা থেকেই আকাশের দিকে তাকাতাম, তারা দেখা যাচ্ছে কি-না। কেউ একজন বলেছিল, আকাশে তারা দেখা গেলে বৃষ্টি হয় না!

    সেই গলির ‘অ্যাশেজ’-এর দিন ফুরিয়ে এল। বয়সভিত্তিক দলও পেরিয়ে এলাম। তারপর হারারে। স্বপ্নপূরণের সেই দিন! ঠিক স্বপ্নের মতো হলো না যদিও। তবে স্বপ্নালু অভিষেক হলো বিশ্বকাপে। জাহির খান, মুনাফ প্যাটেলদের বিরুদ্ধে খেললাম ভয়ডর ছাড়াই। আমার মঞ্চ, পারফর্ম করবো না আমি? আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে। ক'দিন পরেই বারমুডার সঙ্গে ম্যাচ; ভাবলাম, সেরা বোলারদের পেরিয়ে এলাম, এরা আবার কে? ভুল ভাঙ্গল। সেলিম মুকাদ্দেমকে অন্ধের মতো মারতে গিয়ে আউট হলাম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাউকেই ছাড় দিয়ে কথা বলতে হয় না, শিক্ষাটা পেয়েছিলাম সেদিনই।

    কী, ভাবছেন ব্রায়ান ভিটোরিকে ‘অর্ডিনারি’ বলেছিলাম কেন তবে? সেবার আমরাই হেরেছিলাম, তবে নিজেদের ‘দোষে’। নিখাদ ব্যাটিং উইকেটে ভিটোরির মতো বোলারকে তো ‘অর্ডিনারি’ই মনে হয়েছিল! ইংলিশ কন্ডিশনে ব্রড-অ্যান্ডারসন, আর হারারেতে ব্রায়ান ভিটোরি, ‘অর্ডিনারি’ বলায় কি খুব ভুল করেছিলাম? নাহ, ভুল করেছিলাম মাঠে নেমে, হরহামেশাই তো করি। আমরা সবাই!

    ব্রড-অ্যান্ডারসন, তাই না? দেশের মাটিতে যখন এদের সাথে খেলি, কেপি বলছিলো, খুব তো খেলছো, এসো ইংলিশ কন্ডিশনে। আলাদা করে বলেছিল ওল্ড ট্রাফোর্ডের কথা। তখন জানতামও না, ওই সফরে ওল্ড ট্রাফোর্ডে টেস্ট আছে। জানতাম না, ওল্ড ট্রাফোর্ডে খেলা কেন কঠিন? পরে জেনেছি, ওল্ড ট্রাফোর্ড সবচেয়ে সুইঙ্গিং-ফাস্ট উইকেটগুলির একটি। আমি কথা বলতেই বসলেই ২০১০ চলে আসে, তাই না? আসবেই তো, ২০১০–এ আমিও নিজেকে যে নতুন করে চিনেছিলাম। শুধু ইংল্যান্ড নয়, দেশের মাটিতেও। লর্ডসের সেঞ্চুরিটা একপ্রকার জেদের বশেই করেছিলাম। ওল্ড ট্রাফোর্ডে যখন যাই, তখন ইংলিশরা আমার শক্তিমত্তা, দুর্বলতা জানে খুব ভাল করে। চ্যালেঞ্জ ছিল। উৎরে গেলাম। কিন্তু দল উৎরাতে পারলো না।

    এশিয়া কাপ এলো। রূপকথার এশিয়া কাপ। টাইফয়েড থেকে কেবল সেরে উঠেছি আমি, দলেও ছিলাম। অথচ বোর্ড টেবিলে বাদ পড়ে গেলাম! চাচ্চু পদত্যাগ করলেন, শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ লাগলো! আমি দলে এলাম। মানসিক দিক দিয়ে তখন কী বিপর্যস্ত অবস্থায় আমি! চারটা আঙ্গুল মনে আছে? গুনে গুনে যে দেখিয়েছিলাম! চারটা ফিফটি! আবারও উৎরে গেলাম আমি, কিন্তু ফাইনালটা হারলাম। কান্না মনে আছে সেদিনের? সাকিবকে জড়িয়ে ধরে মুশফিকের কান্না, বিজয়ের কান্না। কাঁদছিল নাসিরও। আমি তখনও ঠাউর করতে পারিনি, এত কাছে এসেও এতদূর বাকী থাকবে! কান্নার দমক আমাকেও ছুঁয়ে গেল কিনা, সেটি আর নাইবা বলি। তবে আমি জবাব দিতে পেরেছিলাম উপেক্ষার। আমার ‘সিএ’ ব্যাট দিয়ে।

