• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    অনেক থেকেও কেন কিছুই নেই রাশিয়ার?

    অনেক থেকেও কেন কিছুই নেই রাশিয়ার?    

    আলেসান্দ্র গলোভিনের গল্পটা দারুণ। 

    সাইবেরিয়ান শহর কালটানে জন্ম তার। সেখানকার ২২ হাজার অধিবাসির প্রায় সবারই কাজ খনিতে। গলোভিনের প্রথম কোচ এক হাত হারিয়েছিলেন খনি-দূর্ঘটনায়। একটা ফুটবল পিচ ছিল প্রমাণ আকারের, তার কন্ডিশনও ভয়াবহ। প্রবল শীতের কথা নাইবা বলা হলো আলাদা করে! 

    আচার-আচরণে একটু লাজুক ছিলেন গলোভিন। তবে উচ্চাশা ছিল, দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। সিএসকেএ মস্কোর নজরে এসেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সেই। কোচ লিওনিড স্লাটস্কির গড়লেন তাকে, ২০১৫ সালে গলোভিন চলে এলেন প্রথম দলে। ইউরো ২০১৬-তে জাতীয় দলে খেললেন, যদিও নিজের পজিশন থেকে একটু সরে অন্য জায়গায়। ২০১৭ কনফেডারেশনস কাপের আগেই দলে অপরিহার্য তিনি, ২২ বছর বয়সে রাশিয়ার সৃষ্টিশীলতার একমাত্র উৎস গলোভিনই।

     

     

    গলোভিনের গল্পটা দারুণ, তবে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুঃখটা সেখানেই। গলোভিনের মতো যদি আরও কয়েকটা বলার মতো গল্প থাকতো রাশিয়ার! 

    তাহলেই এতো হাহাকারের সুর উঠতো না। প্রায় সাড়ে চৌদ্দ কোটি মানুষের দেশ, আইস হকির হুমকি কাটিয়েও সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। এবার বিশ্বকাপ সেখানে, অথচ বলা হচ্ছে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান দেশ তারা, সবচেয়ে বাজেও। র‍্যাংকিং-ও তাই বলে, এবার বিশ্বকাপ খেলা দেশগুলোর মাঝে সবার নিচে তো স্বাগতিকরাই। 

    গলোভিনের মতো অনেক মেধাবিই হয়তো লুকিয়ে আছে শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষায়। সেটাই মিলছে না তাদের, কেউ যে নজর দেবেন- সে সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য। যাদের ক্ষেত্রে মিরাকল ঘটে, পেশাদার ফুটবলেও আসেন, তারাও আর উন্নতির পরের ধাপে যেতে পারেন না।  

    তবে সমস্যার মূলে আর্থিক কোনও ব্যাপার নেই। সাম্প্রতিক সময়ে কম টাকা ঢালা হয়নি রাশিয়ান ফুটবলে, ২০১০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ নিশ্চিত পর সেটা বেড়েছে আরও। তবে সেসব যেন ঠিক কাজের কাজে লাগেনি। একাডেমি বা যুব কোচিং, মানসম্পন্ন অনুশীলন পিচ, ইনডোর সুবিধার পেছনে টাকা যায়নি। সেসব টাকা খরচ করা হয়েছে চড়া দামের বিদেশী ফুটবলার, এজেন্টের ফি ও অন্যায্য বেতনের পেছনে। ফল- খুব কম রাশিয়ান ফুটবলারই পারফর্ম করেন শীর্ষ পর্যায়ে, বাকিদের যেন এগিয়ে যাওয়ার মনোবলই নেই! 

