যে ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করে গেলেন ইনিয়েস্তা
১.
ওয়ান্ডা মেট্রোপলিটানোর সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছেন বার্সেলোনার অধিনায়ক। শুরুতে হাত মেলালেন বার্সেলোনা আর লা লিগার হর্তা-কর্তাদের সঙ্গে। আর কিছুদুর সামনে তার জন্য অপেক্ষায় স্পেনের রাজা। পঞ্চম ফিলিপে গ্যালারির দর্শকদের কাছে পছন্দের পাত্র নন। কাতালোনিয়া থেকে আসা দর্শকদের বাদ দিলে মাদ্রিদে বার্সা সমর্থকের সংখ্যাও বেশি নয়। একপেশে ফাইনালের পর একদলের সমর্থকদের অনেককেই বাড়ি ফেরার পথ ধরেছেন ততোক্ষণে। বাকিরা অপেক্ষা করছেন আরেকজন রাজার জন্য। তিনি জনগণের রাজা। ফুটবলের রাজ্যে তিনি ইন্দ্রজিতের চেয়েও বেশি কিছু, অতিমহারথী।
এতোক্ষণ দুয়ো শুনছিলেন ফিলিপে, তিনি কাছে আসতেই গ্যালারির রূপ পালটে গেল। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে দুয়ো দেয় কে? ক্লাব ফুটবলের আদিকালের রেষারেষি তার জন্য নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে বদলে গেছে অনেক আগেই। বৈরি বার্নাব্যুও তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যায়।
ইনিয়েস্তা এগিয়ে আসলেন, হাত মেলালেন রাজার সঙ্গে, দুই হাতে প্রথমে ধরলেন শিরোপা, তারপর উঁচিয়ে ধরলেন।
২.
বেলায় বেলায় বয়স হয়েছে ৩৩। আজ অবশ্য মাঠের ইনিয়েস্তাকে দেখে সেটা আঁচ করার উপায় ছিল না। শুরু থেকেই কী দারুণ ছন্দে মোহাবিষ্ট করে রাখলেন! দুই, তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে স্বমহিমায় যখন বারবার সেভিয়ার রক্ষণে ছুরি চালাচ্ছিলেন সেটা দেখে কে বলবে তিনি ফুরিয়ে গেছেন? ফুটবল তো অনেকেই খেলে কিন্তু সেটা দিয়ে মায়ার ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে কয়জন?
২৮ মিনিটেই আজ গোলটা পেতে পারতেন। সেভিয়া ডিফেন্ডারের সঙ্গে কাঁধ মেলানো দূরত্বে ছিলেন। ওইটুকুই জায়গাই ইনিয়েস্তার জন্য যথেষ্ট, তার কাছে ওই জায়গাটা মহাশূন্যের মতো। বাঁ পায়ের শটটা ডিফ্লেক্টেড হয়ে বারপোস্টে লেগে ফেরত আসলো।
বার্সেলোনার ৫-০ গোলে জেতা ম্যাচেও অতৃপ্তি থাকতে পারত। সেটা ইনিয়েস্তার চেয়ে বেশি বার্সা সমর্থকদের, বার্সা সমর্থকদের চেয়ে বেশি ফুটবল প্রেমিদের। ইনিয়েস্তা আক্ষেপের সুযোগ দিলেন না। ৫২ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে পাস দিলেন লিওনেল মেসিকে। তিনি ফিরতি পাস দিতে দিতে ইনিয়েস্তা ঢুকে গেলেন ডিবক্সের ভেতর। স্প্যানিশ ফুটবলের অতি পরিচিত দৃশ্য। পরের দৃশ্যে ইনিয়েস্তার ফেক শট, আসল শটে বল জালে। বার্সেলোনার চতুর্থ গোলটা করলেন ইনিয়েস্তা। শূন্যে উড়াল দিলেন এরপর। ইনিয়েস্তাকে এমন উদযাপন করতে কবে দেখেছেন?
দলের সবাই ছুটলেন তার দিকে। মেসি কয়েকবার জড়িয়ে ধরলেন। আজ একটু জোরেই বুক মেলালেন। এমন একজন না থাকলে হয়ত তারও মেসি হয়ে ওঠা হত না। লুইস সুয়ারেজ পেছন থেকে মাথায় চুমু খেলেন। সবার কাছ থেকে সরে যখন দম ফেলার বাতাসটুকু পেলেন, তখনই ডাগ আউটের দিকে তাকিয়ে এক হাত উঁচিয়ে নাড়ালেন।
৩.
