ফার্গি টাইমে ওয়েঙ্গারেকে ওল্ড ট্রাফোর্ডের বিদায়
টানেল থেকে বেরিয়ে যখন ডাগআউটের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পুরো ওল্ড ট্রাফোর্ড জুড়ে করতালি। এই মাঠে গত ২১ বছর যতবার এসেছেন আর্সেনালের ম্যানেজার হয়ে, প্রায় প্রতিবারই শুনেছেন দুয়ো। কিন্তু আজকের ম্যাচটি যে একেবারেই ভিন্ন! কিছুদিন আগেই ঘোষণা দিয়েছেন আর্সেনাল ছাড়ার। সেজন্যই আর্সেন ওয়েঙ্গারের শেষ ওল্ড ট্রাফোর্ড যাত্রায় ইউনাইটেড সমর্থকেরা শত্রুতা ভুলে জানালেন সম্মান। কিছুক্ষণ পর হাজির হলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন, জড়িয়ে ধরলেন নিজের অনেকদিনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে, উপহার দিলেন এক স্মৃতিস্মারক। সঙ্গে যোগ দিলেন হোসে মরিনহোও। তিনজনের ছবিটা হয়ে ঢুকে গেল প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে। তবে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ওয়েঙ্গারের শেষ ম্যাচটা স্মরণীয় করে রাখতে পারল না আর্সেনাল। ইতিহাসই ফিরে আসলো আবার, ফার্গি টাইমে গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে নিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মারুয়ান ফেলাইনির ৯১ মিনিটের গোলে ‘গানার’দের ২-১ গোলে হারিয়েছে হোসে মরিনহোর দল। সেই সাথে আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলাও নিশ্চিত করেছে রেড ডেভিলরা।
এই সপ্তাহেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ইউরোপা লিগের সেমিফাইনাল দ্বিতীয় লেগ। সে চিন্তা মাথায় রেখেই অ্যারন রামসি, মেসুত ওজিল, জ্যাক উইলশেয়ারদের বিশ্রাম দিয়েছিলেন ওয়েঙ্গার। দলে এসেছিলেন অ্যান্সলি মেইটল্যান্ড-নাইলস, রিস নেলসন এবং গ্রিক ডিফেন্ডার কন্সটান্টিনোস মাভ্রোপানোসের মত অনভিজ্ঞ তরুণেরা। ২০১১ সালের পর আজকের মূল একাদশই ছিল আর্সেনালের সবচেয়ে তরুণ একাদশ। ওল্ড ট্রাফোর্ডে অনুমিতভাবেই পূর্ণশক্তির দলই নামিয়েছিলেন মরিনহো। আর্সেনালের অনভিজ্ঞতা এবং ফুটবলারদের মাঝে বোঝাপড়ার অভাবের সুযোগটা ভালমতই নিয়েছিল ইউনাইটেড। শুরু থেকেই পগবা, লুকাকু, সানচেজদের সামাল দিতে রীতিমত গলদঘর্ম হচ্ছিল আর্সেনাল রক্ষণভাগের। লিড নিতেও দেরী করেনি তারা। ১৬ মিনিটে পগবার পাস থেকে ডিবক্সের ডানপ্রান্তে বল পান লুকাকু। বেলজিয়ান স্ট্রাইকারের ক্রসে সানচেজের হেড আর্সেনাল ডিফেন্ডার হেক্টর বেলেরিনের পায়ে লেগে প্রতিহত হয় বারপোস্টে। তবে ফিরতি বল ডানপায়ের আলতো টোকায় জালে জড়াতে ভুল করেননি গোলের একেবারে সামনে দাঁড়ান পগবা।