    রাশিয়ার এই অবস্থা কিছুটা নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরের অবস্থার মতো। ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৮ সালে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ফাইনালিস্ট, ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট। অথচ তারাই ১৯৯৪, ২০০২ ও ২০১৪ সাল মিলিয়ে নয়টির মধ্যে জিতেছে শুধু দুইটি ম্যাচ। 

    শুরুটা ওই নব্বইয়েই। রাশিয়ার ফুটবল তখন ধুঁকছে আর্থিক দিক দিয়ে, ফুটবলাররা তখন স্বপ্ন দেখছেন পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমানোর। এর মধ্যে সবচেয়ে মেধাবিরা ইউরোপের শীর্ষ লিগে জায়গা করে নিলেন ঠিকই। ইগর শালিমভ ও ইগর কলিভানভ সিরি আ-তে, আন্দ্রেই ক্যানচেলস্কিস প্রিমিয়ার লিগে, ভ্যালেরি কারপিন, আলেকসান্দ্র মোসতোভি ও ভিক্টর অনোপকো লা লিগায়, সার্জেই কিয়াকোভ বুন্দেসলিগায়। বাকিরা ইসরায়লের মতো লিগে খেলতে গেলেন পেশার তাগিদে। তাদের শূন্যতা রাশিয়ান লিগে পূরণ করলেন উঠতি তরুণরা, ফুটবলের মান সেরকম না হলেও নিজেদের উন্নতিটা তারা উপভোগই করছিলেন। 

    বিংশ শতাব্দির ফুটবলারদের টানলো এটাই- রাশিয়ানদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য। সে পথেই এগুতে চাইলেন তারা। আন্দ্রে আরশাভিন, আলেকসান্দ কেরঝাকভ, রোমান পাভলুচেংকো, পাভেল পোগরেবনিয়াকরা রাশিয়ার বাইরে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে মরিয়া ছিলেন। সে সময়ে জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গ বা স্পারটাক মস্কোর মতো ক্লাবে বেতন কম ছিল না, তবে সেটাও তাদের আটকাতে পারেনি। বরং আয় কম হলেও বড় লিগে খেলতে তৈরি ছিলেন তারা। 

     

     

    সময় বদলায়, বর্তমান প্রজন্মের গল্পটাও তাই আলাদা। 

    স্যামুয়েল ইতো, হাল্ক, অ্যাক্সেল উইটসেল রাশিয়ান প্রিমিয়ার লিগে এলেন, ঘরের ফুটবলারদের বেতনও বাড়লো নাটকীয়ভাবে। বিদেশিদের দাপট বাড়াতে রাশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন প্রতি ম্যাচে বিদেশীদের সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দিল। মেধাবি রাশিয়ানদের মূল্য বাড়লো আরও, উদীয়মান অথচ প্রমাণিত নন এমন ফুটবলাররা পেলেন অনেক দাম। স্ট্রাইকার আলেসান্দ্র কোকোরিন ডায়নামো মস্কোর হয়েই বছরে পাঁচ মিলিয়ন ইউরো পেলেন।  

    রাশিয়ার বাইরের কোনও ক্লাব কোকোরিনকে এর এক তৃতীয়াংশও দিত না। বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না , রাশিয়ান লিগে উন্নতির প্রয়োজন বোধ করলেন না তিনি। উলটো টাকা ওড়ানোতেই মনযোগ ছিল তার। ২০১৬ ইউরো থেকে বিদায় নিয়ে মন্টে কার্লোতে কোকোরিন ও তার সতীর্থ পাভেল মামায়েভ শ্যাম্পেনের পেছনেই দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার ইউরো খরচ করেছিলেন বলে খবর এসেছিল। সমর্থকরা সেটা বিশ্বাসও করেছিলেন। যদিও ওই দুইজনই বলছিলেন, টাকার অঙ্কটা অতিশায়িত। 

    কোকোরিন বা মামায়েভ একা নন, এ তালিকায় আছেন আরও রাশিয়ান ফুটবলাররা। একযুগ আগে অ্যালান ডিজ্যাগভকে ধরা হচ্ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল একজন কিশোর ফুটবলার হিসেবে, তবে এই মিডফিল্ডার সিএসকেএ-তেই থেকে গেলেন। তার ফুটবলের উন্নতিটাও যেন আটকে গেল সেখানেই। ওলেগ শ্যাতোভের জন্ম ১৯৯০-এ, প্রতিভার আভাস ছিল তারও। তবে তিনি পথ হারিয়েছেন পুরোপুরিই, বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও জায়গা হয়নি। রাশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার সময় দুইজনেরই বয়স ছিল ২০, এতোদিনে তাদের বিশ্বমানের তারকা হয়ে যাওয়ার কথা। তবে তারা হারিয়ে গেছেন। নিজেদেরকে কোনোভাবেই নির্দোষ দাবি করতে পারেন না তারা, তবে সিস্টেম তাদের অধঃপতনকে এগিয়েই দিয়েছে শুধু। 

