মাদ্রিদে নাটকের পর সেমিফাইনালে রিয়াল
প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদের তিন গোলের লিড ততোক্ষণে শোধ দিয়ে দিয়েছে জুভেন্টাস। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তাই খেলা গড়াচ্ছে অতিরিক্ত সময়ের দিকে। শেষদিকে খেলার অবস্থা মনে করিয়ে দিচ্ছে গোল্ডেন গোলের যুগটা। ইনজুরি টাইমেও রিয়ালের আক্রমণকে ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছে জুভেন্টাস। ৯৩ মিনিটে উড়ে আসা বলে ডিবক্সের ভেতর থেকে হেড করলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লক্ষ্য লুকাস ভাসকেজ। বল তার কাছে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে দৌড়ে এসে বল ক্লিয়ার করতে গেলেন মেধি বেনাতিয়া। মাটিতে পড়ে গেলেন ভাসকেজ, রেফারি মাইকেল অলিভার বাজালেন বাঁশি! বার্নাব্যুর মাঠে তখন স্বস্তি, আর রেফারির সিদ্ধান্তে হতাশায় আর ক্রোধে তখন পাগল প্রায় জিয়ানলুইজি বুফন। তার আচরণ পছন্দ হলো না রেফারির, সোজা লাল কার্ড দেখালেন জুভেন্টাস অধিনায়ককে। বুফন মাঠ ছাড়তে ছাড়তে বল নিয়ে পেনাল্টি স্পটের কাছে দাঁড়িয়ে গেলেন রোনালদো। দুই লেগের একটা ম্যাচ, একটা স্পটকিকের ওপর ভাগ্য ঝুলে আছে তার। ঘড়ির কাঁটায় ৯৫ মিনিট। বদলি গোলরক্ষক ওজানিক সেজনি লাফটাও দিয়েছিলেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোনালদোর শট তখন আটকায় কে? পেনাল্টি থেকে গোল জার্সি খুলে ফেললেন রোনালদো। জুভেন্টাসের ফিরে আসার লড়াই ম্লান হয়ে গেছে ততোক্ষণে।
মাদ্রিদে অনেক নাটকের পর রোনালদোর গোলেই দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৩ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে উঠল রিয়াল।
জুভেন্টাসের বিপক্ষে ফাইনাল জিতলেও দুই লেগের ম্যাচে আগে কখনও জেতা হয়নি রিয়ালের। সেই জুজুটাই আজ ভর করে বসেছিল জিনেদিন জিদানের দলের ওপর। সামি খেদিরার ক্রস থেকে হেডে যখন মারিও মাঞ্জুকিচ যখন গোল করলেন তখন ঘড়িতে কেবল পার হয়েছে ৭৬ সেকেন্ড।
শুরুতেই গোল খেয়ে কিছুটা চাপেই পড়ে গিয়েছিল রিয়াল। ভিআইপি বক্সে বসা সার্জিও রামোস অবশ্য তখনও হাসিমুখেই খেলা দেখছিলেন। মাঠে তার অনুপস্থিতিটা টের পাচ্ছিলেন রিয়ালের খেলোয়াড়রা। প্রথম গোলে খেদিরা ক্রসটা করেছিলেন ডানদিক থেকে। আক্রমণে বেশি মনোযোগ দেওয়া মার্সেলোকে টপকে জুভেন্টাসের বেশিরভাগ আক্রমণও হচ্ছিল ডান দিক দিয়েই। সুযোগ দেখে খুব বেশি দেরি করেননি ম্যাক্সিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি। ১৭ মিনিটেই ডি শিলিওকে বসিয়ে দিয়ে লিচস্টাইনারকে নামিয়ে দেন তিনি। জুভেন্টাস ম্যানেজারের সিদ্ধান্তটা সঠিক প্রমাণ করতে বেশি সময় নেননি লিচস্টাইনারও। ৩৭ মিনিটে ডান দিক থেকে এবার তিনি করলেন ক্রস, গোলদাতা সেই মাঞ্জুকিচই, আরও একবার হেড দিয়েই। প্রথম লেগে লাল কার্ড দেখায় আজ জুভেন্টাস দলে ছিলেন না পাউলো দিবালা। তবে তার অনুপস্থিতি আজ বুঝতেই দিলেন না মাঞ্জুকিচ। আর মাঝমাঠে মিরালেম পিয়ানিচ ফিরে এসে দেখিয়েছেন তুরিনে জুভেন্টাস দলে অভাব ছিল কীসের! পুরো মিডফিল্ডকে আজ এক সুতোয় বেঁধেছিলেন বসনিয়ান মিডফিল্ডার। জুভেন্টাস দুই গোল শোধ দেওয়ার পর কিছুটা মলিনই দেখা গেল রামোসকে, জুভের আক্রমণের ঝড় দেখে হয়ত আফসোসেই পুড়ছিলেন তখন তিনি।
