বাঘের গর্জন চলছেই!
বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ৩য় একদিনের আন্তর্জাতিক; চট্টগ্রাম
সংক্ষিপ্ত স্কোরঃ দক্ষিণ আফ্রিকা ১৬৮/৯, ৪০ ওভার (ডুমিনি ৫১, মিলার ৪৪; সাকিব ৩/৩৩, মুস্তাফিজ ২/২৪); বাংলাদেশ ১৭০/১, ২৬.১ ওভার (সৌম্য ৯০, তামিম ৬১*)
ফলঃ বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরাঃ সৌম্য সরকার (বাংলাদেশ)
সিরিজ সেরাঃ সৌম্য সরকার (বাংলাদেশ)
ঠিক একটা বছর আগেও কি কেউ ভাবতে পেরেছিল ২০১৫ সালের বাংলাদেশ এভাবে নিয়মিত বিরতিতে সাজবে উৎসবের শত রংয়ে রঙিন হয়ে? এই গত ঈদেই কে ভেবেছিল আগামী ঈদে বাংলাদেশ কাপ্তান ক্রিকেট মাঠের সাফল্যের বিনিময়ে দেশের মানুষের হয়ে একদিনের বাড়তি ছুটি চেয়ে বসবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে? কে ভেবেছিল বিশ্বকাপ দলে যার অন্তর্ভুক্তি নিয়েই ছিল রকমারি কানাঘুষা, সেই সৌম্য ‘সরকার’ হয়ে শাসন করবে বিশ্বসেরা বোলারদের? ভাবাভাবির এমন ফিরিস্তি দিতে গেলে তালিকাটা খুব ছোট হবে না! ভাবনার জগত ছেড়ে তাই বরং বাস্তবের দুনিয়ায় ফেরা যাক!
বাস্তবতা হচ্ছে জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারতের পর বাংলার বাঘের শিকারের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন দক্ষিণ আফ্রিকা! ঘরের মাঠে আরও একটি সিরিজ জয়, আরও একবার বিশ্বকে বাঘের গর্জন শোনানো। মাশরাফি বিন মর্তুজার টিম বাংলাদেশ দোর্দণ্ড প্রতাপেই ঘায়েল করেছে ক্রিকেটের আরও এক পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সে জয়ে তামিম-সাকিবদের মতো পুরনো সেনানীরা যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি মুস্তাফিজ-সৌম্যদের মতো তরুণ তুর্কিরা দিয়েছেন সামনে থেকে নেতৃত্ব। আর এ সব কিছুরই সুবাদে গত বিশ্বকাপ থেকে ক্রমেই একটি ‘দল’ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ বুধবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে ৯ উইকেটে; জিতে নিয়েছে ৩ ম্যাচের একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজ ২-১ ব্যবধানে।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম বাংলাদেশের জন্য ‘পয়া’ ভেন্যু হিসেবেই খ্যাত। তার উপর চলতি বছরে পাকিস্তান-ভারতের মতো উপমহাদেশীয় পরাশক্তিদের হেসেখেলে হারিয়ে আসা দলটাকে আজ অঘোষিত ‘ফেভারিট’ না মেনে উপায়ই বা কি ছিল বলুন? কিন্তু তারপরও টিটোয়েন্টি সিরিজ আর প্রথম ওয়ানডেতে হারের পর এভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিরিজ জেতা, সেটাও আবার দ্বিপক্ষীয় সিরিজের স্বীকৃত ‘ফেভারিট’ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে... বাংলাদেশের গায়ে তাই ফেভারিটের তকমা সাঁটিয়ে মাশরাফিদের কৃতিত্ব খাটো করার কিন্তু কোন সুযোগ নেই! উল্লেখ করা প্রয়োজন, নিজেদের সর্বশেষ দশটি দ্বিপক্ষীয় সিরিজের আটটিতেই জিতেছে প্রোটিয়ারা।
সেই প্রোটিয়া বাহিনীকে টাইগাররা সিরিজ হারালো টানা দুই ম্যাচ জিতে, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে যথাক্রমে ৭ ও ৯ উইকেটের অনায়াস জয়ে!
টস জিতে আজ প্রথমে ব্যাট করতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকা শিবিরে প্রথম আঘাতটি হানেন মুস্তাফিজুর রহমান। ফুল লেন্থ ডেলিভারি কুইন্টন ডি ককের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে সরাসরি ষ্ট্যাম্পে...নতুন ইতিহাস রচনার সেখানেই শুরু। এরপর নিয়মিত বিরতিতে সাকিব-মাহমুদুল্লাহরা ফিরিয়ে দিলেন ডু প্লেসি, আমলা, রুশোদের। দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে সাকিব পেরোন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুশো উইকেটের মাইলফলক। দলীয় সংগ্রহ পঞ্চাশ ছুঁতেই টপ অর্ডারের চার উইকেট খুইয়ে ততক্ষণে বেশ বিপাকে সফরকারীরা।
বৃষ্টির বাঁধায় খেলা ১০ ওভার কমে আসার পর সাকিবের পিছু নিয়ে তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ২০০ ওয়ানডে উইকেটের ক্লাবে যোগ দেন অধিনায়ক মাশরাফিও। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা মিলারকে (৪৪) মাশরাফির বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দুর্দান্ত এক ক্যাচে তালুবন্দী করেন সাব্বির রহমান। খানিক বাদে ফারহান বেহার্ডিনকেও লং অনের সীমানা দড়ির সামনে আরও একটি নজরকাড়া ক্যাচে ফেরান সাব্বির। শুরুর দিকে হাশিম আমলার ‘সহজ’ ক্যাচটা ফেলে দেয়ার মাশুল কড়ায়গণ্ডায়ি পুষিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই ফিল্ডার। সাকিব-মুস্তাফিজ-রুবেলদের অব্যাহত আক্রমণের মাঝ দিয়েই জেপি ডুমিনি (৫১) রানের চাকা ঘুরিয়ে নিয়ে যান ‘সম্মানজনক’ সংগ্রহে। নির্ধারিত ৪০ ওভার শেষে যেটা দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ১৬৮ রানে।
ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয় ১৭০ রানের। শুরু থেকেই দাপুটে ব্যাটিংয়ে সেটিকে ক্ষণিকের জন্যেও ‘অসাধ্য’ মনে হওয়ার কোন সুযোগ দেন নি সৌম্য সরকার ও তামিম ইকবালের উদ্বোধনী জুটি। বাহারি স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে মাত্র ৯ ওভারেই স্কোরবোর্ডে ৬০ রান যোগ করে এ জুটি। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের জুটি।
৭৫ বলে ১৩ চার, ১ ছয়ে সাজানো ৯০ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসটি খেলে সৌম্য যখন থামলেন বাংলাদেশ তখন জয় থেকে ষোল রান দূরে। আজকের দিনে বাংলাদেশের অতৃপ্তি বলতে সৌম্যর ওই শতক না পাওয়ার আক্ষেপটুকুই। লিটন দাসকে নিয়ে বাকি পথটুকু পাড়ি দেয়া তামিম ইকবাল শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৬১ রান নিয়ে, ৭৭ বল মোকাবেলায় ৭টি চারের মারে।
আজকের ম্যাচে অনবদ্য ৯০ রান আর সিরিজজুড়ে সবচেয়ে বেশী ২০৬ রান করে যথাক্রমে ম্যাচ ও সিরিজ উভয়টিরই সেরা সৌম্য সরকার।