    জাতীয় দলের প্রতিটি বিভাগেই আছে পরিকল্পনার অভাব। সেন্ট্রাল ডিফেন্সের কথাই ধরুন। সার্জেই ইগনাশেভিচ বিশ্বকাপের সময় ৩৯-এ পা দেবেন, বেরেজাটস্কি জমজরা ৩৬-এ। ২০১৬ সালে তারা আন্তর্জাতিক খেলা ছেড়েছেন, তবে ব্যাটনটা দিয়ে যেতে পারেননি কাউকে। বিদেশী ফুটবলারদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করেও আদতে লাভ হয়নি। সিএসকেএ ছাড়া রাশিয়ার প্রতিটি ক্লাবের সেন্টার ব্যাকই বিদেশী এখন। 

    অনভিজ্ঞ জর্জি ডিঝিকিয়া, দূর্বল লেফট ব্যাক ফায়োদর কুদরিয়াশভ বা ভুলে-মশগুল ভিক্টর ভাসিন- রাশিয়ার কোচ স্ত্যানিস্লাভ চেরচেসভ একরকম বাধ্যই হয়েছিলেন এদেরকে দলে নিতে। ২৮ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত এরা সবাই সিএসকেএ-র বেঞ্চেও আসতে পারেননি। তবে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এলো ভাসিন ও ডিঝিকিয়া চোট- দুইজনই লিগামেন্ট ছিঁড়ে ফেলেছেন এ বছরের শুরুতেই। ইগনাশেভিচ অবসর ভেঙে বিশ্বকাপে এসেছেন, রাশিয়ার বিপর্যস্ত বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় সমাধান এখন তিনিই! 

    সবচেয়ে বড় পরিহাস, রাশিয়াতে নিশ্চয়ই অনেক উঁচুমানের মেধাবি ফুটবলার আছে, সাইবেরিয়ার কালটানের মতো শহরে শক্তিশালি সেন্টার-ব্যাক আছে। অথচ রাশিয়ার ফুটবল তাদের খুঁজে পায় না। তাদেরকে শেখাতে পারে না, পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে পারে না একটা পর্যায়ে যেতে। শীর্ষ লিগ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেও আসা হয়না তাদের। সেই “হতে পারতেন” ফুটবলাররা হয়তো খনিতে কাজ করেন। আর তিন লাখ চল্লিশ হাজার জনসংখ্যার আইসল্যান্ড তাই রাশিয়ার চেয়ে বিশ্বকাপে ভাল একটা পারফরম্যান্স আশা করে। 

    কারণটা খুবই সরল, খুবই অনুমিত। আইসল্যান্ড দীর্ঘমেয়াদি এক প্রক্রিয়া হাতে নেওয়ার আগে ছিল ‘মিনোজ’। সে প্রক্রিয়া এ শতাব্দিতেই শুরু হয়েছে তাদের, তরুণদের শেখানো হয়েছে, কোচদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এমন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যাতে খেলা হতে পারে বছরজুড়েই। 

    আইসল্যান্ডের যখন ফুটবল কাঠামো তৈরিতে মনযোগী, রাশিয়া তখন ব্যস্ত ছিল হাল্ককে কিনতে টাকা খরচ করতে, সারানস্কে একটা সুবিশাল স্টেডিয়াম তৈরিতে। যে স্টেডিয়াম আদতে শ্বেতহস্তির মতো। 

    রাশিয়া তাই আইসল্যান্ডের পুরো বিপরীত। রাশিয়া তাই একটা ট্র্যাজেডি। 

    অনেক থেকেও তাই রাশিয়ার যেন কিছুই নেই এখন।


    দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে