কাকা : আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যের রাজপুত্র
এসি মিলান-লিভারপুল। ২৫ মে, ২০০৫। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। ইস্তাম্বুল-বিস্ময়।
মালদিনি, কাফু, নেস্তা, পিরলো, কাকা- মিলানের নাম শুনলেই শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের এক শীতল স্রোত নেমে আসত প্রতিপক্ষর। প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে এগিয়ে মিলান, ৭ম চ্যাম্পিয়নস লিগটা জিতেই গেছে প্রায়। এরপর নাটক। চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে নাটকীয় ফাইনালে পেনাল্টি শুট-আউটে জিতল লিভারপুল। একদিকে কাকার শূন্য চাহনি, অন্যদিকে জেরার্ডের বুনো উল্লাস- ‘ইস্তাম্বুলের বিস্ময়’ হয়ে যাওয়া ফাইনালটি মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা!
বছর দুয়েক পর আবারও এক মঞ্চে মুখোমুখি দুই দল। ভেন্যু গ্রিসের রাজধানী এথেন্স। শাপমোচনের সুযোগটা এবার আর হাতছাড়া করল না এসি মিলান। ২-১ গোলের জয়ে ইস্তাম্বুলের ভয়াল স্মৃতি কিছুটা হলেও ভুলল ‘রোজ্জোনেরি’রা। রেফারির শেষ বাঁশি, হাঁটু গেঁড়ে বসা কাকার ‘আই বিলং টু জিসাস’ (আমি ঈশ্বরের অনুসারী) দু’হাত উঁচিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর দৃশ্য। ইস্তাম্বুল-বিস্ময়কে ছাপিয়ে যেতে পারলেন কাকা?
রিকার্দো আইজ্যাকসন দস সান্তোস লেইতে ‘কাকা’র ক্যারিয়ার বোঝাতে এই দুইটি ঘটনাই যথেষ্ট। ভাগ্যদেবী যেমন একদিকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন সাফল্য, ঠিক তেমনি খালি হাতেও ফিরিয়েছেন অনেকবার। এসি মিলান, ব্রাজিল, রিয়াল মাদ্রিদ, সাও পাওলো- প্রতিটি দলেই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি তাকে ধরা দিয়েছে প্রায় পালা করেই। মেতেছেন বিশ্বকাপ জয়ের উল্লাসে, তেমনি ডুবেছেন পেনাল্টিতে শিরোপা হারানোর দুঃখে।
কাকার ক্যারিয়ারের শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না। তার পাদপ্রদীপের আলোয় আসার গোড়াপত্তনের কাহিনীটা বেশ চমকপ্রদ।
পানশালায় আড্ডা শেষে স্থানীয় দুই ক্লাব আলফাভিল এবং বারুয়েরির ক্ষুদে ফুটবলারদের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন সাও পাওলো কোচ পুপো হিমেনেজ এবং তার বন্ধু কার্লোস সানচেজ। নেহায়েতই মনোরঞ্জনের জন্য আসলেও পুপোর চোখ আটকে গেল একজনের উপর। দেখলেন, ডান পায়ের প্রথম টাচেই রীতিমত দুই ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলল শিশুটি। এরপর গতি বাড়িয়ে ডিবক্সের বেশ খানিকটা বাইরে থেকে জোরাল শটে পরাস্ত করল গোলরক্ষককে। সানচেজকে জানতে চাইলেন, “ছেলেটা কে?”
