• দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ
  • " />

     

    হঠাৎ পাওয়া অধিনায়কত্ব

    হঠাৎ পাওয়া অধিনায়কত্ব    

    এক নিমিষেই বদলে যায় জীবনের গতিপথ। সে পথে অনেকেই হেঁটে যান ইতিহাসের দিকে, আবার অনেকেই বিপদের বন্ধুর কাজটা সেরে হারিয়ে যান স্মৃতির গহবরে। ক্রিকেটেও তেমন। যেমন সদ্যই ঘটে গেল অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষক টিম পেইনের ক্ষেত্রে। এক বছর আগেও তার নামটা অনেকেই ভুলতে বসেছিলেন, নিজেও ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলেন প্রায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আশা ছেড়ে ক্রিকেট-সামগ্রী উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান কুকাবুরায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল তার। হুট করেই ডাক পেলেন অ্যাশেজের টেস্ট দলে, প্রায় বছর সাতেক পর! ২০১০ সালে অভিষেক, সে বছরই খেলেছিলেন চারটি টেস্ট। এরপরই হারিয়ে গিয়েছিলেন।  

    সেই টিম পেইনই কিনা হয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার ৪৬তম টেস্ট অধিনায়ক! বল-টেম্পারিং কান্ডে প্রথমে কেপটাউন টেস্টে খন্ডকালীন দায়িত্ব পেয়েছিলেন, এরপর ১২ মাস নিষিদ্ধ স্টিভ স্মিথের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তিনিই।

    তার আগেও যুগে যুগে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনেকের হাতেই গেছে টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্ব, হুট করেই, যেসব সিদ্ধান্ত এসছিল বিস্ময় হয়ে। সাফল্য-ব্যর্থতার মিশেল আছে সেসব গল্পে, পেইনের আগে এমন হঠাৎ দায়িত্ব পাওয়া পাঁচ অধিনায়কের গল্প...
     
    মিসবাহ উল হক, পাকিস্তান
    অধিনায়ক হওয়ার পূর্বে অভিজ্ঞতা – ১৯ টেস্ট

    মিসবাহ উল হকের ক্যারিয়ারটাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পূর্ব এবং বিশ্বকাপ পরবর্তী। টেস্ট অভিষেকটা ২০০২ সালে হলেও কখনোই নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। ৮ বছরে তাই সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ১৯টি টেস্টে। তবে ২০০৭ সালে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের প্রথম বিশ্বকাপ মোড় ঘুরিয়ে দিল তার ক্যারিয়ারের। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে সেই বিখ্যাত 'ডেথ-স্কুপ' খেলতে গিয়ে মুহুর্তেই নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। তবে ক্যারিয়ারের ডুবন্ত পালে নতুন হাওয়া লেগেছিল সে আসরেই। মূলত তার ব্যাটে চড়েই ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তান। ফাইনাল জেতাতে ব্যর্থ হলেও ফিরে পেয়েছিলেন আস্থা। ফলশ্রুতিতে জায়গা ফিরে পান ওয়ানডে দলেও। তবে আবারও টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখা হয়ত ছেড়েই দিয়েছিলেন। এমনকি ২০১০ সালে তিন ফরম্যাট থেকে অবসরের চিন্তাভাবনাও করছিলেন। এরপরই পাকিস্তান ক্রিকেটে ঘটে গেল কুখ্যাত স্পট-ফিক্সিং কেলেংকারি। মূল হোতা অধিনায়ক সালমান বাট নিষিদ্ধ হলেন, সঙ্গে দুই কারিগর মোহাম্মদ আসিফ এবং তরুণ মোহাম্মদ আমিরও। মাঠে ও মাঠের বাইরে টালমাটাল পাকিস্তান দলে তখন চলছিল তীব্র নেতৃত্ব সংকট। টেস্টে অবসর ভেঙে ফিরে আসা অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি আবারও টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দেন, তার জায়গাতেই অধিনায়ক করা হয়েছিল সালমান বাটকে। সদ্যই অধিনায়কত্ব হারানো মোহাম্মদ ইউসুফ ব্যাটসম্যান হিসেবে ঠিক যতটা অসাধারণ ছিলেন, অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন ততটাই সাধারণ। আর ২০০৯  টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানো আরেক সাবেক অধিনায়ক ইউনুস খানের সাথে বোর্ড চেয়ারম্যান ইজাজ বাটের দ্বন্দ্ব তখন চরমে। তখনই ভাগ্যের সিকেটা ছিঁড়ে যায় মিসবাহ উল হকের। টেস্ট দলে ফের ডাক পান, সাথে পান অধিনায়কত্বও। এমনকি তখন নির্বাচকরাও বোর্ডের এই সিদ্ধান্তের ‘পক্ষে’ ছিলেন না! সে দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই সামলেছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে ৪৩ বছর বয়সে যখন টেস্ট থেকে অবসর নেন, ততদিনে পাকিস্তানের ইতিহাসের সফলতম টেস্ট অধিনায়কদের তালিকায় তার নামটা ছিল শীর্ষে।

