সবচেয়ে দুর্ভাগা ফুটবলারই এখন সপ্তম স্বর্গে
১.
ডায়নামো মস্কোর হয়ে এক মৌসুমে ১৭ গোল। তাতেই রাশিয়া ছেড়ে স্পেনের আলো ঝলমলে লিগে খেলার সুযোগ মিলে গেল দিমিত্রি চেরিশেভের। রাশিয়ানরা এমনিতেই ঘরকুনো। চেরিশেভ কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে দুইবার ভাবেননি, লা লিগায় খেলার ভাগ্য হয় কয়জন রাশিয়ানের? পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়েই গিহন যাত্রা। বাবা চেরিশেভ স্পোর্টিং গিহনের মূল স্ট্রাইকার। ছেলে ডেনিস চেরিশেভকেও ভর্তি করিয়ে দিলেন সেখানেই, স্পোর্টিং গিহনের একাডেমিতে। ছোট চেরিশেভের বয়স তখন মাত্র ৬। বাবা যতদিন স্পোর্টিংয়ের হয়ে খেললেন, ছেলে ডেনিসও ততদিন থাকলেন সেখানেই। এরপর বাবার আবার ক্লাব বদল, বুর্হোসে যোগ দিলেন বাপ-ব্যাটা। সিনিয়র চেরিশেভ সিনিয়র দলে, ছোটটা একাডেমিতেই।
বাবার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষদিকে, ডেনিস চেরিশেভের তখন শুরু। বুর্হোস ছেড়ে কৈশোরেই যোগ দিলেন রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলে। বয়স ১২, জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন স্পেনে, বাকি অর্ধেক জন্মভূমি রাশিয়ায়। কিন্তু স্প্যানিশ ফুটবলের ছায়া ঢুকে গেছে তার ভেতর। আর দলটা বয়সভিত্তিক হলেও বা কি আসে যায়? রিয়াল মাদ্রিদের বয়স ভিত্তিক দলে ঢোকা তো এই দেশের স্কুল ভর্তি পরীক্ষার ভালো স্কুলে ঢোকার লড়াইয়ের চেয়ে কম কিছু নয়।
২.
২০১১ সালে মার্কাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- তিনি যত না বেশি রাশিয়ান, তার চেয়ে বেশি স্প্যানিশ। কিন্তু জাতীয় দল বাছাই করার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। জন্মভূমিকেই বেছে নিয়েছিলেন। জাতীয় দলের অভিষেকটাও বাবার মতোই, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। ২০১২ সালে জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার আগেই অবশ্য রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার হয়ে দ্বিতীয় স্তরের ফুটবলে নিজেকে নিয়মিত করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ২১ বছর বয়সে আর রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে খেলা হয়নি। লা লিগায় আরেকটু মানিয়ে নেওয়া দরকার তার। তাই অনেকের মতোই তাকেও ধারে পাঠিয়েছিল রিয়াল, সেভিয়ার কাছে। চেরিশেভ ততোদিনে ইউরোপের উঠতি নামকরা খেলোয়াড়দের একজন। রাশিয়ার তারারা তখন একে একে ঝরে পড়ছেন। ৫ বছর পর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ, দলের কী অবস্থা হবে সেটা নিয়ে রাশিয়ানদের দুশ্চিন্তা তখন থেকেই। তরুণ চেরিশেভকে ঘিরে তখন আশা দেখেছিলেন অনেকে। কিন্তু সেভিয়ায় গিয়ে মাঠে নামারই সুযোগ হলো না চেরিশেভের, খেললেন মাত্র ৪ ম্যাচ। তার মধ্যে একটা ছিল আন্দালুসিয়ান ডার্বি, মালাগার বিপক্ষে। সেভিয়া ২-১ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় মাঠে নেমেছিলেন, চেরিশেভ নামার পর সেই ম্যাচ সেভিয়া হারলো ৩-২। ভাগ্যটাও তখন থেকে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করল। চেরিশেভ ফুটবল ভালোবাসেন, কিন্তু ইনজুরি তাকে ভালোবাসে আরও বেশি। খেলবেন কি? ক্রাচ ছাড়ার প্রহর গুনতেই দিন যায় তার। রিয়ালের লক্ষ্যও তাই অপূর্ণ থেকে গেল। তবে আরেকটা সুযোগ পেলেন চেরিশেভ, ২০১৪ তে গেলেন ভিয়ারিয়ালে। সেখানে মানিয়ে নিতে পারলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশই হয়ে গেলেন তিনি। রিয়ালও সফল, পরের মৌসুমেই তাকে আবার দলে ফিরিয়ে আনল তারা।
৩.
