• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    রোমার আশাভঙ্গের রাতে ফাইনালে লিভারপুল

    রোমার আশাভঙ্গের রাতে ফাইনালে লিভারপুল    

    ৯৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করলেন। ব্যবধান ৪-২। দরকার আরও এক গোল। উচ্ছ্বাস বা বল হাতে সেন্টারের দিকে দৌঁড়- কোনোটাই দেখা গেল না রাদজা নাইঙ্গোলানের মাঝে। মাথা নিচু করে হাঁটা শুরু করলেন। হয়ত জানতেন, মহাকাব্য রচনা হচ্ছে না এবার। হয়ত নিজের ভুলের আফসোসটাও ভর করেছিল তখন। ওই গোলের কিছুক্ষণ পরেই শেষ বাঁশি বাজালেন রেফারি। উল্লাসে ফেটে পড়ল লিভারপুল। সপ্তাহ তিনেক আগের চ্যাম্পিয়নস লিগের অন্যতম সেরা রূপকথার সাক্ষী অলিম্পিক স্টেডিয়াম যেন এক মৃত্যুপুরি তখন। রোমে শোনা গেল লিভারপুল সমর্থকদের উল্লাসই। অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ৪-২ গোলে হারলেও দুই লেগ মিলিয়ে ৭-৬ ব্যবধানে  জিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে লিভারপুল। প্রথম লেগে ৫ গোল খাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়াল রোমানদের জন্য। ১২ বছর পর ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে ফিরল লিভারপুল। ২৬ মে কিয়েভে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটের লড়াইয়ে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে মাঠে নামবে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল।

     

    বার্সেলোনার বিপক্ষে মহাকাব্যিক সেই প্রত্যাবর্তনের রাতে শুরুতেই গোল করেছিলেন জেকো। আজ লিভারপুলের বিপক্ষে এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিল অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ম্যাচের শুরুতে গোল হল এবারও, কিন্তু তা হল রোমার জালে! পুরো মৌসুমে নিজেদের মাঠে গোল হজম না করা রোমার জালে বল পাঠাতে লিভারপুলের সময় লাগল মাত্র ৯ মিনিট। মাঝমাঠে রাজ্জা নাইঙ্গোলানের দূর্বল ব্যাকপাস ধরে প্রতি আক্রমণ শুরু করেন রবার্তো ফিরমিনো। বাঁ-প্রান্তে এগিয়ে আসতে থাকা সাদিও মানেকে পাস বাড়ান তিনি। বল নিয়ন্ত্রণে এনে বাঁ পায়ের জোরাল শটে অ্যালিসনকে পরাস্ত করেন মানে। পুরো অলিম্পিক স্টেডিয়াম তাতেই চুপ মেরে গেল। ডাগআউটে কোচ ইউসেবিও ডি ফ্রাঞ্চেস্কোর শূন্য অভিব্যক্তি, কিংবা ভিআইপি বক্সে রোমান সম্রাট ফ্রাঞ্চেস্কো টট্টির হাত দিয়ে মুখ লুকানো- মানের গোলে হতাশার কালোমেঘে ঢেকে গিয়েছিল পুরো রোম। হতাশ হলেও হালছাড়ার পাত্র নন ইউসেবিও। চোয়াল শক্ত করে বেঞ্চ থেকে উঠে আসলেন ডাগআউটে। আর রোমাও গোলটাও শোধ করে নিল মিনিট পাঁচেক পর। ১৫ মিনিটে আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জির ক্রস হেড করে ডিবক্সে পাঠান স্টেফান এল-শারাউই। রোমার উইঙ্গারের হেড ক্লিয়ার করেন দেয়ান লভ্রেন। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডারের জোরাল ক্লিয়ারেন্স ডিবক্সে দাঁড়ান জেমস মিলনারের মুখে লেগে জড়ায় লিভারপুলের জালে।

     

     

    ওই গোলে প্রাণ ফিরে পায়  অলিম্পিক স্টেডিয়ামেও। বল হাতে সেন্টারের দিকে দৌঁড়ে আসেন অধিনায়ক ড্যানিয়েল ডি রসি। কাজ যে এখনও ঢের বাকি! মানের গোলে মুখ ঢেকে ফেলা টট্টির উদযাপন দেখে মনে হচ্ছিল; যেন এখনও অবসর নেননি, দ্বিতীয়ার্ধেই সেই চিরপরিচিত ১০ নম্বর জার্সি চাপিয়ে নেমে পড়বেন মাঠে। কিন্তু ক্লপের লিভারপুল সহজে মচকানোর পাত্র নয়। ২৫ মিনিটে আরেকটু হলেই আবারও লিড নিয়ে নিয়েছিল লিভারপুল। কিন্তু লেফটব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসনের মাইনাসে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক’ রেঞ্জ থেকে মানের শট দুর্দান্তভাবে রুখে দেন অ্যালিসন। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। ফিরতি কর্ণারেই অ্যালিসনের ভুলে হেড করে ব্যবধান ২-১ করেন জর্জিনিও ওয়াইনাল্ডাম। প্রথম লেগে অ্যালেক্স অক্সলেড-চেম্বারলেইনের ইনজুরিতে তিনি মাঠে পড়ার পরই ম্যাচে কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরাতে পেরেছিল লিভারপুল। আজ গোল করে চেম্বারলেইনের অভাবটা আবারও ভুলিয়ে দেন ওয়াইনাল্ডাম। ১৩-১৪ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের পর এবারই কোনো ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লিগের এক মৌসুমে প্রতিপক্ষের মাঠে ২০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করল লিভারপুল। ডাচ মিডফিল্ডার প্রথম লেগের মত খেললেও মোহাম্মদ সালাহ ছিলেন কিছুটা বিবর্ণই।