     

    ফ্লয়েড রেইফার, ওয়েস্ট ইন্ডিজ
    অধিনায়ক হওয়ার পূর্বে অভিজ্ঞতা – ৪ টেস্ট

    অভিষেকটা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে শ্রীলংকা সফরে। দুইটি টেস্ট ও একটি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ব্যস, ওখানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে রেইফারের প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি। ধীরে ধীরে চলে যান দৃষ্টিসীমার বাইরে। ২০০৪ সালে পাড়ি জমান স্কটল্যান্ডে। সেখানে ঘরোয়া আসরে খেলেন বছর তিনেক। ২০০৭ সালে হুট করেই ঘোষনা দেন, তিনি এখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলার জন্য প্রস্তুত। এরপর কেটে যায় দুইটি বছর। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ দলের ক্যারিবিয়ান সফরের প্রাক্কালে বোর্ডের সাথে তারকা খেলোয়াড়দের মাঝে চলছিল চুক্তি সংক্রান্ত বিরোধ। তারই প্রেক্ষিতে প্রথম টেস্টের ঠিক আগেরদিন নির্বাচিত স্কোয়াড না খেলার ঘোষণা দেয়। বোর্ডও নাছোড়বান্দা, তারাও অনড় রইলেন নিজেদের সিদ্ধান্তে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একেবারে শেষ মুহূর্তে হারিয়ে যেতে বসা ফ্লয়েড রেইফারকে দলে ডেকে পাঠানো হয় অধিনায়ক হিসেবে। যদিও তার অধিনায়কত্বের অধ্যায়টা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দল থেকে বাদ পরে যান ওই বছরই। তার আগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুইটি টেস্ট, ছয়টি ওয়ানডে এবং একটি টি-টোয়েন্টিতে।

     

     

    ড্যারেন স্যামি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ
    অধিনায়ক হওয়ার পূর্বে অভিজ্ঞতা – ৮ টেস্ট

    সেন্ট লুসিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তিনি। টেস্টে শুরুটাও ছিল ভীষণ আশা জাগানিয়া। ২০০৭ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে অভিষেক টেস্টেই নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। পরবর্তী দুইবছর সেভাবে আর সুযোগ পাননি। ২০০৯ সালে ফ্লয়েড রেইফারের থেকে নেওয়া অধিনায়কের দায়িত্ব বর্তায় স্যামির কাঁধে। তখনও খেলোয়াড়দের সাথে বোর্ডের ঝামেলার সুরাহা হয়নি। অনভিজ্ঞ ও তরুণ একটি দল নিয়ে অধিনায়ক স্যামির যাত্রা শুরু হয়। দুই বছরে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথম জয় এনে দিলেও সামগ্রিক ফলাফল ছিলনা তেমন আশাব্যঞ্জক। সাথে ছিল বিদেশের মাটিতে ধারাবাহিক ব্যর্থতা। ওদিকে ব্যাট ও বল হাতেও কমে আসছিলো ধার।  ২০১৪ সালে স্যামিকে সরিয়ে দীনেশ রামদিনকে নতুন অধিনায়ক করা হয়।

     

