• রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮
  • " />

     

    এল-হাদারি : স্বপ্নের সমান বড়, বয়সের সমান নয়

    এল-হাদারি : স্বপ্নের সমান বড়, বয়সের সমান নয়    

    ফারিদ মন্দ্রাগোনের বয়স তখন ২৩। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ। ক্যামেরুনের রজার মিলা সেবারই গড়লেন সবচেয়ে বয়সী ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে মন্দ্রাগোন খেললেন। ডেভিড বেকহামের ফ্রি-কিকটা আটকাতে পারলেন না, ২-০ গোলে হেরে বিদায় নিল কলম্বিয়া। সেদিন চোখের জলে ভেসে যাওয়া মন্দ্রাগোন অপেক্ষা করলেন ১৬ বছর। অবসরের দ্বারপ্রান্তে এসে ডাক পেলেন আবার ২০১৪ বিশ্বকাপে। জাপানের সঙ্গে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে নামলেন মিনিট বিশেকের জন্য। আবেগে ভেসে গেল কলম্বিয়া, তাদের নায়ক যে গড়ছেন বিশ্বকাপের রেকর্ড। মন্দ্রাগোন ভাঙলেন সেই মিলার রেকর্ডটা। 

    মন্দ্রাগোন যখন রেকর্ড গড়ছেন, ব্রাজিল থেকে অনেক দূরে হয়তো সেটা দেখছিলেন আরেক গোলরক্ষক। রেকর্ড-টেকর্ড নয়, তিনি তখনও লালন করছেন বুকের গহীনের স্বপ্নটা। একটা বিশ্বকাপ যদি খেলতে পারতেন তিনি!  

    ****

    কঙ্গোর ডিলান সেইন্ট-লুইস ক্রসটা পেয়ে গেলেন একেবারে মোক্ষম জায়গায়। সামনে শুধু মিশর গোলরক্ষক। আলেকজান্দ্রিয়ার বর্গ এল আরব স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক তখন ভগ্ন-হৃদয়ের একেবারে নিশ্বাসছোঁয়া দূরত্বে। 

    “খোদা, রক্ষা করো”, ধারাভাষ্য থেকে ভেসে এলো যেন গোটা মিশরেরই আর্তনাদ। সেইন্ট-লুইসের হাফ-ভলি একহাতে ঠেকিয়ে দিলেন এসাম এল-হাদারি, যেন বিশ বছরের টগবগে তরুণ তিনি। অথচ মেঘে মেঘে কম বেলা হয়নি, হাদারি এই জানুয়ারিতেই পূর্ণ করেছেন ৪৫! 

    যোগ করা সময়ে মোহামেদ সালাহর পেনাল্টিতে বিশ্বকাপে গেছে মিশর, হাদারি করেছেন তার সেই চিরচেনা উদযাপন। গোলপোস্টে উঠে দুইহাত মেলে বসে আছেন। যেন দুষ্টু ছেলে গাছে উঠে বলছে, পারলে ধরো আমায়! আদতেই হাদারিকে রুখবে কে! তিনি নাচছেন, উল্লাসে মাতছেন। মিশরের ২৮ বছরের বিশ্বকাপ-অংশগ্রহণের খরা কাটানোয় তো তার ভূমিকা কম নেই! 

    অবশেষে একটা বিশ্বকাপ হাদারির জন্য অপেক্ষা করছে! 

    ****

    কাফর আল-বাত্তিখ, তরমুজের শহর। আভিধানিক অর্থ এমনই। ছোট এই শহরটা অবশ্য নামের মতো কোনও ফলের জন্য বিখ্যাত নয়, এর খ্যাতি কাঠের আসবাবপত্রের জন্য। হাদারির জন্ম এ শহরেই, ১৯৭৩ সালে। আর সবার মতো তার বাবারও আসবাবপত্রের দোকান। ছেলের জন্য তিনি খোলা রেখেছিলেন দুইটি পথ- স্কুলে পড়াশুনা করো, আর নাহয় কাঠের কাজকর্মে লেগে পড়ো। 