প্রথমার্ধে গোলের তেমন সুযোগ তৈরি করতে না পারলেও পগবার গোলের মিনিট চারেক পর আরেকটু হলেই দলকে সমতায় ফেরাতে পারতেন সাবেক ইউনাইটেড ফুটবলার হেনরিখ মিখিতারিয়ান। ২০ মিনিটে তার নিচু শট ডেভিড ডি গেয়ার গোলের সামান্য বাইরে দিয়ে চলে গেলে যে যাত্রায় বেঁচে যায় ইউনাইটেড। এরপর থেকেই মূলত ম্যাচে ফিরতে থাকে আর্সেনাল। মাঝামাঠে মেইটল্যান্ড-নাইলস এবং শাকার সাথে ঠিক পেরে উঠছিলেন না মাতিচ এবং হেরেরা। মাঝামাঠে শাকারা যেমন উজ্জ্বল ছিলেন, ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ ছিলেন স্ট্রাইকার পিয়ের-এমেরিক অবামেয়াং। মিখিতারইয়ানের মতই প্রথমার্ধের একেবারে শেষদিকে ভাগ্য সহায় হয়নি অ্যাশলি ইয়ং-এর। ৪১ মিনিটে তার শট প্রতিহত হয় আর্সেনালের গোলপোস্টে।
প্রথমার্ধের অল্পের জন্য গোলের দেখা পাননি, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আর্সেনালকে ঠিকই সমতায় ফিরিয়েছিলেন সেই মিখিতারিয়ানই। মাঝামাঠে আবারও মাতিচ-হেরেরার থেকে বল কেড়ে নেন শাকা। পাস বাড়ান মিখিতারিয়ানের দিকে। বল নিয়ে ডিবক্সে ঢুকেই আড়াআড়ি এক নিখুঁত শটে লক্ষ্যভেদ করেন তিনি। প্রিমিয়ার লিগে এই দুই দলের প্রথম ম্যাচেও গোল করেছিলেন মিখিতারিয়ান। তখন ইউনাইটেডের জার্সিতে, প্রতিপক্ষ ছিল আর্সেনাল। জার্সি, শহর বদলালো, তবে বদলালেন না মিখিতারিয়ান। গোলের পর উদযাপনের চেয়ে ইউনাইটেড সমর্থকদের দিকে হাত উঁচিয়ে যেন গোলের জন্য ক্ষমাই চেয়ে নেন তিনি। ৭৬ মিনিটে মিখিতারিয়ানকে উঠিয়ে নেওয়ার সময় জোর করতালি দিয়ে ইউনাইটেড সমর্থকেরাও যেন জানালেন আর্মেনিয়ান মিডফিল্ডারকে ভুলে যাননি তারাও। মিখিতারিয়ানের গোলের পর মাঝামঠের লড়াইটা জমে উঠে আরও। দ্বিতীয়ার্ধের বাকিটা সময় বল দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে ছিল ইউনাইটেডই। কিন্তু ডেভিড ওসপিনাকে আর পরীক্ষায় ফেলতে পারেননি পগবারা। ওদিকে প্রতি আক্রমণে খেলা আর্সেনালও ইউনাইটেড রক্ষণভাগকে তটস্থ করে রাখতে পারেনি একেবারেই।
দ্বিতীয়ার্ধে গোলের আশায় মার্কাস রাশফোর্ড, অ্যান্থনি মার্শিয়াল এবং মারুয়ান ফেলাইনিকে নামিয়ে দেন মরিনহো। মার্শিয়ালকে উইং-এ খেলিয়ে গোলের আশায় ফেলাইনিকে খেলান আক্রমণে। দুই উইং থেকেই ক্রস নির্ভর খেলায় মত্ত তখন ইউনাইটেড। ৮৯ মিনিটে আরেকটু হলেই এই ‘মাস্টার স্ট্রোক’-এ জিতে গিয়েছিলেন মরিনহো। মার্শিয়ালের ক্রসে ফেলাইনির হেড বারপোস্টে প্রতিহত হয়ে রাশফোর্ডের গায়ে লেগে জালে জড়ালেও অফসাইডে বাতিল হয় গোলটি। কিন্তু নাটকের বাকি ছিল তখনও। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে আবারও সেই বাঁ-প্রান্ত থেকে করা ক্রসে দুর্দান্ত এক হেডে জয় নিশ্চিত করেন ফেলাইনিই। গোলের পর মরিনহোর উদযাপন এবং চওড়া হাসিই জানান দিচ্ছিল, ফেলাইনিকে স্ট্রাইকার খেলানোর ‘চাল’টা পুরোপুরি ফলে গেছে তার। শেষ পর্যন্ত আবারও হার নিয়েই ওল্ড ট্রাফোর্ড ছাড়লেন ওয়েঙ্গার। হয়ত এবার চিরতরের জন্য। ফার্গুসনের উপস্থিতিতে সেই চিরপরিচিত ‘ফার্গি টাইম’-এ করা গোলেই খালি হাতে ফিরতে হল ‘দ্যা প্রফেসর’কে।