ডিসেম্বর ২, ২০১৫ কাদিজ।
কোপা ডেল রেতে কাদিজের মাঠে প্রথম লেগের খেলা। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে এর আগে লা লিগার একটি ম্যাচে খেলার সুযোগ হয়েছিল চেরিশেভের। কাদিজের বিপক্ষে শুরু থেকেই দলে তিনি। স্বপ্নের জার্সিটা গায়ে চড়াতে পারলেন অবশেষে। লা লিগার ওই ম্যাচে ১৩ মিনিট খেলার সুযোগ হয়েছিল তার। এক অর্থে তাই কাদিজের বিপক্ষে ম্যাচটাই অভিষেক। স্বপ্নপূরণের দিনটা রাঙিয়ে দিলেন গোল করে। রিয়াল জিতল ৩-১ ব্যবধানে। প্রথম গোলটাই করেছিলেন রিয়াল লেফট উইঙ্গার, ডেনিস চেরিশেভ।
গল্পটা এখানেও থামতে পারত। ২০১৩ সালে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে নেমেছিলেন চেরিশেভ। বদলি হয়ে মাঠে ঢুকেছিলেন বিরতির সময়, বের হয়ে আসতে হয়েছিল ৫ মিনিট পরই, ইনজুরি নিয়ে। ২০১৪ বিশ্বকাপের আগে প্রীতি ম্যাচের জন্য রাশিয়া দলে ডাক পেয়েছিলেন। তার আগে পড়লেন ইনজুরিতে, খেলা হলো না সেই ম্যাচেও। নিজেকেও প্রমাণ করা হলো না ফ্যাবিও ক্যাপেলোর কাছে। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত দলেও তাই হলো না জায়গায়। রিয়ালের জার্সিতে এমন কিছু ঘটেনি, উলটো গোল করে জিতিয়েছেন দলকে।
কিন্তু চেরিশেভের রিয়াল ‘শুরুর’ অধ্যায়টা হয়ে গেল কুখ্যাত। আগের মৌসুমে কার্ড দেখার শাস্তি হিসেবে একটা ম্যাচ নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি। কিন্তু দল ঘোষণার সময় নাকি এটা জানাই ছিল না রিয়াল মাদ্রিদের! রেফারিদের পক্ষ থেকেও নাকি কোনো কিছু জানানো হয়নি। এসব কিছুই পরে অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছিল রিয়াল। কিন্তু ঘটনা হলো আসলেই নিষিদ্ধ ছিলেন চেরিশেভ, ওই ম্যাচে খেলারই কথা ছিল না তার। আইনভঙ্গ করায় শাস্তিটা পেল রিয়াল মাদ্রিদ। কোপা ডেল রে থেকে নিষিদ্ধ করা হলো স্পেন আর ইউরোপের রাজাদের। শিরোপা নিয়ে আক্ষেপের চেয়ে ওই ঘটনা রিয়ালের সম্মানে আঘাত করল বেশি। আর সবকিছুর বলি হলেন চেরিশেভ নিজে। স্বপ্নের মতো শুরুটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে সময় নিল না। প্রথম রাশিয়ান হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি পরতে পারার গৌরবও ম্লান হয়ে গেল নিমিষেই।
আরও একবার মৌসুম শেষে তাই ব্যাগ গোছাতে হলো তাকে। এবার ভ্যালেন্সিয়ার পথে। সেখানেও একই দশা। ইনজুরি তার পিছু ছাড়ে না। কিন্তু মৌসুম শেষে রিয়াল তার সঙ্গ ছাড়ল। এরপর পাকাপাকিভাবে ভিয়ারিয়ালের হয়ে গেলেন চেরিশেভ। কিন্তু বারবার ক্লাব বদলে খেলার ওপর একটা প্রভাব পড়ল। ইউরোপিয়ান ফুটবলের ‘ওভারটেডেড’ টার্মটা জুড়ে গেল চেরিশেভের সঙ্গেও। নিজ দেশে কনফেডারেশনস কাপ, সেখানেও হলো না জায়গা। কোচ প্রাধান্য দিলেন রাশিয়ান লিগে খেলা খেলোয়াড়দের।
৪.
