রাশিয়া যাচ্ছেন বয়সকে হার মানানো সেই ফুটবল দম্পতি
শরীরের বয়স বাড়লেও নাকি কিছু মানুষের মনের বয়স বাড়ে না। নাহলে ৮৫ ও ৭৬ বছর বয়সে ৫ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে রাশিয়াতে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া, এ কী চাট্টিখানি কথা! কতটা ফুটবল পাগল হলে মানুষ এই কাজ করতে পারে, সেটা ভারতের পান্নালাল চট্টোপাধ্যায় ও চৈতালি চট্টোপাধ্যায় দম্পতিকে না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই। কলকাতার এই বিখ্যাত ফুটবলপ্রেমী দম্পতি এবারও বিশ্বকাপ দেখতে রাশিয়া যাচ্ছেন। এই নিয়ে টানা দশমবারের মতো মাঠে বসেই বিশ্বকাপ দেখবেন তারা।
টানা দশমবার! সংখ্যাটাও মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। কলকাতার খিদিরপুরের বাসিন্দা পান্নালাল-চৈতালির প্রথম বিশ্বকাপ দর্শনটা অবশ্য বন্ধুর কল্যাণেই। ১৯৮২ সালের স্পেন বিশ্বকাপের টিকেট পেলেন লন্ডন প্রবাসী বন্ধুর থেকে। কিন্তু বললেই কি আর যাওয়া যায় এতদূর? খরচেরও তো ব্যাপার আছে নাকি? কিন্তু কী ভেবে দুজন সিদ্ধান্ত নিলেন, মাঠে বসেই খেলা দেখবেন। যে কথা সেই কাজ, ভারতবাসী যখন টিভির পর্দায় প্রথমবার বিশ্বকাপ উপভোগ করছে, এই দম্পতি স্টেডিয়ামে বসেই দেখেছেন খেলা। সেই বিশ্বকাপে ইতালির পাওলো রসি, ডিয়েগো ম্যারাডোনার খেলা দেখে মুগ্ধ দম্পতি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, যতদিন বাঁচবেন ততদিন স্টেডিয়ামে বসে বিশ্বকাপের অন্তত একটা ম্যাচ হলেও দেখবেন।
স্পেনের পর এলো ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনার অতিমানবীয় নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ঘরে তোলার সাক্ষী হলেন পান্নালাল ও চৈতালি। সেই বিশ্বকাপ থেকেই আর্জেন্টিনার সমর্থক চৈতালি। পান্নালাল অবশ্য কট্টর ব্রাজিল, পেলের সাথেও ছবি আছে তার! এ নিয়ে খুনসুটি লেগেই থাকে প্রবীণ এই দম্পতির। তবে ব্রাজিল সমর্থন করলেও পান্নালালের জীবনের সেরা মুহূর্ত ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার দৃশ্যটাই। গতবার জার্মানির কাছে ব্রাজিলের ৭-১ গোলে হারার দুঃস্মৃতিটা অবশ্য এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।
মেক্সিকোর পর ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কোরিয়া-জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল; বাদ যায়নি একটি বিশ্বকাপও! কিন্তু মাত্র সাড়ে সাত হাজার রুপি পেনশন পাওয়া পান্নালালের বিশ্বকাপে যাওয়ার খরচটা আসে কীভাবে? নিঃসন্তান এই দম্পতি খেলা দেখার জন্য যা করেন, সেটাই হয়ত সত্যিকারের ‘ফুটবল প্রেম’। পছন্দের মাছ খান না দুজন, বহুদিন খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়েছেন। চৈতালি এই বয়সেও নিজ হাতে শাড়ি তৈরি করেন, সেই শাড়ি বিক্রি করেও আসে কিছু টাকা। চার বছর পর পর সেই জমানো টাকা দিয়েই জোগাড় হয় টিকেট ও বিমান ভাড়া।
ফুটবলের প্রতি তাদের এই ভালোবাসার খবর পৌঁছেছে ফিফার কাছেও। ব্রাজিলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল ফিফা। গত বছর কলকাতায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে তাদের বিশেষ সম্মাননা দিয়েছিল সংস্থাটি। বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো স্টেডিয়ামে। এবার অবশ্য খুব বেশি সহায়তা পাচ্ছেন না, জানালেন এই দম্পতি, ‘এখন পর্যন্ত তিনটি ম্যাচের টিকেট পেয়েছি। আমরা ফিফার কাছে আবেদন করেছিলাম আরও কিছু টিকেটের জন্য, যদিও এখনো কোনো উত্তর পাইনি। আশা করি আরও কয়েকটি ম্যাচ স্টেডিয়ামে বসেই দেখতে পারব।’
৫ লাখ রুপি খরচ করে রাশিয়াতে যাচ্ছেন এই দম্পতি। ১৪ জুন রওনা হবেন, দেশে ফিরবেন ২৮ জুন, এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা এমনটাই। নিজের পরিকল্পনার কথা জানাতে জানাতে হঠাৎ চোখ ভিজে আসে পান্নালালের। এটাই হয়ত শেষবারের মতো বিশ্বকাপে যাওয়া, বলছেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধ, ‘২০২২ বিশ্বকাপের সময় আমার বয়স প্রায় ৯০ হবে। কাতারে আমাদের যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই এটাই হয়ত আমাদের শেষ বিশ্বকাপ দর্শন।’
স্বামীর কথায় চোখ ভিজে আসে চৈতালিরও। স্বামীর মতো বয়স বাড়ছে তারও। কাতার বিশ্বকাপে হয়ত শরীর সায় দেবে না দুজনেরই। চার দেয়ালের মাঝে কাতার বিশ্বকাপ টিভিতেই দেখেই নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলবেন। এবার তাই রাশিয়াতে কাটানো দুই সপ্তাহে জমা করে আনতে চান এমন কিছু স্মৃতি, যা রোমন্থন করতে করতেই কেটে যাবে জীবনের বাকি সময়টা।