    হাদারি এই দুইটির একটিও করলেন না। তিনি বেছে নিলেন ফুটবল। তবে সেটা প্রকাশ্যে নয়। 

    অনুশীলনে যেতেন বইপত্র নিয়ে, বাসায় ভাবতো ছেলে পড়াশুনা করছে। সেই শহরের ধুলোময় পিচেই হাদারির ফুটবলের শুরু, তখন খেলতেন আউটফিল্ডে। স্থানীয় ক্লাব তার মেধাটা বুঝলো, ১৭ বছর বয়সে মিশরের দ্বিতীয় বিভাগের দল দ্যামিয়েত্তা নিয়ে গেল তাকে। সেখানকার একাডেমিতে এক বছর পার করলেন, বাবাকে তার ফুটবল নিয়ে বলার সাহসটা করার আগে। 

    অবশ্য বাবাকে জানালেও পথটা এবড়ো-থেবড়োই রয়ে গেল তার। অনুশীলনে যেতেন বাইকে করে, এক বন্ধু সঙ্গ দিতেন সেসব যাত্রায়। 

    দ্যামিয়েত্তায় আসার আগে কখনও হাতে যে গ্লাভস ছুঁয়েই দেখেননি, প্রথম দিনই তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো একজোড়া। পরদিন গ্লাভস ছাড়াই অনুশীলনে হাজির হলেন। হাতে কালশিটে দাগ পড়লো, কাটলো এখানে-সেখানে। পেশাদার ফুটবলারদের ব্যথাটা যেন তখনোই বুঝলেন তিনি, সেই উদল হাতজোড়ায়! 

    ১৯৯৩ সালে দ্যামিয়েত্তার হয়ে অভিষেক। এরপর আরও বড় চমক। ২০ বছর বয়সেই ডাক পেয়ে গেলেন জাতীয় দলে, যদিও পঞ্চম গোলকিপার হিসেবে। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সময়ও তার গাড়ি ছিল না, এক প্রতিবেশী তাকে পৌঁছে দিতেন অনুশীলন ক্যাম্পে। 

    সে মৌসুম শেষেও এক বছরের চুক্তি ছিল দ্যামিয়েত্তার সঙ্গে। এল-হাদারি গোপনে চুক্তি করে বসলেন আল-আহলির সঙ্গে। এরই মাঝে অনেক দলের নজর পড়েছে তার ওপর, তিনিও ভান করছিলেন যেন একটা দলে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় তিনি। আদতে অপেক্ষা করছিলেন মৌসুম শেষের, আল-আহলিতে যোগ দেবেন বলে। 

    আল-আহলিতেই হাদারি খেলেছেন ১২ বছর। দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়েছেন, জাতীয় দলেও তখন নিয়মিত মুখ তিনি। প্রতিপক্ষকে তটস্থ রাখতে ভালবাসেন- তা চিৎকার দিয়ে হোক, অঙ্গভঙ্গীতেই হোক। চেলসি ও আইভরি কোস্ট কিংবদন্তি দিদিয়ের দ্রগবা বলেছিলেন, হাদারি হচ্ছেন সবচেয়ে সমস্যার প্রতিপক্ষ। আফ্রিকান কাপ অব ন্যাশনসে যে একাধিকবার হাদারির মুখোমুখি হতে হয়েছিল দ্রগবাকে। 

    ২০০৮ সালে আল-আহলি ছেড়ে সুইস ক্লাব সিওনে যোগ দিলেন। এবারও কাউকে জানালেন না, অথচ তার সঙ্গে আল-আহলির চুক্তি ছিল তখনও। তাদের অভিযোগে চার মাস নিষিদ্ধও ছিলেন হাদারি। দুইবার একই ভুল করলেন, শিক্ষাও হলো তার। ২০১১ সালে হাল সিটির ট্রায়ালের পর তারা কিনতে চাইল তাকে, তবে সুদানিজ ক্লাব আল-মেরিখ সেটা মানলো না। অনিচ্ছাসত্বেও হাদারি ফিরলেন আফ্রিকাতেই। 

    ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের এই আফ্রিকাতেই মিশরের সোনালি প্রজন্মের একজন ছিলেন তিনি। ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আফ্রিকান কাপ অব নেশনস জিতেছেন টানা তিনবার। সব মিলিয়ে জিতেছেন চারবার। সেরা গোলকিপার হয়েছেন তিনবার। মিশর এরপর বিস্মৃত হয়েছে, তবে সেই যে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন! সেটা তাড়া করে ফিরেছে হাদারিকে। 

    ২০১৭ সালে সাত বছর পর আফ্রিকান কাপ অব নেশনস খেলতে গেল মিশর। হাদারি ততোদিনে গোলবারের নিচে পছন্দের তালিকায় তিনে নেমে গেছেন। তবে মালির সঙ্গে প্রথম ম্যাচের ২৪ মিনিটে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে উঠে গেলেন এল-শেনাওই, তার জায়গায় নামলেন হাদারি। 

    এরপরের গল্পটা তো আগেই বলা! 

    ****

    আর একটু হলেই অনন্য এক রেকর্ড করে ফেলতেন হাদারি। বিশ্বকাপের একই দলে শ্বশুর-জামাই, ভাবা যায়! গত বছর হাদারির মেয়ে শাদওয়া হাদারির বাগদান হয়ে গিয়েছিল উইঙ্গার মাহমুদ আবদেল-মোনিমের সঙ্গে। তবে সে সম্পর্ক টিকেছিল মাত্র ৪৮ দিন, মোনিমের সঙ্গে এক অভিনেত্রীর সম্পর্ক ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সেটা ভেঙে যায়। ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা একবার চিন্তা করুন!

    অদ্ভুত সেই রেকর্ডটা হচ্ছে না, তবে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশী বয়সী ফুটবলার হিসেবে অংশগ্রহণের রেকর্ডটা ঠিকই হয়ে যাচ্ছে তার। ক্যারিয়ারজুড়ে এই একটি স্বপ্নই দেখেছিলেন হাদারি, খেলতে চেয়েছিলেন একটি বিশ্বকাপে। 

    আন্তর্জাতিক অভিষেকের প্রায় ২২ বছর পর, অবশেষে সে স্বপ্নটা মেলছে পেখম! মিশরের হয়ে একটি ম্যাচ খেললেই হাদারি হয়ে যাবেন বিশ্বকাপ খেলা সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার। যিনি কিলিয়ান এমবাপ্পের চেয়ে ২৫ বছরেরও বড়। বেলজিয়াম কোচ রবার্তো মার্টিনেজ তার চেয়ে বয়সে ছোট। মিশরের স্কোয়াডের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার রামাদান সোভির যখন জন্ম, তারও ১০ মাস আগেই আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে গেছে হাদারির। 

    এই বয়সে এসেও হাদারি চনমনে। অনুশীলনে নিবিষ্ট। এমনকি ড্রেসিংরুম মাতিয়েও রাখতে পারেন। কেউ বলছেন, হাদারির রিফ্লেক্স কমে গেছে, আগের সেই ধারটা নেই এখন। ক্ষীপ্রতা নেই। তবে হাদারি স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানো থামাননি। পরিশ্রম থামাননি। এসব কিছুই তো বয়সকে নিছক একটা সংখ্যা বানিয়ে দেয়! 

    ****

    উইলফ্রেড রোডস টেস্ট খেলেছিলেন ৫২ বছর বয়সে। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা ইউএস ওপেনের মিক্সড ডাবলস জিতেছিলেন ৪৯ বছর বয়সে। ২০০৯ সালে ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় হওয়ার সময় টম ওয়াটসনের বয়স ছিল ৫৯। তারা প্রমাণ করে গেছেন, বয়স আদতেই একটা সংখ্যা। 

    বিশ্বকাপে রজার মিলা এটা প্রমাণ করেছেন। ফারিদ মন্দ্রাগোন করেছেন। হাদারি ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে। 

    হাদারি প্রমাণ করবেন, তিনি স্বপ্নের সমান বড়, বয়সের সমান নয়।