সালাহর রাতে আশা বাঁচিয়ে রাখল রোমা
কিছুদিন আগেই লিভারপুলের এক কর্মকর্তা আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, মোহাম্মদ সালাহর জন্য ৩৯ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করাটা বেশ বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে ‘অল রেড’দের। এতদিনে তার আক্ষেপ ঘুচে যাওয়ারই কথা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন, গত সপ্তাহেই জিতে নিয়েছেন ইপিএল-এর বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব। আর আজ তো চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে সাবেক দল রোমার বিপক্ষে নিজেকে নিয়ে গেলেন এক অনন্য উচ্চতায়। নিজে গোল করেছেন দুটি, করিয়েছেন আরও দুটি। সালাহময় এক রাতে ৫-২ গোলের বড় ব্যবধানে জিতলেও অবশ্য শেষ ১০ মিনিটে রোমা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোয় এখনই নির্ভার থাকতে পারছে না ক্লপের দল।
অ্যানফিল্ডে লিভারপুল বড় জয় পেলেও ম্যাচের শুরু থেকেই ইয়ুর্গেন ক্লপের দলকে চেপে ধরেছিল রোমা। অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বার্সেলোনার বিপক্ষে যেখানে শেষ করেছিল ইতালিয়ানরা, ঠিক সেখান থেকেই যেন অ্যানফিল্ডে শুরু করল ইউসেবিও ডি ফ্রাঞ্চেস্কোর দল। আক্রমণে ৩-৫-২ এবং রক্ষণে ৩-৪-৩ ফর্মেশনে ম্যাচের শুরু থেকে মাঝমাঠে রোমার সাথে একেবারেই পেরে উঠছিল না লিভারপুল। মাঠের লড়াইয়ে রোমার চেয়ে পিছিয়ে পড়লেও ক্লপের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দেয় মিডফিল্ডার অ্যালেক্স অক্সলেড-চেম্বারলেইনের ইনজুরি। এর মিনিটখানেক পরই সাবেক ম্যানচেস্টার সিটি লেফটব্যাক আলেকজান্ডার কোলারভের জোরাল শট ক্রসবারে প্রতিহত হলে অল্পের জন্য বেঁচে যায় লিভারপুল। মাঝামঠে জর্জিনিও ওয়াইনাল্ডাম নামার পর থেকেই মূলত গুছিয়ে খেলা শুরু করে লিভারপুল। প্রথমার্ধে লিভারপুলের লিডটা আরও বড় হতে পারত। কিন্তু বেশ কয়েকবার গোলের সামনে সাদিও মানের দূর্বল ফিনিশিং-এ তা আর হয়ে উঠেনি। ২৯ মিনিটে গোলরক্ষককে একা পেয়েও বল বাইরে মেরেছেন সেনেগালিজ উইঙ্গার। এর মিনিটখানেক পরই আবারও গোলের সুযোগ লিভারপুলের। কিন্তু আবারও মানের ভুলে লিড নেওয়া হয়নি ‘অল রেড’দের। ভাগ্যও অবশ্য মানের সহায় হয়নি। ৩৩ মিনিটে অবশেষে যেবার বল জালে জড়ালেন, সেবার অফসাইডের কারণে গোল বাতিল করলেন লাইন্সম্যান।
অবশ্য মানের মিসগুলোর জন্য খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি লিভারপুলকে। যাদের দলে সালাহ আছে, তাদের আবার কীসের ভয়! ৩৫ মিনিটে ডিবক্সের ডানপ্রান্তে রবার্তো ফিরমিনোর পাস থেকে বল পান সালাহ। বাঁপায়ের নিখুঁত বাঁকানো শটে অ্যালিসনকে পরাস্ত করতে ভুল করেননি মিশরিয় উইঙ্গার। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে গোল, তাও আবার নিজ সমর্থকদের সামনে- কোনো কিছুই রোমার প্রতি সালাহর ভালবাসা দমাতে পারেনি একবিন্দুও। গোলের পরই রোমা সমর্থকদের উদ্দেশ্যে রীতিমত হাত জোর করে ক্ষমাই চেয়ে নেন সালাহ। এর আগে চেলসির সঙ্গে প্রিমিয়ার লিগে গোল করেও একই কাজ করেছিলেন। আজ রোমার বিপক্ষেও কৃতজ্ঞতাটা জানিয়ে রাখলেন। ওদিকে গোল হজম করেও সালাহর জন্য জোর করতালি দিয়ে রোমা সমর্থকেরাও বোঝালেন, সালাহর জন্য শ্রদ্ধা-সম্মানটা যেন এমনই থাকবে আজীবন। লিড নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য ব্যবধান দ্বিগুণের সুযোগ পেয়েছিলেন ডিফেন্ডার ডেয়ান লভ্রেন। সালাহর কর্ণার থেকে ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডারের হেড প্রতিহত হয় ক্রসবারে। তবে প্রথমার্ধে ঠিকই দ্বিতীয় গোলের দেখা পেয়ে যায় লিভারপুল। এবারও সেই ফিরমিনো-সালাহ বোঝাপড়া। নিজেদের ‘ট্রেডমার্ক’ প্রতি আক্রমণে ডিবক্সের কিছুটা সামনে থেকে সালাহর দিকে থ্রু পাস বাড়ান ফিরমিনো। অ্যালিসনকে এগিয়ে আসতে দেখে বাঁ-পায়ের আলতো চিপে দ্বিতীয় গোল করেন সালাহ। দ্বিতীয় গোলের পরও উৎসবে মাতলেন না সালাহ, এবারও গোল হজম করে রোমা সমর্থকদের করতালি। যেন পুরো মাঠে রোমা-লিভারপুল সমর্থক নয়, সবাই-ই যেন এক সালাহরই একনিষ্ঠ ভক্ত। লিভারপুলের ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো খেলোয়াড় এক মৌসুমে ১০ গোলের মাইলফলক ছুঁলেন।
