বিশ্বকাপ চোখ জুড়াবে তো?
বিশ্বকাপ আসছে। আপনি অপেক্ষা করছেন চায়ের মগ হাতে, রাত জেগে দুর্দান্ত সব খেলার জন্য। তবে নাটকীয় অনেক কিছু দেখতে পারেন, ঘটনারও সম্ভবত অভাব হবে না; কিন্তু ‘দুর্দান্ত’? চোখ জুড়ানো ফুটবল যে দেখবেনই, সেটার গ্যারান্টি অবশ্য দেওয়া যায় না।
প্রথমেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। চোখ জুড়ানো ফুটবল আসলে কী? ক্লাব ফুটবল যারা নিয়মিত দেখে থাকবেন, তাদের কাছে সংজ্ঞাটা একটু অন্যরকম হওয়া উচিত। গত বিশ্বকাপে হামেসের দুর্দান্ত ওই ব্যাকভলি বা ফন পার্সির ওই হেডের মতো মুহূর্ত তো হতেই পারে। একাই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো খেলোয়াড় বিশ্বকাপে কম নেই। কিন্তু দল হিসেবে এককাট্টা হয়ে দেখার মতো ফুটবল কটা দল খেলবে? বা আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে ব্যক্তিগত সামর্থ্য নয়, দলীয় শক্তি অনুযায়ী খেলে কটা দল নজর কাড়তে পারে? সংখ্যাটা খুব বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এজন্যই বিশ্বকাপ নিয়ে এখনই আশার বেলুন ফোলালে সেতা আপনার নিজের ঝুঁকিতে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে এখন প্রেসিং ফুটবলটাই ট্রেন্ড। প্রতিটা ক্লাব এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দিতে চায় না, সেটার কৌশল ঠিক করার জন্য কোচদের মাথা ঘামাতে হয় বিস্তর। এক সাথে সারা বছর খেলে তবেই নিজেদের বুঝতে পারেন খেলোয়াড়েরা। কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহের প্রস্তুতিতে বিশ্বকাপে গিয়ে সেই প্রেসিং ফুটবল খেলা কতটা সম্ভব? ক্লাব ফুটবলের সারা বছরের ধকল সামলে সেই ফুটবল খেলার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবেই বা কতটা তৈরি থাকেন খেলোয়াড়েরা? সংশয়টা থেকেই যায়।
অথচ আজ থেকে ৩০ বছর আগেও ব্যাপারটা ঠিক এমন ছিল না। এসি মিলানের নব্বইয়ের ওই সর্বজয়ী দলের কোচ ছিলেন আরিগো সাচ্চি। তাঁর কথাটা ফুটবল পুরাণের অংশই হয়ে গিয়েছিল, ‘ফুটবল সব সময় হওয়া উচিত সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর কোনো ক্লাবই জাতীয় দলের সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না।’ সাচ্চির কথাটা ওই সময়ের জন্য ঠিক ছিল। ক্লাবে একজন খেলোয়াড় যতই ভালো খেলতেন না কেন, বিশ্বকাপ মানেই যেন নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার রঙ্গমঞ্চ। ওই সময় ক্লাবে আজকের মতো খেলোয়াড় নামানোর বাধ্যবাধ্যকতাও ছিল। বড় লিগে তিন জনের বেশি বিদেশী খেলতে পারতেন না। তার মানে, বেশির ভাগ বড় ক্লাবে নিজ দেশের খেলোয়াড়েরাই এক সাথে থাকতেন। জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময়ও তাই তাদের বোঝাপড়ায় খুব একটা সমস্যা থাকত না।
তবে এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে অনেকটাই। জার্মানি, ইংল্যান্ডের মতো কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশির ভাগ বড় দলের খেলোয়াড়েরা বিভিন্ন ক্লাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলেন। ব্রাজিলেই যেমন ব্রাজিলিয়ান লিগের খেলোয়াড় আছেন তিন জন মাত্র। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা ওই তিনই। বিশ্বকাপের আগে তাদের একসাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময়ও থাকে অল্প কিছু দিন। এর মধ্যে সবাই আবার নিজেদের নিংড়ে দিয়ে এসেছেন ক্লাবে। জাতীয় দলের কোচদের প্রেসিং ফুটবলের চাওয়া তাই পূরণ হয় কমই। কৌশলের সাথে আপস করে তাই অনেক কোচই পজেশন ধরে রাখার দিকেই বেশি মনযোগ দেবেন। খেলার গতিও তাই কমে যায় অনেক।
আর এই সত্যিটা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে কোনো হিসেবেই ক্লাব ফুটবল এখন জাতীয় দলের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। পেট্রোডলারের ঝনঝনানিতে অনেক ক্লাবই উঠেছে ফুলেফেঁপে, ফুটবলাররা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কামাই করেন দুই হাতে। টাকাই যখন শেষ কথা, নিজেদের সেখানে নিবেদনটাও থাকে ওরকম। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ তো ভিন্ন ঘরানার ক্লাবগুলোর লড়াই দেখার দারুণ একটা উপলক্ষই হয়ে গেছে। সেখানে বিশ্বকাপে নতুন কোনো কৌশল আসা দূরে থাক, এখনকার প্রচলিত কৌশলেই খেলার সাহস করতে পারেন না অনেক কোচ।
সত্যি কথা বলতে, দলীয় সামর্থ্য বিচারে সেই সাহস আছে হাতেগোণা কয়েকজনেরই। জার্মানি যেমন গত বিশ্বকাপে প্রেসিং ফুটবল খেলেছিল ভালোভাবেই, ব্রাজিলের সাথে ৭-১ গোলের ওই জয়টাই সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। স্পেন একটা সময় ধীরগতির বিল্ডআপে খেললেও গত কিছুদিনে প্রেস করে খেলার আভাস দিয়েছে। আর্জেন্টিনার কোচ হোর্হে সাম্পাওলিও ৩-৫-২ ফর্মেশনে প্রেস করে খেলানোর জন্য বিখ্যাত। তবে স্পেনের সাথে সেটা করতে গিয়ে ৬-১ গোলের হারটা নিশ্চয় ভুলে যাবেন না। প্রেসিং করতে গিয়ে কৌশল ঠিকঠাক না হলে হিতে বিপরীত হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। ব্রাজিলের অবশ্য সেই সামর্থ্য আছে ভালোমতোই, হয়তো আছে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, পর্তুগালের মতো আরও কয়েকটি দলের। তবে শুরুর দিকে সব দলই হয়তো একটু রয়েসয়ে খেলবে, পরের পর্বগুলোর জন্য শক্তি জমিয়ে রাখবে। নকআউট পর্বের আগে বড় দলগুলোর কাছ থেকে ট্যাকটিক্যাল ফুটবল আশা করলে হতাশও হতে পারেন।