রোম রূপকথায় বার্সার বিদায়
‘মিশন ইম্পসিবল’- রোমার চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ নিয়ে ইতালিয়ান এক পত্রিকা আজ ছেপেছিল এই শিরোনাম। প্রথম লেগে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৪-১ গোলে হারের পর সেমিফাইনালে উঠতে ‘অসম্ভব’ কিছুই করতে হত রোমাকে। ৮২ মিনিটে যখন কস্তাস মানোলাসের হেড জালে জড়াল তখন তার সঙ্গে উৎসবে যোগ দিয়েছেন ডাগআউটের সবাই। রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের গর্জনে নিজের কথাই নিজে শোনা দায়! আর বার্সেলোনার ডাগআউটে তখন রাজ্যের নীরবতা, তিন গোলে এগিয়ে থাকা টাইয়েও হেরে যাচ্ছে তারা। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৪ এ সমতায় থাকা ম্যাচটা তখন বার্সার জন্যই ‘মিশন ইম্পসিবল’। বাকি সময়ে নিজেদের বিদায়ের ক্ষণ গোণা ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি বার্সার। রোমার রূপকথার গল্পে বার্সেলোনার চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেছে অ্যাওয়ে গোলে পিছিয়ে থেকে।
ম্যাচের আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন ইউসেবিও ডি ফ্রানসেস্কো বলেছিলেন, "আমাদের সামনে অবিস্মরণীয় কিছু করার সুযোগ আছে আগামীকাল। নিজেদের সর্বোচ্চটাই দিব আমরা।" তখন কে-ই বা ভেবেছিল রোমা কোচের কথা ফলে যাবে এভাবে। প্রথম লেগের পরই ফলটা অন্যায্য দাবি করেছিলেন তিনি। সেটা কেন করেছিলেন, আজ বুঝিয়ে দিলেন মাঠে। স্তাদিও অলিম্পিকোতে ৬ মিনিটেই যখন এডিন জেকো গোল করলেন তখন 'মরা ম্যাচটাই' পেল প্রাণের সঞ্চার। রোমা সমর্থেকেরা হয়ত মাঠে এসেছিলেন ইতিহাস দেখতে, কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন কয়জন? তাদের আশার পালে শুরুতেই হাওয়া দিয়ে রোমাকে এগিয়ে দিলেন জেকো। তখনও রোমা পিছিয়ে দুই গোলে, তখন থেকেই সমর্থকদের সঙ্গে নিয়েই লড়ে গেল রোমা। আর চাপে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলল বার্সা। লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাদের মাঝের স্বভাবসুলভ বোঝাপড়ার দেখা মিলল না একেবারেই। মেসি-সুয়ারেজদের প্রথমার্ধের গল্পটা চলল পরের অর্ধেও। প্রথমার্ধে দুইবার ফ্রিকিক পেয়েছিলেন মেসি, একবারও অন টার্গেটেই শুট করতে পারেননি। সুয়ারেজ, ইনিয়েস্তারাও নিজেদের ছায়া হয়েই ছিলেন। এই সুযোগে বার্সার রক্ষণভাগকে রীতিমত কাঁপিয়ে দিলেন জেকো-শিকরা। ৩০ মিনিটে ডিফেন্ডার ফ্রেডেরিকো ফাজিওর ক্রসে প্যাট্রিক শিকের হেড গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে গেলে অল্পের জন্য সে যাত্রায় বেঁচে যায় বার্সা। গোল আর মাঠের খেলায় এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় রোমা। কিন্তু তখনও তাদের পাড়ি দিতে হবে বহুদূরের পথ!