    গ্রায়েম স্মিথ, দক্ষিণ আফ্রিকা
    অধিনায়ক হওয়ার পূর্বে অভিজ্ঞতা – ৮ টেস্ট

    মাত্র ২২ বছর বয়সে গ্রায়েম স্মিথের টেস্ট অধিনায়ক হওয়ার গল্পটা বেশ চমদপ্রদক। ২০০০ সালে হ্যান্সি ক্রনিয়ের ফিক্সিং কেলেংকারির পর নতুন অধিনায়ক হন শন পোলক। খুব একটা খারাপ করছিলেন না। তবে ঘরের মাটিতে ২০০৩ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার জেরে হারান দায়িত্ব। জ্যাক ক্যালিস, মার্ক বাউচারসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় থাকা সত্বেও নতুন অধিনায়ক নির্বাচিত হন গ্রায়েম স্মিথ। প্রশ্ন উঠেছিলো তার নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়েই। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেসব আশঙ্কা এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। দক্ষিন আফ্রিকা দলটার শরীরি ভাষাটাই বদলে দিয়েছিলেন স্মিথ। ব্যাটসম্যান স্মিথও ছিলেন দারুণ সফল। অধিনায়ক হওয়ার তৃতীয় এবং চতুর্থ টেস্টেই করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। তার নেতৃত্বেই ২০০৮-০৯ সফরে প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় প্রোটিয়ারা। ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই চলে যান অবসরে। তার আগে ১০৯টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেন, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। জয় পান রেকর্ড ৫৩টি টেস্টে। তবে অধিনায়ক স্মিথের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল দক্ষিন আফ্রিকাকে টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে তোলা। 

     

     

    লি জারমন, নিউজিল্যান্ড
    অধিনায়ক হওয়ার পূর্বে অভিজ্ঞতা – শুন্য টেস্ট

    লি জারমন তখনো টেস্ট অভিষেকের অপেক্ষায়। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের দক্ষিন আফ্রিকা সফরে ঘটে যায় বিতর্কিত এক ঘটনা। স্থানীয় এক অনুষ্ঠানে তিনজন তরুণ খেলোয়াড় মারিজুয়ানা গ্রহনের কথা স্বীকার করেন। এই ঘটনা এবং সেই সফরে দলের সামগ্রিক বাজে ফলাফলের ভিত্তিতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে ম্যানেজমেন্টে। নব-নিযুক্ত কোচ গ্লেন টার্নার অধিনায়ক হিসেবে এমন কাউকে চাচ্ছিলেন, যিনি দলকে মাঠে ও মাঠের বাইরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবেন। পাশাপাশি সতীর্থদের সম্মান আদায় করে নিবেন নিজ গুণাবলীতে। তখনই বিবেচনায় চলে আসেন জারমন, যার মাঝে ছিল অধিনায়কত্বের সহজাত ছাপ। ১৯৯৫ সালে নিজের অভিষেক টেস্টে যাত্রা শুরু হয় অধিনায়ক জারমনেরও। পরবর্তীতে ১২টি টেস্ট খেলেছিলেন, অধিনায়ক হিসেবেই। জয় পেয়েছিলেন একটিতে।

     

    মনসুর আলী খান পতৌদি, ভারত
    অধিনায়ক হওয়ার পূর্বে অভিজ্ঞতা – ৩ টেস্ট

    ১৯৬২ সাল। ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। সিরিজের মাঝপথে মারত্মক চোটের কবলে পড়লেন অধিনায়ক নারি কনট্রাক্টর, যে চোট শেষ করে দিয়েছিল তার ক্যারিয়ারই। তারই জায়গায় মাত্র তিন টেস্ট খেলা ২১ বছরের তরুণ মনসুর আলী খান পতৌদিকে নতুন অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তার মাসখানেক আগেই এক দুর্ঘটনায় পতৌদি ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান অনেকটাই। তার অধীনেই সেসময় টেস্টে ভারতের উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছিল। ৪০ টেস্টে ৯টি জয় এনে দেওয়ার পাশাপাশি তার বড় অর্জন ছিল নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দেয়া। তবে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে পতৌদি নিজের ছাপ রেখেছিলেন অন্য জায়গায়। তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক, যিনি দলের মাঝে 'আমরাও পারি' – এই বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ অধিনায়ক বনে যাওয়া পতৌদি তাই আজও ক্রিকেটের ‘ওয়ান-আইড টাইগার’, ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক! 
     

    ইএসপিএনক্রিকইনফো অবলম্বনে