আগের রাতে রোমার মতো অসম্ভবটা সম্ভব করার পথেই এগুচ্ছিল তখন জুভেন্টাস। তবে রোমার প্রতিপক্ষ বার্সেলোনা পুরো ম্যাচে আক্রমণে সুবিধা করতে পারেনি তেমন একটা। কিন্তু জুভের প্রতিপক্ষ রিয়াল অবশ্য প্রথমার্ধেই বেশ কয়েকবার আক্রমণ করে কাঁপিয়ে দিয়েছিল জুভেন্টাসের রক্ষণকে। পরীক্ষাটা তাই আরও কঠিনই ছিল বুফন, কিয়েলিনিদের জন্য। প্রথমার্ধ শেষের আগে রাফায়েল ভারানের হেড বারপোস্টে লেগে ফেরত না আসলে নিজেদের ওপর চাপটা কমাতে পারত রিয়ালও। কিন্তু ফিরে আসার লড়াইয়ে বোধ হয় কিছুটা ভাগ্যের ছোঁয়াও লাগে। বিরতিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেটা পেয়েছিলও জুভেন্টাস।
আত্মবিশ্বাসী জুভেন্টাসকে ঠেকাতে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দুইজন বদলি নামান জিদান। মার্কো আসেনসিও ও লুকাস ভাসকেজ নামেন গ্যারেথ বেল আর ক্যাসেমিরোর জায়গায়। কৌশল বদলে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর কিছু সময় সুবিধাও পেয়েছিল রিয়াল। কিন্তু ৬১ মিনিটে কস্তার একটা ক্রস ধরতে গিয়ে গড়বড় পাকিয়ে ফেলেন কেইলর নাভাস। রিয়াল গোলরক্ষকের হাত থেকে পড়ে যাওয়া বল ডাইভ দিয়ে জালে ঢুকিয়ে জুভেন্টাসকে টাইয়ে ফিরিয়ে আনেন ব্লেইস মাতুইদি। দুই লেগ মিলিয়ে ৩-৩ গোলের সমতা, গ্যালারিতে তখন মাদ্রিদিস্তাদের থেকে তুরিন থেকে আসা কয়েক হাজার জুভে সমর্থকদের আওয়াজই শোনা গেল বেশি। দর্শকসারিতে তাই টিকে থাকাই বোধ হয় অস্বস্তিকর হয়ে গেল রামোসের জন্য। এবার তিনি নিচে এসে বসলেন দলের সঙ্গে, সাইডবেঞ্চে!
অধিনায়কের উপস্থিতিটাই হয়ত শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার শক্তি যোগালো রিয়ালকে। শেষ আধঘন্টায় রোনালদো, ইস্কোরা বেশকয়েকবার শট করেই বুফনের কাছ থেকে ফিরে এসেছিলেন খালি হাতে। আর কিয়েলিনি, বেনাতিয়ারা মিলে রক্ষণে ততোক্ষণে গড়ে তুলেছেন দুর্গ। পুরো ম্যাচ যে গতিতে চলছিল, তাতে এগিয়ে ছিল জুভেন্টাসই। কিন্তু রিয়ালের শেষদিকে হার না মানসিকতার হার মানতে হলো বুফনদের। হার মানতে হলো আসলে নিয়তির কাছেই। মাতুইদির তৃতীয় গোলের পর বুফনের বাধভাঙা উল্লাস প্রমাণ করেছিল, এই শিরোপাটা জিততে তার চেয়ে উন্মুখ হয়ে নেই মাঠের আর কেউই। সেই বুফনকেই শেষ পর্যন্ত মাঠ ছাড়তে হলো লাল কার্ড দেখে। শেষের পেনাল্টিটা ঠেকানোর চেষ্টাও করা হলো না তার। সম্ভবত খেলে ফেললেন চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ম্যাচটাও। সেটাই যদি হয় তাহলে বুফনের লাল কার্ডটাই হয়ত মনে রাখবে সবাই, কিন্তু শেষ ম্যাচে মাঠ ছাড়ার সময়ও তো রেখে গেছেন ক্লিনশিট। চ্যাম্পিয়নস লিগের নিজের ৫০ তম! নায়কের এমন নাটকীয় বিদায়! জিদানকে পার করে মাঠ ছাড়ার সময় দুজনের চোখাচোখি হলো কী না সেটা ঠিক বোঝা গেল না। এমন সব নাটক তো জিদানের বহু আগেই দেখা! শিরোনামটা তাই শেষ পর্যন্ত থাকলো তার দখলেই।