• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    বায়ার্নকে হারিয়ে কিয়েভের পথে রিয়াল মাদ্রিদ

    বায়ার্নকে হারিয়ে কিয়েভের পথে রিয়াল মাদ্রিদ    

    সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ঘড়ির কাঁটা ৯০ মিনিট পার করে গেছে আরও আগেই। ২-২ এ সমতায় থাকা দ্বিতীয় লেগে বায়ার্ন মিউনিখের দরকার ছিল একটা গোল। আর পুরো ম্যাচে বায়ার্নের আক্রমণ সামলাতে ব্যস্ত রিয়াল মাদ্রিদ তখন শেষ বাঁশি শোনার অপেক্ষায়। মাঝমাঠ থেকে জশুয়া কিমিচ একটা লং বল পাঠালেন ডিবক্সের ভেতর। থমাস মুলার দৌড়টা দিয়েছিলেন খানিকটা দেরি করেই, দৌড়ে ধরতে গিয়েও পারলেন না। অথচ ওই বলটা রিসিভ করতে পারলেই সামনে কেবল রিয়াল গোলরক্ষক। দুই লেগের টাইয়ে বায়ার্ন আর ফাইনালের দূরত্ব হয়ে থাকল ওই একটা গোল। প্রথম লেগের মতো আজও তাদের সঙ্গী হলো আফসোস। কিন্তু রিয়াল ভুল করলো না, বরং তাদের বিপক্ষে ভুলের শাস্তি কতোটা ভয়াবহ সেটাই আরও একবার জানিয়ে দিয়ে কিয়েভের ফাইনালের পথে যাত্রা শুরু করলো তারা। জিনেদিন জিদান আর রিয়াল মাদ্রিদ এখন হাঁটছে টানা তৃতীয় শিরোপার পথে। আর দুই লেগ মিলে ৪-৩ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে আরও একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে রিয়ালের কাছে হেরেই বাদ পড়ল বায়ার্ন মিউনিখ। 

    সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে বায়ার্নের শুরু আর শেষের মধ্যে বিস্তর ফারাক। দরকার ছিল জয়, সেটা হয়নি। কিন্তু শুরুটা ছিল মনমতোই। দরকার ছিল একটা দ্রুত গোল। বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হয়নি সেটি পেতে। আগের ম্যাচের বায়ার্নকে এগিয়ে দিয়েছিলেন জশুয়া কিমিচ। এবার একই কাজ করলেন ম্যাচের ৩ মিনিটেই। ডান দিক থেকে আসা ক্রস ভালো মতো ক্লিয়ার করতে পারেননি সার্জিও রামোস। সেই বল এসে পড়ে কিমিচের পায়েই। সেখান থেকেই গোল করে দলকে এগিয়ে দেন বায়ার্ন রাইটব্যাক। 



    বায়ার্নের বিপক্ষে ফোর ফোর টু ফর্মেশনেই দল নামিয়েছিলেন জিদান। কিন্তু ইনজুরি আক্রান্ত দানি কারভাহালের জায়গায় নেমেছিলেন লুকাস ভাজকেজ। ডানদিকে রিয়ালের রক্ষণের দুর্বলতা আঁচ করতে পেরে বায়ার্নও ওই প্রান্ত দিয়েই আক্রমণগুলো চালাচ্ছিল বেশি। তবে শুরুর ধাক্কা সামলে ১০ মিনিটের মধ্যেই ম্যাচে ফেরে রিয়ালও। বাঁ দিক থেকে ক্রস করেছিলেন মার্সেলো। ডিবক্সের ভেতর দৌড়ে এসে ফাঁকা জায়গা থেকেই হেডে বল জড়ান একাদশে ফেরা করিম বেনজেমা।

    এরপর প্রথমার্ধে জুড়ে বায়ার্নই আক্রমণে বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেও গোলের দেখা আর পায়নি তারা। ডানদিক দিয়ে ফ্রাঙ্ক রিবেরি আর ডেভিড আলাবা বেশ কয়েকবার ভালো ক্রস করেছিলেন, কিন্তু মুলার, লেভানডফস্কিরা সেই তুলনায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেননি রিয়ালের ডিবক্সের ভেতর। আক্রমণভাগে বেশি মনোযগী বায়ার্ন রক্ষণে ছিল একেবারেই সাদামাটা। তবে সেই সুযোগটা প্রথমার্ধে কাজে লাগাতে পারেনি রিয়ালও। ম্যাচের আধঘন্টা পেরুনোর পর অবশ্য দারুণ দুটো সুযোগ পেয়েছিল বায়ার্ন। প্রথমবার রিবেরির ক্রস থেকে নিয়েছেন দুর্বল শট। সেটা সহজেই ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন কেইলর নাভাস। মিনিট খানেক পর ম্যাটস হামেলস নিজের অর্ধ থেকে উঠে গিয়েছিলেন রিয়ালের রক্ষণে। তার থ্রু পাস থেকে রবার্ট লেভানডফস্কি শটও নিয়েছিলেন, এবারও ঠেকিয়ে দিলেন নাভাস। কিন্তু ফিরতি বলে সুযোগ ছিল মুলারের কাছে। তার আগেই অবশ্য মার্সেলো হাজির হয়ে গিয়েছিলেন বক্সের ভেতর, মুলারের হেড ব্লক করেন ব্রাজিলিয়ানই।  

