• " />

     

    কাকতাড়ুয়া, সাদা হ্যাট আর কয়েকটি স্বপ্নের গল্প

    কাকতাড়ুয়া, সাদা হ্যাট আর কয়েকটি স্বপ্নের গল্প    

    কাকতাড়ুয়া দেখেছেন? সেই যে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে, একলা একা। হয়তো দূরে থাকে আরেকটা। কাকতাড়ুয়ার কাজ ফুরোয় একসময়। গৃহস্থ হয়তো নিয়ে আসেন সেই বাঁশের কাঠামোটা। ঘটিটা। শীর্ণ বস্ত্রটা। হয়তো এসবই যত্ন করে রেখে দেন। আবার কোন এক ফসলের মাঠে ব্যবহারের জন্য। কাগতাড়ুয়া থাকে। নীরবে, নিভৃতে।

    কাকতাড়ুয়ারা এমনই।

    ১.

    ‘এতরকম ভক্ত দেখছি ভাই জীবনে, তোর মত দেখি নাই! মানুষ এমন ভক্ত হয়!’

    আমাদের গল্পের শুরুটা হোক কোন এক মঙ্গলবারে।

    ঢাকা, বাংলাদেশ। এলিফ্যান্ট রোডের স্পোর্টসের দোকান থেকে দুই বন্ধুর যাত্রা, উদ্দেশ্য গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেট। ছেলেটা, মানে আমাদের গল্পের শুরুটা যাকে দিয়ে, সেই পীড়াপীড়ি করে বন্ধুকে নিয়ে চলেছে সেখানে। একটা জিনিস কেনা উদ্দেশ্য। একটা ‘কাউন্টার’। ক্রিকেটের মাঠে আম্পায়াররা বল গুনতে যে যন্ত্রটা ব্যবহার করেন সেরকম এক কাউন্টার।

    এই কাউন্টারের প্রকারভেদ আছে। একটা আছে অ্যানালগ। আরেকটা ডিজিটাল। অ্যানালগেরও আবার দুইরকম ভাগ। মারাইস এরাসমুস নামে দক্ষিণ আফ্রিকান যে আম্পায়ার আছেন এলিট প্যানেলে, তিনি ব্যবহার করেন সেই আদ্দিকালের এক কাউন্টার। ছয়টা করে আংটার মতো আছে, একটা করে বল হয়, একটা করে আংটা নামিয়ে দেওয়া হয়। আর একরকম অ্যানালগ যন্ত্র চাকাভিত্তিক। গণনা করতে চাকা ঘোরাতে হয় এক এক করে (এটাই সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত এখন)। আরেকটা একদম ডিজিটাল ঘড়ির মতো। বাটন চাপ দিলেই গণনা (কুমার ধর্মসেনার হাতে দেখা যায়)।

    উদ্দেশ্য সেই চাকাওয়ালা কাউন্টার কেনা। তাও আবার হতে হবে সেই ‘রাউন্ড-শেপে’র। যে আম্পায়ারের ‘ভক্ত’ ছেলেটা, তাঁর হাতে থাকে যে সেই কাউন্টার!

    ছেলেটা সেই কাউন্টার কিনতে পারলো কি? থাক না সে কথা।

     

    ২.

    অস্ট্রেলিয়া। নিউ সাউথ ওয়েলস। ছেলেটা ফাস্ট বোলিং করতো। তার দলের অধিনায়ক ছিল মাইকেল স্ল্যাটার। উইকেটের পেছনে থাকতো অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। স্কুল পর্যায়ে যারা ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করতো, তাদেরই রাজ্যদলে। চোখেমুখে হয়তো তখন ব্যাগি গ্রিন তোলার স্বপ্ন খেলা করতো।

    বাধ সাধলো চোট। পিঠে। ক্রিকেট খেলাটা ছাড়তে হলো। ক্রিকেট নয়। ফিফথ গ্রেডের এক ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে যখন নামলো ছেলেটা, তখন বয়স বিশ।

    ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারের মধ্যগগন যখন চলে, সেই ২৭ বছর বয়সে প্রথম ওয়ানডেতে নেমে গেল সেই ছেলেটা। আম্পায়ারিং করতে। আইসিসির এলিট প্যানেলে ঢোকার আগ পর্যন্ত অবশ্য আম্পায়ারিংয়ের পাশাপাশি করতে হতো প্রিন্টিং ফার্মে চাকরী। যে বয়সে অন্যরা আম্পায়ারিং শুরু করেন, সেইরকম ৪১ বছর বয়সেই সাইমন টফেল অবসরে গেছেন। আম্পায়ারদের কোচ তিনি এখন।

     

    ৩.