বেশ কিছুদিন ধরে বদলি হওয়া, বদলি হয়ে মাঠে নামা তার জন্য নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। আর তারও আগে থেকে স্পেনে চলছে আরেকটা রীতি। যেখানে, যে মাঠেই বদলি হবেন ইনিয়েস্তা, সে দল যত গোলে পিছিয়ে থাক, যত উত্তেজনার বারুদ বিষ্ফোরণের অপেক্ষায় থাকুক- গ্যালারির সবাই দাঁড়িয়ে যাবেন। ইনিয়েস্তা মাঠ ছাড়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকবেন, হাত তালি দেবেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মেসিদের গোলের পরিসংখ্যান মুখস্থ করা পর্যন্ত যাদের ফুটবল জ্ঞানের ব্যপ্তি তারাও বাদ যান না। পায়ে তার চুম্বক লাগানো, দুই পায়ের কারিকুরি দেখে ‘জিনিয়াস’ চিনতে ভুল করে না কেউ।
আজও দেখা গেল সেই দৃশ্য। এই দৃশ্যে শিহরণ জাগে। তাতে আন্দোলিত হন এর্নেস্তো ভালভার্দেরাও। ৫ গোলে এগিয়ে থাকা ম্যাচে তিনিও লোভ সামলাতে পারলেন না। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা আরেকবার দেখলেন, দেখার ব্যবস্থা করে দিলেন বাকিদের। বদলি হয়ে মাঠ ছাড়লেন ইনিয়েস্তা।
এই মৌসুমে একটা আক্ষেপ থাকবে তার। রোমার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের হারটা নিয়ে। ওই ম্যাচেও বদলি হয়েছিলেন। রোমা তিন গোল শোধ দেওয়ার পর আর সাইডবেঞ্চে বসতে পারেননি। সিলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, একবার সামনের দিকে, আরেকবার পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার আগে অবিশ্বাসে মুখ ঢেকেছিলেন।
আজ সাইডবেঞ্চে গিয়ে বসে পড়লেন। সতীর্থদের সবাই আঁচ করতে পারছিলেন, হয়ত নিশ্চিতভাবে তারা জানেনও কী হতে যাচ্ছে। পাশে বসা মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান প্রথমে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। মুগ্ধতা নিয়ে নাকি তিনিও অবিশ্বাসে তাকিয়ে ছিলেন? এমন একজনকে আর এখানে দেখা যাবে না ভেবে?
ইনিয়েস্তার দিকে সবার চোখ, কয়েকশ ক্যামেরার লেন্স তাক করা। ইনিয়েস্তা কারও দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করলেন না তখন। জার্সিতে চোখ মুছতে মুছতে ডাগআউট পর্যন্ত এসেছেন। বাকিদের দিকে তাকালে হয়ত সেই সুযোগটাও পাবেন না। মাঠের দিকেই তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু সেখানে তো আরও মায়া, বোতল খুলে পানি দিয়ে মুখ ভিজিয়ে নিলেন তাই। নিজেকে ফাঁকি দিলেও, ক্যামেরার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেন না। ইনিয়েস্তার ভিজে ওঠা ঘোলা চোখ মুহুর্তেই টুইটার, ফেসবুকে শেয়ার হয়ে গেল হাজারবার।
৪.
শিরোপা হাতে নিয়ে ইনিয়েস্তা আবারও সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলেন, টানেল ধরে এগিয়ে গেলেন মাঠের দিকে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে পুরো দল। একটু আগেই এই দলটা নিশ্চিত করেছে শিরোপা। সেভিয়াকে গোলে হারিয়ে একপেশে ফাইনালের পর এসবকিছুই ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আরেকটা আনুষ্ঠানিকতাও কি সারা হয়ে গেল আজ? ইনিয়েস্তার বিদায়ের? গত কয়েকদিন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত ছাপতে থাকা খবর যদি সত্যি হয়, তাহলে আজকে মঠের এই ইঙ্গিতগুলোও সত্যি। এই ফাইনালটাই হয়ে থাকবে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ইনিয়েস্তার শেষ। ইউরোপিয়ান ফুটবলের আলো ঝলমলে রাতে এই বেশে আর দেখা যাবে না তাঁকে। তাহলে ইনিয়েস্তার ইউরোপ অধ্যায় শেষ হলো? নাকি ফুটবল থেকেই ফুরিয়ে গেল একটা অধ্যায়?