“রিকার্দো নাম। আমাদের পাড়াতেই থাকে”।
আর দেরী করলেন না পুপো। বন্ধু সানচেজকে নিয়ে দেখা করলেন ছেলেটির বাবা-মা’র সাথে। ব্রাজিলের একবিংশ শতাব্দীর যুবরাজের উত্থানের গল্পের শুরু।
ছোট্ট রিকার্দোর বাবা-মা’র সাথে কথা বলার আগেই পুপো ভেবে নিয়েছিলেন, আর্থিক স্বচ্ছলতার ব্যাপারটায় জোর দেবেন। কারণ ব্রাজিলের বেশিরভাগ পরিবারই তখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। কিন্তু তাদের বাসায় গিয়েই রীতিমত চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল পুপোর। আলিশান বাড়ি, গ্যারেজে শোভা পাচ্ছে গোটা তিনেক গাড়ি। আছে সুইমিং পুলও। তবে পুপোর কপাল ভালোই বলতে হয়। রিকার্দো এবং তার বাবা-মা’র কাছে সাও পাওলোর যুবদলে খেলার প্রস্তাব দিতেই রাজি সবাই। ৮ বছর বয়সেই 'কাকা' ঢুকে গেলেন ক্লাবটির একাডেমিতে। জার্সির পেছনে নতুন এক নাম নিয়ে। কাকা- রিকার্দোর বড় ভাই তার নাম ধরে ডাকতে পারতেন না বলে আদর করে যে নামে ডাকতেন।
নিজের ফুটবলীয় সামর্থ্যের জানান দিয়ে মাত্র ১৫ বছরেই সাও পাওলোর সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি, বছর চারেক পর অভিষেক। ‘তোর্নেইরো রিও’ টুর্নামেন্টের ফাইনাল। প্রতিপক্ষ বোটাফোগো। ম্যাচের ৭৬ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলে পিছিয়ে সাও পাওলো। কাকাকে নামিয়ে দিলেন কোচ আলবার্তো সিলভা। কাকা যেন নামলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। ৮৩ এবং ৮৫ মিনিটে দুই গোল করে দলকে নিশ্চিত হার থেকে শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতালেন। পরদিনই ব্রাজিলের সংবাদপত্র গ্লোবো স্পোর্তে শিরোনাম আসল, ‘উমা প্রিন্সিপা চেগুয়ে’, অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘নতুন এক যুবরাজের আগমন’!
পেশাদার ফুটবলে নিজের প্রথম মৌসুমেই ব্রাজিলিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা ফুটবলার হলেন কাকা। এরই মাঝে তাকে দলে ভেড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে ইউরোপের রাঘব-বোয়ালরা। কাকাকে নিয়ে মাতামাতি চোখ এড়ায়নি ব্রাজিল কোচ লুই ফিলিপে স্কলারির। ২০০২ বিশ্বকাপের বছরেই বলিভিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে অভিষেক হয় তার। একেবারেই নতুন হলেও প্রতিভার জোরেই সুযোগ পেয়ে যান স্কলারির বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। রোনালদিনহো, রোনালদো, রিভালদোদের তারকাখচিত দলের সাথে মাত্র ২০ বছর বয়সেই বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মাতেন কাকা।
প্রথম মৌসুমেই ব্রাজিলিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সেরা খেলোয়াড়; তার উপর প্রথম বিশ্বকাপেই চ্যাম্পিয়ন- পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুটা দুর্দান্ত ছিল কাকার। ইউরোপে যাওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার। তবে কাকা আরেকটু সময় নিলেন। আরও দুই বছর সাও পাওলোতেই থেকে গেলেন। ২০০৩ সালে ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এসি মিলানে পাড়ি জমালেন। এসি মিলান তখন ছড়ি ঘুরাচ্ছে ইউরোপে। দলে আছেন মালদিনি, নেস্তা, রুই কস্তা, ইনজাঘিদের মত তারকারা।
কাকার মূল একাদশে জায়গা পাওয়া নিয়ে সন্দিহান ছিলেন স্বয়ং স্কলারিই। সেসময় ইউরোপের সেরা প্লে-মেকার ধরা হত রুই কস্তাকে। দারুণ ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়ে সেই কস্তাকেই হটিয়ে মূল একাদশে জায়গা পাকা করেন কাকা। ব্রাজিল এবং বিশ্বমঞ্চের পর এবার ইউরোপেও প্রথম মৌসুমে বাজিমাত করলেন। জিতে নিলেন ‘স্কুডেট্টো’, ইউয়েফা সুপারকাপ। ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটাও ভারী হতে লাগল। সিরি আ-র সেরা ফুটবলারও হলেন।