    কিন্তু সেই যে চাচ্চুর পদত্যাগ। তারপর থেকে, খারাপ খেললেই রব উঠে যায়, আমি চাচার ‘কল্যাণে’ দলে আছি। তা তিনি নির্বাচক থাকুন বা নাই থাকুন! এর মাঝেও কি আমি খুব ‘জঘন্য’ খেলেছি! থাক, অত পরিসংখ্যান ঘেঁটে কী হবে বলেন! রেহাই পেলো না আমার পরিবার, রাত বিরাতে ফোন দিয়ে আমার নামে বাজে কথাও তো বললো কতজন!

    সাকিবের নামে অভিযোগ, সে বোর্ডের সঙ্গে ‘ঠিক আচরণ’ করে না। অভিযোগ তো একগাদা আমার নামেও! আমি কেন বিজনেস ক্লাসের টিকেট না পেয়ে ভিসা ছিঁড়লাম, কেন আশরাফুল ভাইয়ের সঙ্গে ‘বাজে ব্যবহার’ করলাম। বিপিএলে ডিন জোন্সের সঙ্গে লেগে গেলেও আমারই দোষ! তবে সবকিছুর ওপরে আমার খেলা। কেন আমি স্লো খেললাম, কেন ফাস্ট খেললাম! কেন নেটে পারি, মাঠে পারি না! কেন আমার আউট হওয়ার পরে নুডুলস সেদ্ধ হয়! মাঝে মাঝে মনে হতো কি জানেন, কেন তবে ক্রিকেটে খেলি? পারি না কি আসলেই? কেন হচ্ছে না প্রত্যাশাপূরণ?

    তবে জানতাম, খারাপ সময় বেশিদিন টেকে না। স্বরূপে ফিরব। আজ অথবা কাল।

    ফিরে কি এসেছি? উৎরে কি গিয়েছি দলকে সঙ্গে নিয়ে? প্রশ্নের জবাব দেবেন আপনারা।

    নামের পাশে এখন আমার কতো কতো রেকর্ড। তবে আমি সন্তুষ্ট নই। আমি এখনও স্বপ্ন দেখি বিশ্বসেরা হওয়ার। আমি স্বপ্ন দেখি, দুই ওভারে ৬০ রান দরকার, আমি বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছি! জানি, এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আবার বাজে সময় আসবে। আবার আমাকে নিয়ে বলা হবে অনেক কিছু। ফুরিয়ে যাওয়ার গান শোনাবেন কতজন! তবে সেই সময়েও আত্মবিশ্বাস যোগাবে পাকিস্তানের সঙ্গে এই ওয়ানডে সিরিজ, খুলনা টেস্ট। ঠিক যেমন এতদিন জুগিয়েছিল সেই ইংলিশ গ্রীষ্ম!

    আর হ্যাঁ, আমার স্বপ্ন-পূরণের দিনগুলি বাবা নিশ্চয়ই দেখেন ওপার থেকে। আমার যত স্বপ্ন, তাঁকে ঘিরেই তো! তাঁর ছেলের নামে কোরাস গাইছে গোটা দেশ, তাঁর ছেলের ব্যাটে ভর করে স্বপ্ন দেখছে কতজন! তাঁর স্বপ্ন তো এমনই ছিল!

    ক্রিকেটই যে আমার অনেক বড় এক স্বপ্নের নাম। লর্ডস, ওল্ড ট্রাফোর্ড, মিরপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা যে স্বপ্নপূরণের রঙ্গমঞ্চ হয়ে আসে। হয়তো কখনো নিয়মিতই, হয়তো একটু বিলম্বে। তবে ১৯৯৭ সালের সেই অবাক বসন্তের স্বপ্নটা আমি এখনও লালন করি। করে যাবো, ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত।

    আমি, তামিম ইকবাল খান।

    এটি আমার গল্পের শুরুও নয়, নয় শেষও!

    [পুনশ্চঃ না, তামিম ইকবাল খান 'প্যাভিলিয়ন'-এ লিখছেন না। তাঁকে কল্পনায় বসিয়ে লেখা হয়েছে ওপরের লেখাটি। যদি তামিম লিখতেন, তবে কি বলতেন এমন কিছুই?!]