কোপা কাহিনি ৪: শুরু হলো আসল কোপা
আরো পড়ুনঃ
‘দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ’ যুগ থেকে প্রবেশ করতে যাচ্ছি ‘কোপা আমেরিকা’ যুগে। ১৯৬৭ সালের পরে কোপা আমেরিকা বন্ধ থাকে প্রায় ৮ বছর। ১৯৭৫ সালে আবার তা শুরু হলো কোন নির্দিষ্ট ভেন্যু ছাড়াই। বর্তমান সময়ের চ্যাম্পিয়ন্স লীগ অথবা ইউরোপা লীগ যেমন হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা হয় কনমেবলের খামখেয়ালীতে ঠিক সেভাবে আয়োজন করা হল পরপর ৩টি কোপা আমেরিকা। হাস্যকর সিদ্ধান্ত ছিল সন্দেহ নেই।
১৯৭৫ সালের কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন দলের নাম পেরু। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই টুর্নামেন্টে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তোলে তারা। এই টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করলো সব দেশ। উরুগুয়ে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তাঁদেরকে সরাসরি সেমিফাইনালে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হল। আর বাকি ৯ দলকে মোট ৩ গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হল হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলার জন্য। সেমিফাইনালের লাইনআপ দাঁড়ায় এরকমঃ উরুগুয়ে এবং বাকি ৩ গ্রুপের ৩ শীর্ষ দল। সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় উরুগুয়ে-কলম্বিয়া এবং ব্রাজিল-পেরু। সেমিফাইনালে কলম্বিয়া উরুগুয়েকে এবং পেরু ব্রাজিলকে হারিয়ে ফাইনালে চলে গেলো। ফাইনাল হল মোট ৩টি। প্রথম ২টিতে পেরু এবং কলম্বিয়া একবার করে জয়লাভ করায় শেষ ম্যাচটি হয়ে আক্ষরিক অর্থেই ফাইনাল হয়ে দাঁড়ায়। সেই ম্যাচে পেরু ১-০ গোলে কলম্বিয়াকে হারিয়ে দেয়। দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন কুবিলাস নামের একজন পেরুভিয়ান।
১৯৭৯ সালের কোপা ছিল ‘নো ফিক্সড ভেন্যু’র দ্বিতীয় আসর। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ থেকেই একটা কথা শোনা যাচ্ছিলো যে নিজের দেশে অন্যায়ভাবে সুবিধা নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা। সেদিক দিয়ে এ আসর ছিল এ সমালোচনাকে ভুল প্রমাণের মঞ্চ। কিন্তু হয় উল্টোটা। প্রত্যাশার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যায় তারা। তিন দলের গ্রুপে ৩য় হয়ে কোপা থেকে যখন বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা, বিশ্বকাপে হওয়া সমালোচনাটা কানে বড় বেশি বাজছে তখন। অন্যদিকে ব্রাজিলের সোনালী প্রজন্মের আগমন ঘটেছে ততদিনে। জিকো, সক্রেটিস, টিটা খেলছেন একসাথে। তাঁদের মাধ্যমে ৩০ বছর পরে আবার কোপা জয়ের স্বপ্ন দেখছিলো ব্রাজিল। কিন্তু সেমিতে ব্রাজিল এবং ফাইনালে চিলিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় প্যারাগুয়ে। সেরা খেলোয়াড় হন তুলির শেষ আঁচড় দিতে না পারা চিলির কার্লোস কাসজেলি।
১৯৮৩ সালের কোপা আয়োজন করে কনমেবল উপলব্ধি করে, “যথেষ্ট হয়েছে। এবারই শেষ।” এ আসরই ছিল নো ফিক্সড ভেন্যু’র শেষ আসর। ব্রাজিলের সোনালী প্রজন্মের জন্য এটাই ছিল শেষ সুযোগ। কিন্তু এবারো ব্যর্থ হয় তাঁরা। এবার তাঁদের ঘাতকের নাম উরুগুয়ে। ১৬ বছর পরে দলকে চ্যাম্পিয়ন করে সেরা খেলোয়াড় হন উরুগুয়ের এনজো ফ্রান্সেসকোলি।
এনজো ফ্রান্সেসকোলি’র খেলা দেখে ফুটবলার জিনেদিন জিদান এতোই মুগ্ধ ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি তাঁর এক সন্তানের নাম রাখেন এনজো। এনজো জিদান।