প্রথমার্ধে ছিলেন গোল করার ভূমিকায়। দ্বিতীয়ার্ধে যেন গোল করানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই নামলেন সালাহ। ৫৬ মিনিটে ডানপ্রান্ত থেকে রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আর্নল্ডের লম্বা পাস নিয়ন্ত্রণে এনে ডিবক্সে ঢুকে পড়েন সালাহ। হুয়ান হেসুসকে কাটিয়ে ফাঁকায় দাঁড়ান মানের দিকে পাস বাড়ান তিনি। প্রথমার্ধের মিসগুলোর শাপমোচনের এর চেয়ে সহজ সুযোগ হয়ত পেতেন না মানে। ভুল করেননি এবার। প্রথম লেগের ৫৬ মিনিটেই ৩-০ গোলের লিড। পুরো অ্যানফিল্ড যেন তখন মেতেছে উৎসবের আমেজে। ক্লপের ‘অল রেড’রা যেন তখন খুনের নেশায় মত্ত। আবারও সেই সালাহ-ফিরমিনো জুটিতে ব্যবধান ৪-০ করে লিভারপুল। মানের গোলের একেবারে ‘কার্বন কপি’ই বলা চলে এই গোলকে। ৬০ মিনিটে আলেকজান্ডার-আর্নল্ডের পাস থেকে বল পেয়ে ডিবক্সে ঢুকেই মানোলাসকে কাটিয়ে ক্রস করেন সালাহ। গোলের মাত্র গজ দুয়েক দূর থেকে ভুল করেননি ফিরমিনো। খেই হারিয়ে ফেলা রোমা রক্ষণভাগকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করতে থাকে লিভারপুল। ৬৭ মিনিটে আবারও গোল। জেমস মিলনারের কর্ণার থেকে হেড করে ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় এবং লিভারপুলের পঞ্চম গোল করেন ফিরমিনো। ক্লপকে আর তখন পায় কে! জার্মান কোচের স্বভাবসুলভ উদযাপনের জ্বরে তখন ভুগছে সমগ্র অ্যানফিল্ড। ‘আলে আলে কিয়েভ!’ চিৎকারে তখন মুখরিত পুরো লিভারপুল শহর।
কিন্তু ইউসেবিও পুরোপুরি হাল ছাড়েননি। ৫-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েও তার উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়েনি একটুও। আক্রমণাত্মক ফুটবলটা পুরো ম্যাচেই চালিয়ে গেছে তার দল। কোচের এমন লড়াকু মনোভাব যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করে রোমার গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে। এতক্ষণ যাদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না, সেই জেকো-নাইঙ্গোলানরা ফিরতে থাকেন স্বরূপে। বদলি ডিয়েগো পেরোত্তি নামার পর মাঝ মাঠে বলের দখল পায় রোমা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শুরুটা করেছিলেন জেকোই। বার্সার বিপক্ষে ন্যু ক্যাম্পের মতই এবারও প্রথম লেগের ৮১ মিনিটে এক গোল শোধ করেন বসনিয়ান স্ট্রাইকার। রাদজা নাইঙ্গোলানের লম্বা পাসে লভ্রেনের ভুলে ডিবক্সে লরিস কারিওসকে একা পেয়ে যান জেকো। ডানপায়ের ফিনিশে লক্ষ্যভেদ করতে ভুল করেননি তিনি। ৪ গোলে পিছিয়ে থাকলেও রোমার প্রত্যেক খেলোয়াড়ের মনে তখন ভাসছে বার্সা বধের সুখস্মৃতি। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই আজও শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে তারা। ৮৫ মিনিটে নাইঙ্গোলানের শট মিলনার ডিবক্সে হাত দিয়ে ঠেকালে পেনাল্টির বাঁশি দেন রেফারি। ১২ গজ থেকে ব্যবধান ৫-২ করেন ডিয়েগো পেরোত্তি।
৩ গোলের ব্যবধানে জিতলেও খুব একটা স্বস্তিতেও থাকতে পারছেন না ক্লপ। রোমার মাঠে তিন গোলের লিড নিয়ে নিশ্চিন্তে যাওয়াটা যে ঠিক কতটা বোকামির কাজ- তা গত রাউন্ডেই প্রমাণ করেছেন এর্নেস্তো ভালভার্দে এবং বার্সেলোনা। ম্যাচের শুরুতে রোমা, শেষেও রোমা, মাঝের সময়টাতে লিভারপুলের দাপট- পুরো ম্যাচের গল্পটাই ছিল এমন। ৫-২ স্কোরলাইনেও তাই সবকিছুই তোলা থাকল রোমের দ্বিতীয় লেগের জন্য।