দ্বিতীয়ার্ধে আরও উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নামল রোমা। আর বার্সার খেলার ধরন দেখে মনে হলো, কোনোমতে ম্যাচটা শেষ হলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে তারা। রোমার রক্ষণ দুর্গ গলে বের হতে পারলেন না মেসি-সুয়ারেজদের কেউই। আর রোমার আক্রমণের চাপে বার্সার রক্ষণের তখন দম ফেলার সময় নেই। দুই পাশ থেকে আসা ক্রসে জেকোকে আটকাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন সেমেদো, জর্দি আলবারা। ৫৬ মিনিটে সেই জেকোই বল নিয়ে ঢুকে গিয়েছিলেন গোলের একেবারে সামনে। ফাউল না করলে, বলটা হয়ত জালেই পুরতেন জেকো। উপায় না দেখে সেটাই করলেন জেরার্ড পিকে। রেফারিও দিলেন পেনাল্টির সিদ্ধান্ত। ন্যু ক্যাম্পের প্রথম লেগে আত্মঘাতী গোল দিয়ে বার্সাকে প্রথমে এগিয়ে দিয়েছিলেন ড্যানিয়েলে ডি রসি। তিনি নিতে এলেন পেনাল্টি কিক। শাপমোচন করে তিনিই পথ দেখিয়ে দিলেন রোমাকে। ভিআইপি গ্যালারিতে বসা ফ্রানসেস্কো টট্টি আগেই জানতেন, দায়িত্ব সঠিক ব্যক্তির কাঁধেই দিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেটা আজ আরও একবার জানলেন। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে ইতিহাস গড়ার রাস্তাটা তখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল রোমা।
৭৩ মিনিটেই বহুল প্রতীক্ষিত সেই তৃতীয় গোলটাও প্রায় পেয়েই যাচ্ছিল রোমা। ডানপ্রান্ত থেকে আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জির ক্রসে বদলি স্ট্রাইকার স্টেফান এল-শারাউইর শট গোললাইন থেকে দারুনভাবে ফিরিয়ে দিয়ে রোমাকে জন্য আটকে দেন মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান। ডিফেন্ডারদের সাহায্য না পেয়ে আজ তিনিই হতে পারতেন বার্সার সেমিতে ওঠার নায়ক। কস্তাস মানোলাসের ওই হেড তার জালে ঢোকার আগে ঠিক পথে এগুচ্ছিলেন তিনিও।
কিন্তু তখনও একজনের শাপমোচন বাকি! আগের ম্যাচে তিনিও করেছিলেন আত্মঘাতী গোল। থ্রি মেন ডিফেন্সে এতোক্ষণ নিজের কাজটা ভালোভাবে সামলেছেন, দলের প্রয়োজন একটা গোল। ৮৩ মিনিটে কর্নার পেয়ে উঠে গেলেন ওপরে, বার্সার ডিবক্সের ভেতর। চেঙ্গিস আন্ডারের করা কর্নার থেকে করলেন দারুণ এক হেড। তাকে মার্ক করার দায়িত্বে থাকা নেলসন সেমেদো বল জালে ঢোকার আগেই মুখ ঢাকলেন হতাশায়। আর পেছন ফেরে গোল নিশ্চিত হওয়ার পর মানোলাস মাঠ পেরিয়ে চলে গেলেন অ্যাথলেটিক ট্রাকের ওপর। ক্যামেরার ক্লোজ শটে দেখা গেল খালি তার মুখটাই, দুই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন উন্মাদ হয়ে যাওয়া গ্যালারির সমর্থকদের দিকে। যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না নিজেকে!
ম্যাচের বাকি সময় প্রাণপণে চেষ্টা করলেও সমতায় ফিরতে পারেনি বার্সা। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে বদলি খেলোয়াড় উসমান ডেম্বেলের শট রোমা গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে গেলে রূপকথার মত এক জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে রোমা। ম্যাচ শেষে মেসির মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়া বা ডি রসিকে জড়িয়ে ফ্লোরেঞ্জির আবেগাপ্লুত উদযাপন- এই খণ্ডচিত্র গুলোই হয়ে থাকল ম্যাচের প্রতিচ্ছবি। আর রোমাঞ্চকর রাতে রোমা লিখল চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথমবারের মতো সেমিতে ওঠার রূপকথা।
তিন গোলে এগিয়ে থেকে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হেরে বিদায় নিল বার্সা। আর চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে তিন গোল বা এর চেয়ে বেশি পিছিয়ে থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়ার রেকর্ড আগে ছিল মাত্র দুইবার। ২০০৩-০৪ মৌসুমে এসি মিলানের দেপোর্তিভোকে হারিয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়া, আর গতবার বার্সার পিএসজিকে হারিয়ে কোয়ার্টারে ওঠা। আজ রোমা লিখল নতুন ইতিহাস, সেই বার্সাকে হারিয়েই। বার্সার রেমেন্টোডার বার্সাকেই ফিরিয়ে দিল রোমা। নতুন একটা নামও দিয়ে দিতে পারেন চাইলে। রোমান্টাডা?