১৯৮৭ সালকে কোপা আমেরিকার দ্বিতীয় জন্মের বছর বলা যেতেই পারে। কারণ এবারই কোপা আবার নির্দিষ্ট ভেন্যুতে ফিরে আসে। মজার ব্যাপার হল, ১৯১৬ সালে যখন কোপা আমেরিকা শুরু হয় তখনো স্বাগতিক দেশের নাম ছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৮৭ সালের নতুন কোপাতেও তাই। এ আসরের আগে থেকেই বেশ কিছু সমীকরণ কাজ করছিলো। দীর্ঘ ২৮ বছর শিরোপাখরায় ভুগছিলো আর্জেন্টিনা। তারপরে মাত্র গত বছর এক ‘পায়ে’ মেক্সিকো থেকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে আনেন আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা। সাথে নিজেদের মাটিতে আয়োজিত টুর্নামেন্ট। সবকিছু মিলিয়ে আর্জেন্টাইনরা আশায় বুক বেঁধেছিলো। কিন্তু আর্জেন্টাইনদের হতাশ করে ১৩তম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। আর্জেন্টিনা রানার্সআপ তো পরের কথা, ৪র্থ স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়। নিজের দলকে তৃতীয় করে সেরা খেলোয়াড় হন এক ঝাঁকড়া চুলের কলম্বিয়ান। নাম কি বলুন তো? হ্যাঁ, কার্লোস ভালদেরামা।
১৯৮৯ সাল। ব্রাজিলিয়ানদের ৪০ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটার বছর। বেবেতো নামের এক গোলমেশিন এবং রোমারিও নামের এক ক্ষ্যাপা জাদুকরের যুগলবন্দীতে দীর্ঘ ৪০ বছর পরে কোপার শিরোপা ঘরে তুললো ব্রাজিল। এই সেই বেবেতো, যিনি ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে গোল করে বাচ্চা হাতে নিয়ে দুলানোর ভঙ্গিতে উদযাপন করেন। ৬ গোল করে তিনি কোপার এই আসরের টপ স্কোরার হন। আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে হয় রানার্সআপ। দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন উরুগুয়ের রুবেন সোসা।
১৯৫৯ সালের পরে আর্জেন্টিনার আর কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতা হয়ে ওঠেনি। ১৯৯১ সালে চিলিতে এসে সেই আক্ষেপ ঘুচলো। বিস্ময়করভাবে সেবার আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে ছিলেন না ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তাঁর বিখ্যাত ‘১০’ নাম্বার জার্সিটি পান বর্তমান অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ কোচ ডিয়েগো সিমিওনে। কিন্তু ম্যারাডোনার অভাব একেবারেই বুঝতে দেননি ‘বাতিগোল’ হিসেবে খ্যাত গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। তাঁর সাথে প্রতিপক্ষকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার নেশায় মেতে ওঠেন ক্লদিও ক্যানিজিয়া নামের সোনালী চুলের এক তরুণ। দলে আরও ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় লিওনার্দো রড্রিগুয়েজ। সবকিছু মিলিয়ে ‘কমপ্লিট প্যাকেজে’ সেবার কোপাতে নিজেদের ১৩তম শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে টপ স্কোরার হন বাতিগোল। সাবেক চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল হয় রানার্সআপ।
১৯৯৩ সালের কোপা অনুষ্ঠিত হয় ইকুয়েডরে। এই আসরেই নিজেদের ১৪তম এবং এখন পর্যন্ত শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। এবারই প্রথম কনমেবলের বাইরের দুটি দেশ মেক্সিকো এবং আমেরিকাকে কোপা খেলতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবং প্রথমবারেই বাজিমাত করে মেক্সিকো। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা হয় তারা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে সার্জিও গয়কোচিয়া নামে এক আর্জেন্টাইন গোলকিপারের কথা হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। প্রত্যেকবার পেনাল্টি সেভ করতে দাঁড়ানোর আগে বারপোস্টের পাশে মূত্রত্যাগ করে নিতেন তিনি। তাঁর ধারণা ছিল এটা তাঁর জন্য শুভ লক্ষণ। সেই গয়কোচিয়াই ব্রাজিল এবং কলম্বিয়ার সাথে টাইব্রেকারের শট ঠেকিয়ে হয়ে যান এ টুর্নামেন্টেরই সেরা খেলোয়াড়।
এরপরের আসরগুলোতে ব্রাজিল কোপা জিতেছে ৪ বার, উরুগুয়ে জিতেছে ২ বার। এমনকি কলম্বিয়াও জিতেছে ১ বার।
সে গল্প নিয়ে আসছি পরের পর্বে।
আরো পড়ুনঃ