    মহাকাব্য রচনার রাতে ভাগ্যদেবী একবারও মুখ তুলে তাকাননি রোমার দিকে। ৩৪ মিনিটে এল-শারাউইয়ের শট বারপোস্টে প্রতিহত হওয়া, ৪২ মিনিটে লভ্রেন ডিবক্সে তাকে ফেলে দিলেও রেফারির পেনাল্টির বাঁশি না দেওয়া, ৬০ মিনিটে চেঙ্গিজ উন্ডারের শটে কারিওসের দুর্দান্ত সেভ- কোনোবারই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি রোমার।

     

     

    দুর্ভাগ্য, রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, ৪৫ মিনিটে ৪ গোলের কঠিন সমীকরণ- কোনকিছুই যেন রোমার শেষ পর্যন্ত লড়াই করার মনোবলে চির ধরাতে পারেনি এতটুকুও। সেই মনোবলের জোরেই ৫২ মিনিটে সমতায় ফেরে রোমা। লরেঞ্জো পেলেগ্রিনির শট লরিস ক্যারিয়াস ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি বলে ঠান্ডা মাথায় ব্যবধান ২-২ করেন জেকো। দ্বিতীয়ার্ধের বাকিটা সময় কেবলই রোমার আক্ষেপের। একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করলেও সেই পরম অরাধ্য গোলটাই আর পাওয়া হয়নি তাদের। কখনও আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের ভুলে, কখনও লিভারপুলের দুর্দান্ত রক্ষণে ক্যারিয়াসকে আর পরাস্ত করা হয়নি রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের। ৬৩ মিনিটে আবারও রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ভুক্তভোগী হতে হয় রোমাকে। এল-শারাউইয়ের শট লাইন থেকে ফিরিয়ে দেন অ্যালেকজান্ডার-আর্নল্ড। তবে রিপ্লেতে দেখা গেছে, ইতালিয়ান উইঙ্গারের শট হাত দিয়ে ঠেকিয়েছিলেন এই ইংলিশ তরুণ রাইটব্যাক। মিনিট চারেক পর ডিবক্সে বেশ খানিকটা জায়গা পেয়েও বল বাইরে মারেন জেকো। পরে এই মুহুর্তগুলো রোমার আফসোস বাড়িয়েছে আরও। গোলের আশায় হন্যে হয়ে ছোটা রোমার বিপক্ষে প্রতি আক্রমণে বেশ কয়েকবার গোলের সুযোগ পেয়েছিল লিভারপুলও। 

    দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে থাকেন সালাহ। প্রতি আক্রমণে ফিরমিনোকে দারুণ দুটি থ্রু পাস বাড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অ্যালিসন এবং বার্সা বধের নায়ক কস্তাস মানোলাসের দক্ষতায় আর গোলের দেখা পাওয়া হয়নি ‘অল রেড’দের। শেষ ১০ মিনিটে দরকার আরও ৩ গোল- অসম্ভব সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়েও লড়াকু মনোভাব হারায়নি রোমা। লিভারপুলের প্রথম গোল এসেছিল তার ভুল পাসেই। ৮৬ মিনিটে কোলারভের পাসে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত এক গোল করে কিছুটা শাপমোচন এবং কিছুটা সান্ত্বনা নিয়েই মাঠ ছাড়েন নাইঙ্গোলান। শেষদিকে নাইঙ্গোলানের গোল আবারও নতুন প্রাণের সঞ্চার করে রোমা সমর্থকদের মাঝে। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে ক্লাভানের হ্যান্ডবলে পেনাল্টি পায় রোমা। ১২ গজ থেকে আবারও ক্যারিয়াসকে পরাস্ত করেন নাইঙ্গোলান। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। গোলের পরপরই রেফারির শেষ বাঁশিতে নিশ্চিত হয় প্রায় ১ যুগ পর লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল যাত্রা। আরও এক মহাকাব্য রচনার দ্বারপ্রান্ত থেকে বিদায় নিল রোমা। জানিয়ে রাখল, কেন ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ বললে রোমের কথাই মাথায় আসে প্রথমে।