    নিউজিল্যান্ড। অকল্যান্ড। একুশ বছর বয়সে ধরা পড়লো আরথ্রাইটিস। প্রথম প্রথম বুঝতো না ঠিক। দুটি রাস্তা খোলা ছিল তার সামনে, হয় বসে বসে দেখা, কিছু না করেই, অথবা মেনে নেওয়া, সামনে এগিয়ে যাওয়া। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটা ধামাচাপা দিতে হলো তখনই। তাই বলে ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসাটা তো কমলো না।

    তারপর? নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের এক বিজ্ঞাপন বদলে দিল সব।

    শরীরে আরথ্রাইটিস নিয়েই ব্রেন্ট ফ্রেজার বাউডেন ভালবেসে গেছেন ক্রিকেটকে। চিরভাবগম্ভীর ভঙ্গিমাকে বদলে আম্পায়ারিংয়ে এনেছেন বিনোদনের নতুন মাত্রা। সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় সেই ‘ক্রুকেড ফিংগার’- আঙ্গুল বাঁকা করে আউটের সংকেত। এতে অবশ্য শুধুই বিনোদন নেই। শুধু আউট কেন, বিলির সব ‘সিগন্যাল’য়েই মোটামুটি তার সেই রোগের প্রভাব আছে। আঙ্গুল সোজা করতে পারেন না ঠিকমতো, বোলারদের জাম্পার, সুয়েটার ধরে রাখতে পারেন না বলে কোমরে বেঁধে রাখেন। অবশ্য বাঁকানো আঙ্গুলে আউট দেওয়ার একটা ‘দার্শনিক’ ব্যাখ্যাও আছে বিলির, এর মানে হলো ‘অর্ধেক অর্ধেক, বাস্তবতা আর তা দেখানো’!

     

    ৪.

    পাকিস্তান। লাহোর। ছেলেটা ক্রিকেট খেলবে বলে এসেছিল সে শহরে। লেগস্পিনে বেশীদূর যেতে পারলো না ঠিক। বন্ধুসুলভ এক ভাই পরামর্শ দিলেন, যেহেতু ক্রিকেটকে ভালবাসো, আম্পায়ারিং শুরু করে দিতে পার। তাই করলেন, কিন্তু বাস্তবতা তো কঠিন। শুধু আম্পায়ারিং করে কি আর জীবিকা আসে!

    আলীম দার তাই পাড়ি জমালেন মার্কিন মুলুকে। শুরু করলেন ট্যাক্সি চালানো। কিন্তু মন পড়ে রইল সেই বাইশ গজের চৌহদ্দিতেই! স্ত্রী বোঝেন তাঁর মনের অবস্থা, একদিন ফোন করলেন শ্বশুরকে। সম্মতি দিলেন দেশে ফেরার।

    এসেই সুযোগ পেলেন ২০০৩ এর বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করার। সেই বিশ্বকাপে চলার সময়েই একমাত্র মেয়েটা মারা গেল আলীমের। কিন্তু স্ত্রী জানালেন না, যদি মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে!

    তারপর এলিট প্যানেল, সাইমন টফেলের সঙ্গে কয়েকবার সেরা আম্পায়ারিং টিম এর পুরস্কার জেতার পর আইসিসির সেরা আম্পায়ার, টানা তিনবার!

     

    ৫.