২০০৪-০৫ মৌসুমে প্রথমবারের মত মুদ্রার ওপিঠটা দেখলেন কাকা। লাৎজিওকে হারিয়ে ইতালিয়ান সুপারকাপ জিতে মৌসুম শুরু করলেও সেবার স্কুডেট্টো ধরে রাখতে পারেনি মিলান। হতাশার এক মৌসুমের কালোমেঘ অবশ্য কেটে যায় ব্রাজিলের হয়ে ২০০৫ কনফেডারেশনস কাপ জয়ে। ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে শিরোপা জেতে ব্রাজিল। রবিনহোর পাস থেকে চমৎকার এক বাঁকানো শটে গোল করেছিলেন কাকা।
মূলত কাকার ক্যারিয়ারে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির একই তালে পথচলার শুরু এরপরই। ২০০৬ বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন ব্রাজিলের অন্যতম ভরসা হয়ে। কাফু, কার্লোস, রোনালদো, রোনালদিনহোদের মত তারকা থাকার পরও সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নেয় ‘সেলেসাও’রা। ব্রাজিলের জার্সিতে কাকার প্রথম হতাশা। বিশ্বকাপের এই ব্যর্থতাকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী মৌসুমে মাঠে নামেন তিনি। কাকার ক্যারিয়ারের ‘হাইলাইটস’ বলতে এই এক মৌসুমই যথেষ্ট।
ইতালিয়ান লিগে ৪র্থ এবং কোপা ইতালিয়ার সেমি থেকেই বাদ পড়লেও সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগে আক্ষরিক অর্থেই অদম্য ছিল মিলান। গ্রুপ-পর্বে আন্ডারলেখটের বিপক্ষে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। শেষ ষোলতে সেল্টিকের বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়েও স্কোরলাইন গোলশূন্য। দ্বিতীয় লেগের যোগ করা সময়ে প্রতি আক্রমণে নিজেদের অর্ধে বল পান কাকা। দুর্দান্ত গতিতে চারজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে করা সেই গোল এখনও চ্যাম্পিয়নস লিগের অন্যতম সেরা। কোয়ার্টারে বায়ার্নের বিপক্ষে দুই লেগেই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ ছিলেন তিনিই।
সেমিফাইনাল প্রথম লেগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচে তার পারফরম্যান্স এতটাই দারুণ ছিল, ৮৮ মিনিটে তাকে উঠিয়ে নেওয়ার সময় দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল ইউনাইটেড সমর্থকেরাও। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতে, ঐ ম্যাচে কাকার পারফরম্যান্স তার দেখা অন্যতম সেরা একক নৈপুণ্য। ৩-২ ব্যবধানে হারলেও জোড়া গোল করেছিলেন কাকা। ওই ম্যাচে করা তার দ্বিতীয় গোলটা, ইউটিউবে এখনও খুঁজে ফেরেন অনেকেই। সিডর্ফের পাস থেকে ডানপায়ের টোকায় গ্যাবব্রিয়েল হেইঞ্জের মাথার ওপর দিয়ে বল নিলেন। বামপাশ থেকে প্যাট্রিস এভরাকে এগিয়ে আসতে দেখে হেড করলেন বলে। হেইঞ্জ-এভরার মুখোমুখি সংঘর্ষ। ডিবক্সে ভ্যান ডার সারকে একা পেয়ে ঠান্ডা মাথায় বল জালে জড়ালেন কাকা। পুরো স্টেডিয়ামজুড়ে তখন রাজ্যের নীরবতা। অবিশ্বাস্য! অতিমানবীয়! দ্বিতীয় লেগে ৩-০ গোলে জিতে ফাইনালে গেল মিলান।
২০০৭ সালে ফুটবলবিশ্বে কাকার ধারেকাছে ছিলেন না কেউ। ফিফা ব্যালন ডি’অর জিতলেন ১,০৪৭ ভোট নিয়ে, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পেয়েছিলেন মাত্র ৫০৪ ভোট। ইউয়েফার বর্ষসেরা হলেন। জিতলেন ইউরোপিয়ান সুপারকাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপ। দ্বিতীয়বারের মত হলেন ‘সিরি আ-র সেরা ফুটবলার’। ক্লান্তি এবং অবসাদের কারণ দেখিয়ে ‘০৭-এর কোপা আমেরিকা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন কাকা। ‘০৫ এবং ‘০৭- তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ব্রাজিল দুইবার লাতিন আমেরিকার সেরা হলেও একবারও দলে ছিলেন না তিনি।