দুর্ভাগ্য যার পিছু ছাড়ে না, তিনিই হুট করেই একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। ফ্রান্সের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচের জন্য রাশিয়া দলে ডাক পেয়েছেন চেরিশেভ, প্রায় আড়াই বছর পর। দলে ডাক পাওয়ার তেমন কোনো কারণ ছিল না। ক্লাবের হয়ে আহামরি কিছু করেছেন, এমনও না। চমক এখানেও শেষ নয়। বিশ্বকাপের জন্য ২৩ জনের দলেও স্তানিশ্লাভ চেরচেশভের দলে থেকে গেল নামটা। চেরিশেভ খেলবেন বিশ্বকাপে, ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে। অথচ ক্লাবের হয়ে এই মৌসুমে তিনি খেলতে পেরেছেন মাত্র ৯ ম্যাচ। ঘরোয়া লিগের খেলোয়াড় দিয়েই দল ঘোষণা করার অভ্যাস ছিল চেরচেশভের। কনফেডারেশনস কাপেও সেটাই করেছিলেন। বিশ্বকাপের আগে কি মনে করে দুইজনকে ডাকলেন, তারা রাশিয়ার কোনো ক্লাবে খেলেন না। তাদের মধ্যে একজন চেরিশেভ, তিনি রাশিয়ার ক্লাবে খেলেননি কখনই।
১৪ জুন, ২০১৮। রাশিয়া বিশ্বকাপ। উদ্বোধনী ম্যাচ, লুঝনিকি স্টেডিয়াম।
খোদ রাশিয়ানরা নিজেদের দল নিয়ে সংশয়ে। বিশ্বকাপে খেলা দলগুলোর ভেতর সবার চেয়ে নিচে রাশিয়া। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ, উৎসব না উৎকন্ঠা? রাশিয়ানরা দ্বন্দ্বেই পড়ে গিয়েছিল। সেটা পরিণত হয়েছিল অস্বস্তিতে।
সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম একাদশে ছিলেন না চেরিশেভ। গ্রাজিনস্কির গোলে লিড নেওয়ার পর উৎকণ্ঠার চাপিয়ে উৎসবে রঙ্গিন হলো রাশিয়া। কিন্তু ২৪ মিনিটে অ্যালান জাগোয়েভ হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়লে আবারও শঙ্কা চেপে বসে। চেরিশেভের নামার কথা ছিল না, হুট করেই নেমে পড়তে হলো। বড় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। মাঠে নামার আগে চেরিশেভ চাইলে সেদিন নিজেকে অপয়া ভাবতে পারতেন। রিয়ালের খেলোয়াড় হয়েও রাশিয়া বিশ্বকাপে না খেলার আক্ষেপে পুড়তে পারতেন। কোপা ডেল রে এর কেলেঙ্কারির পরই হারিয়ে যেতে পারতেন। সবকিছু একবার ভেসে উঠতে পারত তার চোখের সামনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যকে সঙ্গী করে এতোদিন হয়ত একটা স্বপ্নই দেখে এসেছিলেন।
একটা সুযোগের দরকার ছিল চেরিশেভের। সেটাও যখন পেয়ে গেলেন, আর হাতছাড়া করলেন না। ডানদিক থেকে আসা বল প্রথমে নিয়ন্ত্রণে নিলেন, পরেরবার বাঁ পায়ের শটে নিখুঁত ফিনিশ। প্রথমার্ধের আগেই রাশিয়াকে এগিয়ে দিলেন আরেকবার, জাগোয়েভের না থাকাটা তখন রাশিয়ানদের জন্য শাপেবর। শেষদিকে আরও একবার গোল করলেন চেরিশেভ। তিনি নিজে ‘চেরিশ’ করবেন প্রথম গোলটা বেশি, রাশিয়ার জার্সি গায়ে ওটাই তো তার প্রথমবার জালের নিশানা খুঁজে পাওয়া। কিন্তু মানুষ মনে রাখবে সৌদি আরবের বিপক্ষে চেরিশেভের দ্বিতীয় গোলটা। রাশিয়ানদের দরকার ছিল একজন নতুন নায়ক, একজন ত্রাণকর্তা। দ্বিতীয় গোলে চেরিশভের পায়ের কাজ দেখে ত্রাণকর্তা চিনে নিতে ভুল হয়নি রাশিয়ানদের। আর চেরিশেভ ভোলেননি কঠিন সময়ে তার পাশে থাকা মানুষগুলোকে। পরিবারকে উতসর্গ করেছেন দুইটি গোল। চোখে মুখে উচ্ছ্বাস, দায়মুক্তির আনন্দ, তৃপ্তি।
দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে এক কাতারে থাকতে চায়নি রাশিয়া। মিশরকে হারিয়ে সেই পথে তারা এগিয়ে গেছে অনেকটাই। চেরিশেভ গোল করেছেন ওই ম্যাচেও। তার গোলটাই ম্যাচে ছিটকে দিয়েছে মিশরকে। দুই ম্যাচে তিন গোল, গোল্ডেন বুটের দৌড়েও এগিয়ে আছেন। রাশিয়াকে নিয়ে যাচ্ছেন শেষ ষোলতেও, সেই চেরিশেভই।
“নাও দ্যাট ডোন্ট কিল মি, ক্যান অনলি মেক মি স্ট্রংগার” – কোপা ডেল রের ওই ঘটনার কয়েকদিন পর টুইট করেছিলেন চেরিশেভ। চেরিশেভ অনুপ্রেরণা খুঁজেছিলেন প্রবাদ বাক্যে। সেটা হয়ে গেছে ভবিষ্যৎবাণী। নিজেকে চেনাতে বিশ্বকাপের চেয়ে বড় সুযোগ আর কই পেতেন চেরিশেভ?