    রিচার্ড কেটেলব্রো, ব্রুস অক্সেনফোর্ডসহ আরও অনেকেরই গল্পগুলো এমনই। সাইমনের মতো, বিলির মতো, আলীমের মতো।

    এমন এক পেশা, যেখানে আলোর ঝলকানি নেই, মিডিয়া সেভাবে আপনার দিকে তাকাবে না, যদি না কোন ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে বসেন! প্রায় প্রত্যেক সিরিজের পরই নিজের মোবাইল ফোনের সিমকার্ড পরিবর্তন করতে হয়, জুয়াড়িদের দৌড়াত্ম্যে। বিদেশ সফর গেলে হয়তো শপিংয়ে যাওয়া হয় না, গেলেও অনেকের চোখকে ধুলা দিয়ে! আবেগের এখানে দাম নেই, ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ কম। চরম উত্তেজনায় যখন কাঁপছে গোটা মাঠ, তখনও তাঁরা নির্বিকার! মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকা যায় না একটা শটের দিকে, একটা অসাধারণ ডেলিভারির দিকে। কাজ যে বাকী কত!

    এখন ডিআরএসের যুগ। প্রযুক্তির যুগ। তবুও সবসময় এসবের সাহায্য মেলে না। তারপর হয়তো একজন দিয়ে বসেন একটা ভুল সিদ্ধান্ত। তারপর স্লো মোশনে দেখানো হয়, কী ভুলটাই না করেছেন। তখন তাঁদের মানসিক অবস্থাটা কেমন থাকে? ভুল শট খেলে আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের মতন? ক্যাচ মিস করা ফিল্ডারের মতন? নাকি বাজে একটা বল করে বসা বোলারের মতন?

    সিদ্ধান্ত ভুল হোক বা সঠিক হোক, পরের বলেই আবার শুরু করতে হয় নতুন করে। কাজটা কি সহজ?

    তবুও তাঁরা এই কাজটা করে যান। ক্রিকেটকে ভালবাসেন যে। ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চান যে। আচ্ছা, শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিংয়ের ‘ব্যাড-প্যাচ’ ছিল না কখনও? ছিল। ক্যারিয়ারের উত্থান পতন গেছে তাঁদের মতো মহারথীদেরও। আম্পায়ারদের কিন্তু থাকে এমন ‘ব্যাড-প্যাচ’। স্টিভ বাকনরেরও এসেছিল। ড্যারিল হার্পারেরও এসেছিল। ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে, বা ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। দুই ধরনের এই বাজে সময়কে কিন্তু দুইভাবে দেখা হয় না। বাকনররা তাই চলে যান, সময়ের কিছুটা আগেই।

    ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষকে আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে দেখেছেন কতবার? শেষ ইংল্যান্ড নিউজিল্যান্ডের সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডে দেখে থাকলে দেখেছেন এমন। স্টিভ ডেভিসের অন-ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে শেষ ম্যাচ ছিল তা। শেষবারের মতো যখন উঠে যাচ্ছেন, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বললেন, যেন ডেভিস মাঠ ছাড়তে খেলোয়াড়দের নেতৃত্ব দেন। পরে স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই ঘটনার কথা বলতেই যেন আবেগে কাঁপছিলেন স্টিভ! শেষবারের মতো উঠে যাওয়ার আগে এরকম ‘ছোটখাট’ ঘটনা, বা শেষবারের মতো নামার আগে ‘গার্ড অব অনার’- এই মানুষগুলোকেও আবেগে নাড়িয়ে দেয়! কিংবা এই ঘটনাগুলো ঘটবে বলেই হয়তো স্টিভ ডেভিসের মতো আম্পায়াররা ২৩ বছর ধরে এই কাজটা করে যান!

    তারপর?

    সবাই সাইমন টফেলের মতো আইসিসির আম্পায়ারদের ‘ট্রেনার’ এর চাকরী পান না। ডিকি বার্ডের মতো সবারই মূর্তি গড়ে ওঠে না ইয়র্কশায়ারে। যেন হারিয়ে যান তাঁরা। ডেভিড শেফার্ড তাই শুধু মৃত্যুতে খবরে আসেন। স্টিভ বাকনর, রুডি কোয়ার্টজেন, ভেঙ্কটরাঘবনরা কোথায়, জানা যায় না। জোনাথন ট্রট, মার্কাস ট্রেসকোথিকরা ‘অবসন্নতায়’ ভুগে ক্রিকেট বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়েন, সে খবর সবাই রাখেন। কিন্তু মার্ক বেনসন নামের যে আম্পায়ারটা ‘ডিআরএস’ এর চাপ নিতে না পেরে আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ছাড়েন, তাঁর কথা মনে রাখেন ক'জন!