২০০৬-০৭ মৌসুম যেমন স্বপ্নের মত কেটেছিল, ঠিক তেমনি দুঃস্বপ্নের মত কাটল ২০০৭-০৮ মৌসুম। মিলানের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে লাগল ক্রমান্বয়ে, লিগে ৫ম হওয়ায় পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ হারায় মিলান। শেষ ষোল থেকে বিদায় নেয় ইউসিএল এবং ইতালিয়ান কাপ থেকেও। সব মিলিয়ে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন কাকা। ঐ সময় থেকেই মূলত তার মিলান ছাড়ার গুঞ্জন ডালপালা ছড়াতে দিতে থাকে। মিলান টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে কাকা সাফ জানিয়ে দেন, “যতদিন মিলান চাইবে, আমি থাকব। আমার দল ছাড়া সম্পূর্ণ মিলানের ওপর।"
সেবার দুবাইয়ের পেট্রোডলারের ঝনঝনানিতে পুষ্ট ম্যানচেস্টার সিটির প্রতি সপ্তাহে ৫ লাখ পাউন্ডের লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কাকা। তবে ক্লাবের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে মিলান হেড কোয়ার্টারের বাইরে মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে সমর্থকেরা। হেডকোয়ার্টার থেকে সেই মিছিল যায় কাকার বাসভবনেও। সমর্থকদের আকুতি দেখে জানালা দিয়ে হাত নেড়ে কাকা বারবার বলতে থাকলেন, “ইয়ে ভ্যু ফিকার” (“আমি থাকছি”)। কথা রাখলেন কাকা। ২০০৮-০৯ মৌসুমে মিলানেই থাকলেন মাঝমাঠের এই শিল্পী।
কিন্তু এরপরই সমাপ্তি ঘটে কাকা-মিলান প্রেমকাব্যের। রিয়াল মাদ্রিদের ৬৭ মিলিয়নের প্রস্তাব ঐ সময়ের আর্থিক অবস্থায় মিলানের পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া ছিল অসম্ভব। কাকাও বুঝতে পারলেন ক্লাবের অবস্থা। অশ্রুসজল নয়নে বিদায় জানান প্রিয় ক্লাবকে। যে ক্লাবকে ভালবেসে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কোটি পাউন্ডের প্রস্তাব, সেই ভালবাসার ক্লাবকে বাঁচাতেই রিয়ালে পাড়ি জমালেন কাকা। একই মৌসুমে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকেও কিনেছিল রিয়াল। কিন্তু এরপর থেকেই মূলত ক্যারিয়ারে ধস নামতে থাকে কাকার। ইনজুরির সাথে জোর লড়াইয়ে আর কখনোই ফিরে পাননি পুরনো ফর্ম। ইনজুরিতে পড়া কাকার বদলি হিসেবে কোচ হোসে মরিনহো দলে ভেড়ান মেসুত ওজিলকে। দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা দেখিয়ে মূল একাদশে কাকার জায়গা নিজের করে নেন ওজিল, বছর ছয়েক আগে যেভাবে রুই কস্তার জায়গা মিলানে নিজের করে নিয়েছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান।
২০১০ বিশ্বকাপের আগে হাঁটুর গুরুতর এক ইনজুরিতে পড়েন কাকা। শল্যবিদের পরামর্শ উপেক্ষা করে দেশের টানে বিশ্বকাপে যান কাকা। ২০০৯ সালে কনফেডারেশনস কাপ জেতা ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড়ের দিকে তাকিয়ে সমগ্র ব্রাজিলবাসী। কিন্তু ইনজুরির সাথে ঠিক পেরে উঠলেন না কাকা। ‘০৬-এর মত আবারও ব্রাজিল বাদ গেল কোয়ার্টার থেকে। বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতে ফিরেই ছুরির নিচে গেলেন কাকা, হারালেন ক্যারিয়ারের ৮ মাস। রিয়ালে ৪ বছরে খেলেছেন মোটে মাত্র ১২০ ম্যাচ। কাকা গোল করেছেন, এমন কোনো ম্যাচে হারেনি রিয়াল! ইনজুরির করাঘাত, ক্লাবে ফর্মহীনতা- সব মিলিয়ে জাতীয় দলের দরজাটাও ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসে কাকার জন্য। ‘১০ বিশ্বকাপের পর ২০১৩ সালে রিয়াল ছাড়ার আগ পর্যন্ত মাত্র তিনবার মূল দলে ডাক পেয়েছিলেন। বছরখানেক পরই স্বদেশে বিশ্বকাপ। কাকা বুঝলেন, রিয়ালে থাকলে ব্রাজিলের জার্সি জড়িয়ে নিজ সমর্থকদের সামনে মাঠে নামার যে ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে; তা-ও মিলিয়ে যাবে নিমিষেই।