    বায়ার্নের বিপক্ষে অবশ্য দ্বিতীয় লেগেও সুবিধা করতে পারেননি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও। দুই অর্ধে দুটো সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথমার্ধেরটা অবশ্য নিজেই চেষ্টা চালিয়েছিলেন।  ৩৮ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে গোলে শট করেছিলেন পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড। নিজের বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোনালদোর গ্রাউন্ড শট ঠেকিয়ে দেন বায়ার্ন গোলরক্ষক উলরেইখ। প্রথম লেগের মতোই  ১-১ এ শেষ হয় প্রথমার্ধ। তবে শেষদিকে রেফারির সিদ্ধান্ত কিছুটা অসন্তোষ ছড়িয়েছে বায়ার্ন ডাগআউটে। ডানদিকে থেকে কিমিচের ক্রস ব্লক করার সময় হাতে লেগেছিল মার্সেলোর। পেনাল্টি আবেদনে রেফারির সাড়া না পাওয়াই বায়ার্নের অসন্তোষের কারণ।  

    বিরিতির পর প্রথম লেগের পান্ডুলিপিটাই যেন চিত্রায়িত হলো আরেকবার। এবার অবশ্য বায়ার্ন ভুল করলো আরও বড়রকমের। ৪৬ মিনিটে গোলরক্ষক উলরিখের কাছে টলিসো দিয়েছিলেন ব্যাকপাস। সেটা ঠিকমতো রিসিভ করার আগেই দৌড়ে আসেন বেনজেমা। ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকারের চাপে পড়ে হঠাৎ পা পিছলে নিয়ন্ত্রণ হারান উলরিখ। নয়্যারের 'আন্ডারস্টাডি'র এমন উপহার লুফে নিয়ে ফাঁকা বারে নিজের দ্বিতীয় গোল করতে কোনো সমস্যাই হয়নি বেনজেমার। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-২ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার মিনিট সাতেক পর টাই শেষ করে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন রোনালদোও। মার্সেলোর ক্রসটা ঠিকমতোই ভলি করেছিলেন, কিন্তু তার নেওয়া শট চলে যায় বারপোস্টের অনেক ওপর দিয়ে।

    পিছিয়ে পড়েও অবশ্য আক্রমণে ধার কমেনি বায়ার্নের। এবার পান্ডুলিপিটা বদলে গেল প্রথম লেগ থেকে। তাতে অবশ্য রঙ চড়লো আরও। রিয়ালের রক্ষণকে রীতিমত তটস্থ করে রেখেও এতোক্ষণ গোল পাচ্ছিল না বায়ার্ন। কিন্তু গোলটা যখন আসলো সেটা পেলেন সাবেক রিয়াল খেলোয়াড়ই। ডান দিক থেকে আসা ক্রসে প্রথমবার শট নিয়েছিলেন, কিন্তু রাফায়েল ভারানের গায়ে লেগে ব্লকড হলো হামেস রদিগেজের প্রথম চেষ্টা। ফিরতি বলটা পেলেন কোণাকুনি জায়গা থেকে। সেখান থেকেই নাভাসকে হারিয়ে ৬৩ মিনিটে আবারও বায়ার্নকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন রদ্রিগেজ।


    সমতায় থাকা লেগে ৭০ মিনিটের পর 'ডাবল চেঞ্জ' করেন জিনেদিন জিদান। গ্যারেথ বেলের সঙ্গে নামেন কাসেমিরোও। তবে কৌশলে তেমন বদল আসেনি রিয়ালের, প্রতি আক্রমণেই তৃতীয় গোলটা পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল তারা। আর বলের দখলের সঙ্গে দাপট দেখিয়ে বায়ার্নই শাসন করছিল ম্যাচ। ৭৪ থেকে ৭৮ মিনিটের মধ্যে সেরা সুযোগগুলো পেয়েছিল বায়ার্ন। প্রথমে টলিসোর নেওয়া শট ঠেকিয়ে দেন কেইলর নাভাস। রিয়াল গোলরক্ষক অবশ্য পুরো ম্যাচ জুড়েই আজ রক্ষা করেছেন দলকে। সবমিলিয়ে ৮ টি সেভ করেছেন তিনি, চ্যাম্পিয়নস লিগের এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি সেভের রেকর্ডও গড়লেন এই ম্যাচে। ৭৮ মিনিটে সেভ করেন মুলারের গোলের দিকে এগুতো থাকা হেড। আর এই ৩ মিনিটের মাঝের সময়ে রদ্রিগেজেও রাঙিয়ে দিতে পারতেন বায়ার্নকে। কিন্তু এবার আর ডিবক্সের ভেতর থেকে করা শট ভারানের গায়ে লেগে ফেরত আসলো না। গোলরক্ষক পর্যন্তও তাই যাওয়া হয়নি তার।

    এর কিছুক্ষণ পরই বদলি হয়ে মাঠ ছাড়েন রদ্রিগেজ। সমতাসূচক গোলের পর পুরো বার্নাব্যুর কাছে হাতজোর করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। উত্তেজনার বারুদ যখন চরমে তখনও বদলি হওয়ার সময় বার্নাব্যুর দর্শকদের কাছ থেকে তার প্রতিদান রদ্রিগেজ পেয়েছেন। এর আগেই অবশ্য ইয়ুপ হেইংকেস আরও একটা বদলি করেছিলেন। স্ট্রাইকার সান্দ্রো ওয়াগনারকে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও অবশ্য সুবিধা করতে পারেননি একেবারেই।  শেষদিকে কর্নার থেকে গোল করার সুযোগটাও হাতছাড়া করেছেন হামেলস। আর জমাট বাধা রক্ষণের সঙ্গে আরও একবার নিজেদের স্নায়ু ধরে রেখে ঘরের মাঠে জিতে গেল রিয়াল মাদ্রিদ। পান্ডুলিপি বদলালেও, গল্পের শেষটা থাকলো তাই একইরকম। জিদান থেকে গেলেন অপরাজেয়!