    তাঁদের ফেসবুক পেজ নেই, তাঁদের সেলফিতে লাইক দেওয়া হয় না কারো! জানাও যায় না তাই, মাঠের ‘দুই’ (অথবা চার) গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজনেরা এখন কই আছেন! কেমন আছেন! 

    ভাল আছেন নিশ্চয়ই। ক্রিকেটকে ভালবেসে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই, এখনও!

     

    ৬.

    সে মঙ্গলবারের ছেলেটার গল্পে ফেরত যাই চলুন। টফেল, দার, বাউডেনের মতো গল্পটা তার নয় অবশ্য। আসলে সেই গল্পটাই লেখা হয়নি। বিসিবির ওয়েবসাইট হাতড়ে খুঁজেও যে মেলেনি আম্পায়ারিং সম্পর্কে কোনো তথ্য। মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে যাতায়াত করেন, এমন পরিচিত জনকেও খোঁজ নিতে বলেছিল মনে হয়। তথ্য মেলেনি।

    বিসিবি আম্পায়ারিংকে তেমন ‘গুরুত্ব’ দেয় না হয়তো। তবুও এদেশের মানুষ আম্পায়ারিংয়ের ভুলকে তেমন ক্ষমা করতে পারেন না। ভারতের সঙ্গে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইয়ান গোউল্ড আর আলীম দারকে যেমন ক্ষমা করতে পারেননি। তারপর যখন একজন এনামুল হক মনি ‘বাজে’ সিদ্ধান্ত দেন, তখন শোধ হয়ে যায় কিছুটা। তারপর এনামুল হক মনি যখন আইসিসির এলিট প্যানেলে সুযোগ পান না, তখন সহমর্মিতা ঝড়ে পড়ে। আইসিসির প্রতি ক্ষোভ ঝরে।

    তবে সামনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও যে মনি সুযোগ পাননি, সে খবর রাখেন কজন! বিসিবির আম্পায়ারিং নিয়ে আদৌ কোনো ‘প্রোগ্রাম’ আছে কিনা, জানেন ক'জন!

    তবুও আমরাই হয়ে যাই ‘জাজ’। আমরাই নির্ধারন করি, কে আউট, কে নন। আমরাই হয়ে যাই একেকজন আম্পায়ার। আর্ম চেয়ার, ইজি চেয়ার আম্পায়ার। আসাদ রউফ, ড্যারেল হেয়ার, আরও অনেক নাম জানা না জানা আম্পায়াররাও আমাদের ভাবতে বাধ্য করে এমন করে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, পূত-পবিত্র ক্রিকেটার যেমন আছেন, ম্যাচ গড়াপেটা করা ‘বিশ্বাসঘাতক’ ক্রিকেটারও তো আছেন। ক্রিকেটারও ক্রিকেটের, আম্পায়ারও ক্রিকেটের!

    এত কিছুর পরও সেই মানুষগুলোর ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা কমে না।

    তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন।

    কাকতাড়ুয়ার মতো!

     

    ৭.

    যতই প্রযুক্তি আসুক, আম্পায়ারিং এখনও অনেক বেশী ‘মানবিক’। থাকবে এমনই, আরও দীর্ঘকাল।

    বাংলাদেশ ক্রিকেটে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার পথে পূরণ হোক সেই ছেলেটার মতো আরও অনেকের বুকের গহীনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলোও। আর বেঁচে থাকুক কাকতাড়ুয়ারা।

    মাথায় সাদা বা কালো রঙের হ্যাট মাথায় দিয়ে। 

     

    পুনশ্চঃ আম্পায়ারিং, আম্পায়ার, বিসিবি সম্পর্কিত তথ্যগুলো সঠিক (অনিচ্ছাকৃত ভুল বাদে) ও বাস্তব। শুধু সেই ছেলেটা, যাকে ঘিরে গল্পের শুরু, সেই চরিত্র ও তার বন্ধুর চরিত্রটি কাল্পনিক।
    তবে তাদের বিচরণ এদেশেও আছে বলে জানা যায়।