২০১৩-১৪ মৌসুমের দলবদলের শেষদিন ফ্রি ট্রান্সফারে প্রাণের মিলানে ফিরে আসলেন কাকা। তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করে নিতে সেদিন উপচে পড়েছিল মিলানের বিমানবন্দর এবং ক্লাবের ট্রেনিং কমপ্লেক্স। পুরো মিলানজুড়ে তখন উৎসবের আমেজ। টুট্টোস্পোর্ট পরদিন কাকার চিরচেনা সেই ২২ নম্বর জার্সি উঁচিয়ে ধরা ছবি ছেপে শিরোনাম দিয়েছিল, “ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে”। মিলানের মূল একাদশে নিয়মিত হলেও ‘১৩-এর কনফেডারেশনস কাপের মতই স্কলারির বিশ্বকাপ স্কোয়াডেও জায়গা মেলেনি কাকার। ‘১৬-এর কোপা আমেরিকায় ডগলাস কস্তার ইনজুরিতে ডাক পেয়েছিলেন। সব ঠিকঠাক, জাতীয় দলে ফিরতে উদগ্রীব কাকা। পানামার হয়ে টুর্নামেন্টের আগে প্রীতি ম্যাচে আবারও বাধ সাধল ইনজুরি। ৯০ ম্যাচে ২৯ গোল করে ইতি টানতে হল ব্রাজিল অধ্যায়ের। এই ৯০ ম্যাচে কাকা যে কয়বার গোল করেছিলেন, কোনোবারই হারেনি ‘সেলেসাও’রাও।
মিলানের সাথে চুক্তিটা দু’বছরের হলেও পারস্পারি সমঝোতায় এক বছর পরই এমএলএস-এর অরল্যান্ডো সিটিতে নাম লেখান কাকা। এই একটি বছর প্রিয় মিলান থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেননি। তবে এমএলএস শুরু হয় জানুয়ারিতে। কাকার হাতে তখন মাস ছয়েকের অবসর। এমনটা আগেই জানতেন সাও পাওলো কোচ মুরিসি রামালহো। তার অনুরোধেই কাকা ফিরলেন নাড়ির টানে, সেই সাও পাওলোতে; যেখানে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। প্রত্যাবর্তনের ম্যাচেই গোল করেছিলেন। ভিতোরিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে তার গোলেই জয় পেয়েছিল সাও পাওলো। ম্যাচ শেষে সমর্থকদের ‘রিকি তে আমো’ (রিকার্দো, তোমায় ভালবাসি) যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল পুরো ব্রাজিলেই। বিদায়বেলায় এর চেয়ে মধুর অভিবাদন খুব সম্ভবত কল্পনা করেননি কাকা নিজেও। অরল্যান্ডোতে কাটানো ৩ মৌসুম শেষে চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। সাও পাওলো, মিলানও তাকে ফিরে আসার অনুরোধ করেছিল।
কিন্তু শরীরটা যে আর মানে না! এবার বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন কাকা। গত বছরের ১৫ অক্টোবর কলোম্বাস ক্রুর বিপক্ষে ম্যাচে সমগ্র স্টেডিয়ামজুড়ে ছিল বিষণ্ণতার এক কালোছায়া। প্রিয় ‘রিকার্দো’র বিদায়টা মেনে নিতে পারছিলেন না কেউই। ৭৮ মিনিটে বদলি হওয়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন। চারপাশটা দেখে নিলেন একবার, শেষবার। পুরো স্টেডিয়াম তখন দাঁড়িয়ে চোখের জলে বিদায় জানাচ্ছে তাকে। আমেরিকার মত দেশে একজন ফুটবলারের জন্য এত আবেগ, কাকার মাহাত্ম্য তো এখানেই! জয় দিয়েই ইতি টানলেন বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের। যে ক্যারিয়ারে আছে সব ধরনের অর্জন, সম্মান; আবার নেই অনেক কিছুই!
কাকার নৈশজীবনের প্রতি টান ছিল না। কাকা ঈশ্বরভক্ত।
বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ব্যালন ডি’অর- ক্যারিয়ারে জিতেছেন সম্ভাব্য সবই। কিন্তু তারপরও কাকার নাম শুনলেই একটা বিষণ্ণতার সুর যেন বেজে উঠে দূরে। আহা, যদি হাঁটুর ইনজুরিটা এভাবে না ভোগাতো! আর কয়টা বছর যদি নিজের সেরাটা দিতে পারতেন! পৃথিবীতে যে গুটিকয়েক ফুটবলারের আক্ষরিক অর্থেই কোনো নিন্দুক নেই, তার মধ্যে কাকা নিঃসন্দেহে একজন।
কোনো এক অলস দুপুরে বা বৃষ্টিস্নাত বিকেলে ইউটিউবে আগ্রহবশত বা আবেগতাড়িত হয়ে হয়ত খুঁজে ফিরতে হবে কাকার সেরা মুহূর্তের ভিডিওগুলো। কাকা হাসবেন। কাঁদবেন।
আর দুইহাত ওপরে তুলে ধন্যবাদ জানাবেন তার ঈশ্বরকে। কাকার সঙ্গী থাকবো তখন আমরাও!